।। মাসুম খলিলী ।।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের প্রথম বার্ষিকীতে, বেইজিং “ইউক্রেন সংকটের রাজনৈতিক মীমাংসার বিষয়ে চীনের অবস্থান” শিরোনামে একটি অবস্থানপত্র প্রকাশ করেছে। এতে ১২ দফায় চীনের অবস্থানকে পদ্ধতিগতভাবে ও বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
চীনের ১২ দফা প্রস্তাবে রয়েছে, সব দেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করা, শীতল যুদ্ধের মানসিকতা পরিত্যাগ করা, শত্রুতা বন্ধ করা, শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করা, মানবিক সংকটের সমাধান করা, বেসামরিক ও যুদ্ধবন্দীদের রক্ষা করা, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিরাপদ রাখা, কৌশলগত ঝুঁকি হ্রাস করা, শস্য সরবরাহ বজায় রাখা, রপ্তানিতে একতরফা নিষেধাজ্ঞা বন্ধ করা, শিল্প ও সরবরাহ শৃঙ্খল স্থিতিশীল রাখা এবং দ্বন্দ্ব-পরবর্তী পুনর্গঠনের কাজ শুরু করা।
ইউক্রেনের প্রতিক্রিয়া
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির উপদেষ্টা মাইখাইলো পোডোলিয়াক টুইট করে বলেছেন, যে কোনও শান্তি পরিকল্পনায় যদি শুধুমাত্র একটি যুদ্ধবিরতির কল্পনা করা হয় এবং রাশিয়াকে ইউক্রেনের যে কোনও অংশে দখল চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় তার অর্থ শান্তি প্রতিষ্ঠা নয়, যুদ্ধকে স্থগিত করা। ইউক্রেন মনে করে দেশটির ভূখন্ড থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহার ছাড়া কার্যকর শান্তি সম্ভব নয়।
আত্মসমর্পন করার মতো পরাজিত হবার অবস্থা ইউক্রেনের কোনভাবেই এখনো সৃষ্টি হয়নি যাতে তারা রুশ দখল বজায় থাকা অবস্থায় যুদ্ধ বন্ধের বিষয় মেনে নেবে।
পূর্ব ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনে কিয়েভ সৈন্যদের মনোবল এখনো উচ্চে। ডনেটস্কের পূর্বাঞ্চলে “কুক” কল সাইন দিয়ে যাওয়া একজন সৈনিক বলেছেন,”ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করছেন। কেউ ভাবেনি যে ইউক্রেন তার অবস্থান ধরে রাখবে, আমি জানি অলৌকিক ঘটনা ঘটে”। এর মানে হলো ইউক্রেনিয়ানদের অনেকে এখনো বিশ্বাস করে রাশিয়া পরাজিত হতে পারে। কারণ রুশ জয় মানে ইউরোপের পরাজয়।
পাশ্চাত্যের মনোভাব
ইউক্রেনের মিত্ররাও চীনা প্রস্তাবের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান সিএনএন-এ বলেন যে, প্রস্তাবের প্রতি তার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল যে “এটি এক পর্যায়ে থামতে পারে, যদি সব জাতির সার্বভৌমত্বকে সম্মান করা হয়।”
তিনি উল্লেখ করেন: “রাশিয়া যদি ইউক্রেনে আক্রমণ করা বন্ধ করে এবং তার বাহিনী প্রত্যাহার করে তবে এই যুদ্ধ আগামীকাল শেষ হতে পারে… এটি ছিল একটি তৈরি করা যুদ্ধ।”
জার্মান সরকারের মুখপাত্র উলফগ্যাং বুচনার বলেছেন যে, চীনা প্রস্তাবে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট রয়েছে, তবে এতে একটি মূল বিষয় অনুপস্থিত রয়েছে সেটি হলো: “প্রথম এবং সর্বাগ্রে ইউক্রেন থেকে রাশিয়ান সৈন্য প্রত্যাহার।”
রুশ নীরবতা
চীনের প্রস্তাবে এখনো পর্যন্ত রাশিয়া নীরব রয়েছে। তবে এটি স্পষ্টত মনে হয় বেইজিং রাশিয়ার সাথে আলোচনা করে এই প্রস্তাব দিয়েছে।
সামরিক বাধা এবং নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, ৭০ বছর বয়সী পুতিন পশ্চিমাদের নব্য-নাৎসি বাহিনীকে সমর্থন করার অভিযোগ এনে এবং রাশিয়ার বেঁচে থাকাকে এটি ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে দাবি করে পিছু হটতে অস্বীকার করেছেন।
পুতিন মঙ্গলবার তার রাষ্ট্রীয় ভাষণে বলেছিলেন, “আমরা মানুষের জীবন রক্ষা করছি, এটি (ইউক্রেন) আমাদের আদি বাড়ি, আর পশ্চিমের লক্ষ্য অবিরাম শক্তি প্রয়োগ করা ।”
ইউক্রেনের উপর পুতিনের আক্রমণ এবং এরপর সেখান থেকে প্রত্যাহার ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়ার সবচেয়ে বড় গণপ্রস্থান হতে পারে। কিন্তু অনেক রাশিয়ান অর্থনৈতিক সমস্যা এবং বহুসংখ্যক হতাহতের পরও পুতিনের পিছনে সমর্থন বজায় রেখেছেন। মস্কোর ৪৮ বছর বয়সী নিরাপত্তা প্রহরী লিউবভ ইউডিনা বলেছেন “দেশটি সত্যিই উন্নতির জন্য পরিবর্তিত হচ্ছে”।
এর উল্টোটাও রয়েছে। ২৮ বছর বয়সী একজন শিক্ষক রুসলান মেলনিকভ হতাশ হয়ে বলেছেন,”আমি এখন কোন ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছি না।”
আরও পড়তে পারেন-
- ধর্ষণ প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা
- কিশোর অপরাধ রোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে
- আদর্শ পরিবার গঠনে যে সব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরী
- ইসলামে সামাজিক সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখার গুরুত্ব
- মানুষ মারা যাওয়ার পর, তাঁর আত্মার কি হয় ?
