Home মহিলাঙ্গন হুযূর (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের যামানায় নারীদের দ্বীনি দাওয়াত ও খিদমত

হুযূর (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের যামানায় নারীদের দ্বীনি দাওয়াত ও খিদমত

।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।

পুত্রের প্রতি মাতার দাওয়াতঃ

হযরত আনাস (রাযি.)এর মাতা ইসলাম গ্রহণের সময় স্বামী মালেক ইবনে নযর সফরে ছিলেন। তিনি সফর থেকে ফিরে স্ত্রীকে বললেন, কি ব্যপার! তুমি দেখি নিজ ধর্ম ত্যাগ করে বে-দ্বীন হয়ে গেছ? জবাবে হযরত আনাস (রাযি.)এর মাতা উম্মে সুলাইম বললেন, আমি বে-দ্বীন হইনি বরং এক মহামানব (রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছি।

অতঃপর তিনি নিজ সন্তান হযরত আনাস (রাযি.)কেও সত্য ধর্ম গ্রহণের জন্য দাওয়াত দিতে লাগলেন। তখন মালেক ইবনে নযর বলতে লাগল, তুমি নিজে বে-দ্বীন হয়ে গেছ আবার সন্তানকেও বে-দ্বীন হওয়ার জন্য দাওয়াত দিচ্ছ? তুমি তাকে নষ্ট করে দিচ্ছ? জবাবে উম্মে সুলাইম বললেন, তাকে নষ্ট করছি না বরং তাকে ঈমানের মত দৌলত গ্রহণ করার জন্য বলছি। এক দিকে স্বামী-স্ত্রীর এই দ্বন্দ্ব চলছে, অপরদিকে হযরত আনাস (রাযি.) মায়ের দাওয়াত কবুল করে ইসলামের সু-শীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে।

স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দাওয়াতঃ

হযরত উম্মে সুলাইম (রাযি.) নিজে মুসলমান হয়ে ছেলেকে মুসলমান বানিয়ে ক্ষাš হলেন না, বরং স্বামীকেও মুসলমান হওয়ার জন্য দাওয়াত দিতে লাগলেন এবং জোর প্রচেষ্টা চালাতে লাগলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, স্বামী মালেক ইবনে নযর দাওয়াত কবুল না করে রাগান্বিত হয়ে স্বদেশ ত্যাগ করে শাম দেশের দিকে চলে গেলেন এবং সেখানে কুফ্রী অবস্থায় মৃত্যুমুখে পতিত হন।

হযরত আবু ত্বালহা (রাযি.)এর প্রতি হযরত উম্মে সুলাইমের ইসলামের দাওয়াতঃ

হযরত উম্মে সুলাইম (রাযি.)এর স্বামী মৃত্যুর পর যখন হযরত আবু ত্বালহা (রাযি.) উম্মে সুলাইম (রাযি.)কে খিদবা (বিয়ের প্রস্তাব) দিলেন, তখন  তিনি মুসলমান হওয়ার শর্তে তাতে রাজি হন। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত আবু ত্বালহা একদিন প্রস্তাব নিয়ে উম্মে সুলাইমের নিকট উপস্থিত হন। তখন উম্মে সুলাইম আবু ত্বালহা (রাযি.)কে সম্বোধন করে বললেন, আবু ত্বালহা, তুমি তো ঐ মাবুদের পূজা কর যাকে অমুক গোত্রের নিকৃষ্ট গোলাম নিজ হাতে তৈরী করেছে। তুমি তার সামনে মাথা নত করছ। অথচ তাতে যদি আগুন লাগিয়ে দাও, তাহলে সেই আগুন তোমাকেও জ্বালিয়ে দিবে।

* একবার আবু ত্বালহাকে বলেন, তুমি কি এতটুকু জ্ঞান রাখ না যে, তুমি যেই মাবুদের উপাসনা করছ, তা একটি সাধারণ গাছ মাত্র, যা মাটি থেকে উঠেছে। আর তা অমুক হাবশি গোলাম নিজ হাতে তৈরী করে খোদা বানিয়েছে। এ সমস্ত কথা আবু ত্বালহার মনে নাড়া দিল এবং সে ইসলামের সত্যতা স্বীকার করে নিল।

* আরেক বার আবু ত্বালহাকে বললেন, তোমাদের কি লজ্জা হয় না, এই পবিত্র কপালকে একটি সাধারণ গাছের সামনে রাখছ? অথচ তা অমুক গোলামের হাতে তৈরী।

আরও পড়তে পারেন-

অতঃপর উম্মে সুলাইম আবু ত্বালহাকে বললেন, তুমি কি এটা মান যে, আমার মহর হবে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”। আমি এটা ছাড়া অন্য কিছু চাই না। তখন আবু ত্বালহা বললেন, আমাকে একটু চিন্তা করার সময় দাও। অতঃপর তিনি এসে ক্বালিমা পাঠ করে মুসলমান হয়ে গেলেন।

নাসায়ী শরীফে বর্ণিত আছে, উম্মে সুলাইম এই ভাবে দাওয়াত দিলেন- হে আবু ত্বালহা! আল্লাহর কসম, তোমার মত লোকের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু আমি মুসলমান আর তুমি কাফির। তাই তোমার সাথে বিবাহ সঙ্গতঃ নয়। অতএব, তুমি মুসলমান হয়ে যাও, তাহলে আমি তোমার সাথে শুধু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হব তা নয়, বরং তোমার ইসলাম গ্রহণ করাই হবে আমার মহর। এছাড়া তোমার কাছে আমার আর কোন দাবী থাকবে না। তখন আবু ত্বালহা (রাযি.) ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং বীরত্বের সাথে ইসলামের খেদমত করতে লাগলেন।

উম্মে হাকিম (রাযি.)এর নিজ স্বামীকে ইসলাম গ্রহণের জন্য প্রচেষ্টা চালানঃ

মক্কা বিজয়ের দিন উম্মে হাকিম (রাযি.) ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং তার স্বামী আকরামা ইবনে আবু যেহেল (যাকে পাওয়া মাত্র ক্বতলের হুকুম দেওয়া হয়েছিল)এর জন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে আমান (নিরাপত্তা সনদ) নিয়ে ইয়ামানের দিকে পলায়নরত স্বামীকে খুঁজে বের করে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে মক্কায় নিয়ে আসেন।

এক বর্ণনা মতে সে যখন পালিয়ে যাওয়ার জন্য জাহাযে উঠেছিল, তখন উম্মে হাকিম বাহির থেকে আওয়ায দিয়ে বললেন, হে চাচার বেটা! আমি এমন মানুষের কাছ থেকে এসেছি যিনি আত্মিয়তার বন্ধন রক্ষাকারী, যিনি সবচেয়ে উত্তম। তিনি তোমাকে ‘আমান’ বা নিরাপত্তা দিয়েছেন। সুতরাং ফিরে চল এবং নিজেকে নিজে ধ্বংস কর না। তুমি যদি ‘আমান’ গ্রহণ কর, তাহলে আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকবো, অন্যথায় তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক থাকবে না।

অন্য রেওয়াতে আছে, উম্মে হাকিম মুসলমান হওয়ার পর আকরামা উম্মে হাকীমকে রাত যাপনের আহ্বান জানালে তিনি এই বলে প্রত্যাখান করলেন, আমি মুসলমান আর তুমি কাফির। সুতরাং তোমার আমার মিলন হতে পারে না।

ভাতিজার প্রতি ফুফুর দাওয়াতঃ

ইমাম আহমাদ (রাহ.) আদী ইবনে হাতেম হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৈন্য বাহিনী একবার আমাদের গোত্রের উপর হামলা করেন। তখন আমি মদীনার একটি টিলার উপরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৈন্য বাহিনী যাদেরকে বন্দী করেন, তাদের মাঝে আমার ফুফুও ছিল। বন্দিরা যখন হুযূর (সা.)এর সামনে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়ালেন, তখন আমার ফুফু হুযূর (সা.)এর খেদমতে আরয করে বললেন, আমার হামর্দদ (আপন জন) চলে গেছে। আমি বৃদ্ধ, আমার উপর দয়া করুন।

হুযূর (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার আপন জন কে? বৃদ্ধা ফুফু বললেন, আদী ইবনে হাতেম। হুযূর! আমি বৃদ্ধ আমার খেদমত করার মত কেউ নেই। আমার উপর ইহ্সান করুন। আদী ইবনে হাতেম আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল থেকে পলায়ন করেছে। তখন আলী (রাযি.) পাশে বসা ছিলেন। তিনি বললেন, হে বৃদ্ধা! তুমি হুযূর (সা.)এর কাছ থেকে একটি সাওয়ারী চেয়ে নাও। তখন বৃদ্ধা হুযূর (সা.)এর কাছে সাওয়ারী চাইলে হুযূর (সা.) তাকে সাওয়ারী দান করলেন।

ফুফু হুযূরের দেয়া সাওয়ারিতে চড়ে আমার নিকট আসলেন এবং বলতে লাগলেন, হে আদী! তুমি এমন একটা কাজ করেছ, যা তোমার বাবা কোন দিন করতো না। হে আদী! তুমি হুযূর (সা.)এর দরবারে চল, যারা হুযূর (সা.)এর দরবারে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এসেছে, হুযূর (সা.) তাদেরকে ফিরিয়ে দেননি। হুযূর (সা.)এর নিকট অমুক গেছে, তাকে পুরস্কৃত করেছে। অমুক গেছে, তাকে অনেক ইকরাম করেছে। আদী বললেন, অতঃপর আমি হুযূর (সা.)এর দরবারে হাজির হলাম।

তখন হুযূর (সা.) আমাকে বলতে লাগলেন, হে আদী ইবনে হাতেম! তুমি কী কারণে পালিয়ে গেছ? তুমি কি কালিমা পড়ার ভয়ে চলে গেছ? আল্লাহু আকবার বলাটা কি তোমাকে পলায়ন করার জন্য বাধ্য করেছে? হে আদী! তুমিই বল আল্লাহ ছাড়া কি কোন মা’বুদ আছে? আদী ইবনে হাতিম বলেন, তখন আমি কালিমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলাম। হুযূর (সা.)এর চেহারা মোবারকে তখন হাসি ফুটে উঠেছে।

অতঃপর হুযূর (সা.) ইরশাদ করলেন, “আল্লাহর গযব ইয়াহুদীদের উপর, আর নাসারা হল পথভ্রষ্ট”। এভাবে হুযূর (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে হাজারো ঘটনা আছে। যাতে একথা প্রমাণিত হয় যে, মহিলারাও দ্বীনের প্রচার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন।

লেখকঃ বিশিষ্ট ইসলামী আইনবিদ, গবেষক, গ্রন্থ লেখক, মুহাদ্দিস এবং সহযোগী পরিচালক- দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকবেন।