Home মহিলাঙ্গন আমর বিল মা’রুফ নাহি আনিল মুনকার এবং দাওয়াত ও তাবলীগে নারীদের দায়িত্ব

আমর বিল মা’রুফ নাহি আনিল মুনকার এবং দাওয়াত ও তাবলীগে নারীদের দায়িত্ব

।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।

‘আমর বিল মারুফ নাহি আনিল মুনকার’ তথা- সৎ কাজের আদেশ দান এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান করা যেভাবে পুরুষদের উপর দায়িত্ব তেমনি নারীদের উপরও দায়িত্ব। কেননা কুরআন হাদীসে যে সমস্ত স্থানে আমর বিল মা’রুফ নাহি আনিল মুনকার বা দাওয়াতের জন্য যে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, মুফাস্সিরীন ও মুহাদ্দিসীনগণ লিখেন যে, ঐ সমস্ত স্থানে পুরুষ ও মহিলা প্রত্যেকেই অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু পুরুষদের দায়িত্ব বেশি এবং এবং মহিলাগণ পুরুষদের অধিনস্থ হওয়ায় পুরুষ বাচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন- ইবনে কাইউম আল-জাওযী (রাহ.) বলেন, শরীয়ত যে সমস্ত আহকামে পুরুষকে সম্বোধন করা হয়েছে, ঐ সমস্ত জায়গায় পুরুষ ও মহিলা উভয়কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। যেমন- আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেন, অর্থাৎ- যখন সাক্ষীদের সাক্ষ্য প্রদান করার জন্য ডাকা হয়, তখন সাক্ষীদের অস্বীকার করা উচিত নয়। (সূরা-বাকারা, আয়াত-২৮৩)।

এই আয়াতে পুরুষ মহিলা উভয়কে বলা হয়েছে। অন্য আয়াতে ইরশাদ করেন, অর্থাৎ- ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে। (বাকারা, আয়াত-১৮৩)।

এ আয়াতের মধ্যে যদিও পুরুষ বাচক শব্দ আনা হয়েছে, কিন্তু রোযা মহিলাদের উপরও ফরয। তাই আমর বিল মা’রুফ নাহি আনিল মুনকারের জন্য যে সমস্ত আয়াত বা হাদীসে পুরুষ বাচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে পুরুষ ও মহিলা উভয়ই অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া অনেক স্থানে আমর বিল মা’রুফ নাহি আনিল মুনকারের জন্য শুধু মহিলাদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে। যেমন- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, অর্থাৎ- হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পর পুরুষদের সাথে কোমল ও আকর্ষনীয় ভঙ্গীতে কথা বলো না। ফলে সেই ব্যক্তি কু-বাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। তোমরা সংযত কথাবার্তা বলবে। (আহ্যাব, আয়াত- ৩৩)।

উল্লেখ্য, আর এ কথা বলা ঠিক হবে না যে, উক্ত আয়াত শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবিগণের জন্য নির্ধারিত। বরং এই গুরুত্বপর্ণ হুকুম পর্দা করার জন্য সকল মহিলার ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য।

আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন, অর্থাৎ- আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথা শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে, নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন-যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তাআলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, সুকৌশলী। আল্লাহ ঈমানদার নারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কানন-কুঞ্জের, যার তলদেশে প্রবাহিত হয় প্রস্রবণ। তারা সেগুলোরই মাঝে থাকবে। আর এসব কানন কুঞ্জে থাকবে পরিচ্ছন্ন থাকার ঘর। বস্তুতঃ এ সমদয়ের মাঝে সব চেয়ে বড় হল আল্লাহ্র সন্তুষ্টি, এটিই হল মহান কৃতকার্যতা। (সূরা তাওবা, আয়াত- ৭১-৭২)।

