নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কশাঘাতে বিশ্বের ৮০০ কোটি মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষও ভুগছে হতাশায়। করোনাভাইরাসের আগ্রাসনে বিশ্বের স্বাস্থ্যব্যবস্থাই শুধু ভেঙে পড়েনি, ভেঙে পড়েছে প্রায় সব দেশের অর্থনীতি। সেই ধকল কাটিয়ে ওঠার প্রস্তুতি যখন চলছিল ঠিক তখনই ইউক্রেনে রুশ হামলা বিশ্বে খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের উদ্ভব ঘটিয়েছে। এ সংকটের হাত থেকে জ্বালানি তেল রপ্তানিকারী গুটিকয় দেশ ছাড়া আর কেউই রক্ষা পাচ্ছে না। বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বিশ্ববাসীকে চমক দিচ্ছিল ঠিক তখনই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে দেশের ১৬ কোটির বেশি মানুষ। প্রতিদিনই বাড়ছে খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের দাম।
গত সপ্তাহে গরুর মাংস প্রতি কেজি ৬৮০ টাকায় বিক্রি হলেও এ সপ্তাহে তা ৭২০ টাকায় ঠেকেছে। লবণের দাম কেজিপ্রতি ৫ টাকা বেড়েছে। বাজারের দামের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে সর্বস্তরের মানুষ। গত সপ্তাহের তুলনায় বাজারে সবজির দাম কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। ডিম ডজনে ২০, ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ২০ ও গরুর মাংস কেজিতে ৪০ টাকা বেড়েছে। বিশ্বমন্দার কারণে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য প্রতিটি পণ্যের দাম। নতুন পিঁয়াজের কেজি ৪০ টাকা। রসুন ১২০-১৫০ টাকা। দেশি আদা ১২০-১৫০ টাকা। চীনা আদা ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা। আলুর কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা। খোলা চিনির কেজি ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। খোলা আটা ৬০ টাকা কেজি। প্যাকেট আটার কেজি ৬৫ টাকা। বাজারে কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। আগের সপ্তাহে ছিল ৮০ থেকে ১০০ টাকা। বছরের এই সময় একটি লাউ ২০ থেকে সর্বাধিক ৩০ টাকায় বিক্রি হলেও এবার ৭০ থেকে ১০০ টাকা। বাজার করতে গিয়ে মূল্যবৃদ্ধির দাপটে হিমশিম সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশ জ্বালানি ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশে পরনির্ভরশীল। গম, ডাল, চিনি, ভোজ্য তেল এমনকি চালের ক্ষেত্রেও পরনির্ভরতা কাটেনি। বিশ্ববাজারে মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় নিত্যপণ্যের বাজারে হাহাকার লেগেছে; যা রোধে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে শক্ত হতে হবে। নিজেদের স্বার্থেই।
আরও পড়তে পারেন-
- ধর্ষণ প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা
- কিশোর অপরাধ রোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে
- আদর্শ পরিবার গঠনে যে সব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরী
- ইসলামে সামাজিক সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখার গুরুত্ব
- মানুষ মারা যাওয়ার পর, তাঁর আত্মার কি হয় ?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণায় মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যবহৃত ১১টি নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন সেবার মূল্য এক বছরের ব্যবধানে সর্বনিম্ন ৭ থেকে সর্বোচ্চ ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে চাল, ডিম, মাংস, সবজি, ভোজ্যতেল, বিবিধ খাদ্যপণ্য, কোমল পানীয়, কাপড়, জুতা, জ্বালানি ও বাসাভাড়া। এ ছাড়া গৃহসামগ্রী, গণপরিবহণ, বিনোদন ও শিক্ষা এবং বিবিধ পণ্য ও সেবাও রয়েছে এ তালিকায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব পণ্য ও সেবার দাম বহুলাংশে বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে গেছে। অথচ বাস্তবতা হলো, বিদ্যমান দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মানুষের আয় মোটেই বাড়েনি। এ প্রেক্ষাপটে জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আপোশ করে জীবিকা নির্বাহ করছে দেশের সিংহভাগ মানুষ। তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক।
বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রয়ক্ষমতা না বাড়ায় দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্নআয়ের শ্রমজীবীরা অসহায়বোধ করছেন; অথচ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন উচ্চবাচ্য হয় না বললেই চলে। বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারের শক্ত কোনো ভূমিকা নেই, এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সাধারণত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে কথাবার্তা উঠলে পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা পরস্পরের ওপর দোষারোপ করে থাকেন। এভাবে একপক্ষ অপরপক্ষকে দোষারোপ করলেও এটি যে মূলত ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেকের অভিযোগ-দেশের ব্যবসায়ীরা পকেট স্ফীত করার বাইরে অন্য কিছু ভাবেন না; জনস্বার্থকে মোটেই গুরুত্ব দেন না। ব্যবসায়ীদের এহেন আচরণ ও কর্মকা- অযৌক্তিক; অমানবিকও বটে। এ অবস্থায় লোকঠকানো মানসিকতা পরিহার করে তেল, চিনিসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ী সমাজ আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হবে।
করোনায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের জন্য আরেকটি সমস্যা। দেশে এত বড় বাজার, যা শুধু আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ‘ন্যায্যতার’ মূল্যবোধ দিয়ে গড়ে তুলতে না পারলে দ্রব্যমূল্য কেন, কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
সব কিছুর দাম বাড়ায় সংসার খরচ বেড়ে গেছে। যে কারণে আয়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের পেছনে। চাহিদার সঙ্গে দাম যাতে না বাড়ে, সেজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো দৃশ্যত কিছু বিশেষ ব্যবস্থাও নিয়ে থাকে। তবে আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, এসব ব্যবস্থা বাজার নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। এটা স্পষ্ট যে, করোনা-দুর্যোগে অনেকের আয়-রোজগার কমে গেছে, অনেকেই হয়েছেন কর্মহীন। এখনো বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে যাতে বাজারকে অস্থিতিশীল করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখার কথা জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন কর্মকর্তারা। অবশ্য এসব তৎপরতায় তেমন কোনো সাফল্য আমরা দেখি না। বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পণ্য বিপণন, বাজার মনিটরিং ইত্যাদি যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এগুলো যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য পরিবহন নির্বিঘ্ন রাখতে বিশেষ করে কৃষিপণ্যের সরবরাহে যাতে কোনো বাধার সৃষ্টি হতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের। এর বাইরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে।
কেন্দ্র থেকে স্থানীয় উৎপাদন ক্ষেত্র পর্যন্ত ব্যবস্থাপনাও নজরদারির আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে আমদানিকৃত ও দেশজ উৎপাদিত, এই দুই ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ও নির্বিঘ্ন রাখার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