পুতিন অবশ্য এখন সম্ভবত বুঝতে শুরু করেছেন, ইউরোপ ও ন্যাটোর উপর বিজয় অর্জন করা মস্কোর পক্ষে অসম্ভব। এজন্য চীনের সাথে অপ্রকাশ্য আলোচনা করে শান্তি প্রস্তাবে তিনি সবুজ সংকেত দিয়েছেন বেইজিংকে।
যুদ্ধ কি শেষ হবে?
যুদ্ধ সম্পর্কে বলা হয় এটি আপনি শুরু করতে পারেন নিজের সিদ্ধান্তে কিন্তু তা আপনি চাইলে শেষ করতে পারেন না। একটি পুরানো চীনা প্রবাদ আছে: অসুস্থতা আসে ভূমিধসের মতো, অসুস্থতা যায় সুতোর মতো টানা ধীরগতিতে। বেইজিংও মনে করে, আমাদের কারো এমন একটি জাদু সমাধান নিয়ে আসার আশা করা উচিত নয় যা অবিলম্বে ইউক্রেন সংকট সমাধান করবে। কোন ব্যক্তি, দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা এটি অর্জন করতে পারে না। জটিল সমস্যার সহজ সমাধান নেই। তবে, সমস্যা যত জটিলই হোক না কেন, সংলাপ ও আলোচনার পথ ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়; বিরোধ যতই তীক্ষ্ণ হোক না কেন, রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অবিচল থাকা উচিত; আর পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক না কেন, শান্তির সুযোগ দেওয়া উচিত।
বর্তমানে আমেরিকা ও পশ্চিমারা যেমন রাশিয়ার সাথে চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তেমনি চীনকে এই সম্পর্ক ব্যবহার করতে বলছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করে না এমন কোনো সমাধান ভালো নয়।
যুদ্ধ বন্ধ সম্ভব যদি-
যুদ্ধ সব পক্ষ বন্ধ করতে চায় বলে মনে হয়। তবে নিজেদের জয়কে একই সাথে নিশ্চিত করতে চায়। চীনা প্রস্তাবের ইতিবাচক দিকটি হলো এখানে একটি মধ্যপন্থার সন্ধান করা হয়েছে। ভৌগলিক অখন্ডতার স্বীকৃতি এতে রয়েছে আবার রাশিয়ার উপর আরোপিত একপাক্ষিক (জাতিসংঘে ছাড়া) বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর এটি শুরু হয়েছে আর এখন এটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ দুটি বিষয়কে নিষ্পত্তি করা ছাড়া কার্যকর সমঝোতা হবে বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে ডনবাস অঞ্চলকে ছাড়তে হবে রাশিয়াকে আর ক্রিমিয়ার উপর রাশিয়ার দখলদারিত্বকে মেনে নিতে হবে কিয়েভকে। রাশিয়ান সৈন্য ইউক্রেনের অধিকৃত অঞ্চল থেকে প্রত্যাহারের নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে হবে। ইউক্রেণের অবকাঠামো পূনর্বাসনে রাশিয়াকে ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে অংশ নিতে হবে। ডনবাসে মিনসক চুক্তি অনুসারে ইউক্রেনের রাষ্টূীয় কাঠামোর মধ্যে স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করা যেতে পারে। যেটি নিশ্চিত করতে পারে জাতিসংঘ বাহিনী মোতায়েনের মাধ্যমে। এই মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য হলে বাকি বিষয়গলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাস্তবায়িত হয়ে যেতে পারে।
তবে মধ্যস্থতার এই প্রক্রিয়ায় কেবলমাত্র চীনের সম্পৃক্ততা সমাধানে উন্নীত হতে সহায়তা করবে না। এখানে তুরস্কের মতো কোন দেশকেও সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন হতে পারে। কারণ শান্তি প্রতিষ্ঠায় চীনের একক ক্রেডিট যুক্তরাষ্ট্র মেনে নেবে না তার প্রতি প্রতিদ্ধন্দ্বীসুলভ মনোভাবের কারণে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকা।
উম্মাহ২৪ডটকম: আইএএ