উক্ত আয়াতে পাঁচটি গুণের কথা বলেছেন। তার মধ্যে একটি হলো, ‘আমর বিল মারুফ নাহি আনিল মুনকার’ আর ‘ওয়াল-মু’মিনাত’ শব্দের দ্বারা বুঝা যায়, মহিলাদের জন্যও সাধ্যানুযায়ী আমর বিল মা’রুফ নাহি আনিল মুনকার করা জরুরী।

* এক হাদীসে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তাদের অধিনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। আর মহিলাগণ স্বামীর ঘর ও সন্তানাদির জিম্মাদার। সুতরাং তাকে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। (বুখারী ও মুসলিম)।

* ইমাম শাতীবী (রাহ.) বলেন, উক্ত হাদীসে দায়িত্বশীল দ্বারা উদ্দেশ্য হল, নিজের অধিনস্থদের পর্ণ হিফাযত ও আমানতদারিতা ও সৎ কাজের আদেশ দেওয়া এবং নিজের অধিনস্থ জিনিসগুলোর খেয়ানত না করা এবং ধ্বংস থেকে রক্ষা করা।

* অন্য হাদীসে বর্ণিত আছে, ‘ওয়া হিয়া মাসউলাতুন’ অর্থাৎ- মহিলারাও একজন দায়িত্বশীল। উক্ত হাদীসসমহ দ্বারা বুঝা যায় যে, মহিলাদের জন্যও অধিনস্থদেরকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকার হুকুম করা ওয়াজিব।

মহিলাদের সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের কার্যকারিতা

১. বাড়িতে মায়ের সাথে সন্তানদের সম্পর্ক বাবার চাইতে অনেক বেশী।
২. স্বামীর নিকট স্ত্রীর কথা সবচেয়ে গ্রহণ যোগ্য।
৩. ভাইদের নিকট বোনদের আবদার বেশী চলে।
৪. ছেলের চেয়ে মেয়ের কথা বাবার কাছে গ্রহণযোগ্য বেশী।
৫. যেহেতু পুরুষরা বাইরে থাকে, মেয়েরা ঘরে থাকে, সুতরাং সন্তানদের সম্পর্ক মায়ের সাথেই বেশী।

* উল্লিখিত পারিবারিক ক্ষেত্রে মেয়েরা যদি সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করে, তাহলে তা কার্যকরী বেশী হবে।

স্বামীর নিকট স্ত্রীর কথার গ্রহণযোগ্যতা বেশী। ফিরআউনের মত শক্ত জালেমও নিজ স্ত্রীর ইচ্ছা পরণ করতে গিয়ে রাজত্ব হারিয়ে ধ্বংস হয়ে গেল। যেমন- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, অর্থাৎ- ফেরআউন যখন হযরত মসা (আঃ)কে হত্যা করতে চেয়েছিল, তখন তার স্ত্রী বলল, এই ছেলে আমার ও তোমার চোখের আরামদায়ক হবে, তাকে হত্যা করো না। সে হয়তো আমাদের উপকারে আসবে, অথবা আমরা তাকে ছেলে হিসেবে গ্রহণ করে নিব। তাই সে স্ত্রীর কথায় মসা (আ.)কে কোলে নিল এবং লালন-পালন শুরু করলো। যা পরবর্তীতে তার ধ্বংসের কারণ হল।

* আবু জেহেলের ছেলে ইকরামা (রাযি.) মুসলমান হয়েছিলেন তার স্ত্রীর দাওয়াতে।

বাপের নিকট মেয়ের আবদার

* পিতা কন্যার প্রতি অধিক স্নেহ-বৎসল হওয়ার কারণে মেয়ের আবদারকে অবজ্ঞা করতে পারেন না। তাই মেয়ে বাবাকে ‘আমর বিল মা’রুফ নাহি আনিল মুনকার’ করলে তা গ্রহণ যোগ্যতা বেশী পায়। যেমন, পিতা ও মেয়ের আদর বা মুহাব্বতের একটি ঘটনা-

যখন বদরের যুদ্ধে বন্দিদেরকে মুক্ত করার জন্য পরস্পরের আত্মীয়-স্বজনরা মুক্তিপণ নিয়ে আসল এবং নিজ নিজ বন্দিদেরকে নিয়ে যচ্ছিল, তখন হুযূরের কলিজার টুকরা হযরত জায়নাব (রাযি.) স্বামী আবুল আছ ইবনে রবী (যিনি তখনও মুসলমান হননি)কে মুক্ত করার জন্য মুক্তিপণ স্বরূপ নিজ গলার হার পঠিয়ে দিলেন। যা তার বিবাহের সময় খাদিজা (রাযি.) দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারটি দেখা মাত্র হযরত জায়নাব (রাযি.)এর কথা স্মরণ হয়ে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (নিজ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও) সাহাবাদেরকে বললেন, তোমরা যদি সংগত মনে কর, তাহলে জায়নাবের (রাযি.) বন্দিকে মুক্ত করে দাও এবং তার হারটিও তাকে ফিরিয়ে দাও। তখন সাহাবায়ে কিরাম স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক বাক্যে বললেন, হ্যাঁ, হুযূর! তা ফিরিয়ে দেয়া হোক।

* এমনি ভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মা ফাতিমা (রাযি.) সম্পর্কে বলেন, ফাতিমা আমার শরীরের একটি অংশ। যে তাকে নারায করল, সে যেন আমাকে নারায করলো। ফাতিমা (রাযি.) হুযূরের নিকট আসলে হুযূর দাঁড়িয়ে তার মাথায় চুমু খেতেন।

ভাইয়ের নিকট বোনের আবদার

ভাই বোনের মাঝে আন্তরিক সম্পর্ক থাকায় ভাই এর কাছে বোনের অনেক আবদার চলে। এ সম্পর্কে একটি ঘটনাঃ হযরত শীমা (রাযি.) যিনি হযরত হালিমা সা’দিয়া (রাযি.)এর কন্যা এবং নবীজির দুধ বোন ছিলেন। মুসলমানরা একবার বণী সা’দ গোত্রের উপর হামলা করেছিলেন, তখন কয়েদীদের মাঝে শীমা (রাযি.)ও ছিলেন। তিনি তখনও পর্যন্ত মুসলমান হননি। শীমা (রাযি.) সাহাবাদের বললেন, আমি তোমাদের সর্দারের (নবীর) দুধ বোন। তখন সাহাবায়ে কিরাম তাকে হুযূরের নিকট নিয়ে আসলেন। পরিচয়ের পর তাকে চিনতে পেরে দুধ বোনের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং তাকে মারহাবা বললেন। এমন কি নিজের চাদর মোবারক বিছিয়ে দিলেন। সাথে সাথে হুযূরের চোখের পানি ঝরতে লাগল এবং তিনি খুবই চিšিত হয়ে পড়লেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি যদি চাও তাহলে ইজ্জত ও একরামের সাথে আমাদের কাছে থাকতে পার। আর যদি তোমার গোত্রে ফিরে যেতে চাও, তাহলে যেতে পার। তখন সে নিজ গোত্রে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হাদিয়া তোহ্ফাসহ স্ব-সম্মানে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। দয়ার নবীর এই ব্যবহার দেখে মুসলমান হয়ে গেলেন তিনি। দেখুন! দয়ার নবী যদি দুধ বোনের সাথে এই আচারণ করেন, তাহলে প্রকৃত বোনের সাথে কিরূপ আচরণ করবেন। মোটকথা, মহিলারা যদি নিজ নিজ স্থানে সাধ্য মতে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বাধা প্রদান করেন, তার কার্যকারিতা পুরুষদের থেকে কোন দিক দিয়ে কম হবে না।

লেখকঃ বিশিষ্ট ইসলামী আইনবিদ, গবেষক, গ্রন্থ লেখক, মুহাদ্দিস এবং সহযোগী পরিচালক- দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকবেন।