শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত একজন মানুষের কথা চিন্তা করুন, চোখের সামনে ভেসে উঠবে এমন একজনের চেহারা যিনি কাজের চাপে এবং ঘরে-বাইরে শত রকম বিষয়ে মনোযোগ দিতে গিয়ে দম ফেলার অবসর পাচ্ছেন না, অন্যসব চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে নিজেই শূন্যতা অনুভব করছেন এবং হয়ে পড়েছেন ক্লান্ত-অবসন্ন।
বহু বছর ধরে মানুষ এটাই ভেবে এসেছে যে শুধুমাত্র অতিরিক্ত কাজের চাপে একজন মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, এটি ছাড়াও আরও নানাবিধ কারণ থাকতে পারে একজন ব্যক্তির ভেঙে পড়ার পেছনে। কর্মস্থলের পরিবেশ থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ কার্যপ্রণালী, কাজের প্রতি একজন ব্যক্তির অনুরাগ ও বিভিন্ন পরিবেশে খাপ খাইয়ের নেওয়ার ক্ষমতা- এই সবকিছু মিলিয়েই ব্যক্তির মধ্যে অনুপ্রেরণার অভাব দেখা দিতে পারে এবং তিনি পুরোপুরি উদ্যমহীন হয়ে উঠতে পারেন।
এক্সিকিউটিভ কোচ ও ‘ট্রাস্ট ইওরসেলফ: স্টপ ওভারথিংকিং অ্যান্ড চ্যানেল ইওর ইমোশন ফর সাকসেস অ্যাট ওয়ার্ক’ বইয়ের লেখিকা মেলোডি ওয়াইল্ডিং ৩ ধরনের পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে ধকল সইতে না পেরে ব্যক্তি শারীরিক-মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারেন।
১. অতিরিক্ত কাজের চাপ
কেন একজন ব্যক্তি সবকিছুর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, শূন্যতা অনুভব করেন এবং ক্লান্ত অনুভব করেন, এর পেছনে প্রথম কারণটিই হলো অতিরিক্ত কাজের চাপ। যখন আপনি পেশাদার ও ব্যক্তিগত জীবনে অনেককিছু অর্জনের চেষ্টা করবেন এবং নিজের শারীরিক-মানসিক অবস্থার দিকে গুরুত্ব না দিয়েই টানা কাজ করে যাবেন, তখন এক পর্যায়ে আপনার শরীর-মন আর কাজে সাড়া দিবে না। সে পর্যায়ে গিয়ে সবকিছুই অর্থহীন মনে হবে।
কর্মস্থলে যেসব কর্মী কাজের প্রতি অনেক বেশি অনুরক্ত এবং অবিশ্বাস্য গতিতে কাজ করে যান, তারা এই পরিস্থিতির শিকার হন সবচেয়ে বেশি। এ ধরনের মানুষেরা তাদের আবেগ- রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, হতাশা সবকিছু অন্যদের উপর ঢালতে চান। এই যেমন- তিনি কতটা চাপে আছেন তা নিয়ে ক্রমাগত অভিযোগ করে যাওয়া। এ ধরনের মানুষেরা দ্রুত কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আরও কাজ ও দায়িত্বের বোঝা নিজের ওপর চাপিয়ে নেন, যা তাদেরকে আরও দুশ্চিন্তার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
কিভাবে বুঝবেন আপনি এই অবস্থার মধ্যে আছেন? এমন পরিস্থিতিতে ব্যক্তি নিজের চাহিদার দিকে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেয়। ক্যারিয়ারে যতটুকু শ্রম দেওয়া যৌক্তিক, ব্যক্তি তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়ে ফেলে। ফলে লক্ষ্যের চূড়ায় পৌঁছাতে গিয়ে নিজের শরীর-স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে ফেলে।
এ অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কী?
গবেষকরা বলছেন, অতিরিক্ত কাজের চাপ থেকে ব্যক্তির মধ্যে যে ধ্বস নামে, তা থেকে বের হওয়ার জন্য দুটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। প্রথমত, নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা; দ্বিতীয়ত, নিজের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব না আনা। যেমন- আপনাকে বুঝতে হবে যে সারাক্ষণ কাজ করে গেলেই সফলতা পাওয়া যায় না, এর জন্য বিশেষ কৌশলও প্রয়োজন। তবে বিশ্রাম নেওয়া সফলতার পুরস্কার নয়, বরং ভবিষ্যতে নিজেকে আরো উন্নত করার জন্যই নিজের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
কাজের থেকে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের দূরত্ব বজায় রাখা আরও একটি ভালো উপায়। এর মাধ্যমে কাজের সঙ্গে সবকিছু জড়িয়ে ফেলা থেকে বিরত থাকা যায়। এছাড়াও, কাজের বাইরেও পুরো জগতটা ঘুরে দেখুন, নিজের জীবনে বৈচিত্র্যতা আনুন। পরিবার, ঘনিষ্ঠজনদের সময় দিন, তাদের নিয়েও সুন্দর সময় পার করার সুযোগ দিন নিজেকে। তবেই এই ক্লান্তি-বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
২. কর্মহীনতা
পাঠক শুনে অবাক হতে পারেন, কিন্তু নিজের যোগ্যতার তুলনায় খুব কম কাজ করা থেকেও ব্যক্তির মধ্যে শূন্যতা ও ক্লান্তি চলে আসতে পারে! যখন কেউ কর্মক্ষেত্রে সঠিকভাবে নিজের যোগ্যতা কাজে লাগাতে পারে না বা কাজে উৎসাহ খুঁজে পায় না বলে একঘেয়েমি চলে আসে, তখন এই পরিস্থিতি তৈরি হয়। এমতাবস্থায়, ব্যক্তি কাজের অনুপ্রেরণা পায় না এবং চ্যালেঞ্জ অনুভব করে না। যে পদে আছে সেখানে যদি নিজেকে প্রমাণের বা নেতৃত্ব প্রদানের সুযোগ কম থাকে, তখন তা ব্যক্তির মনে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি করে।
আরও পড়তে পারেন-
- কাবলাল জুমা: কিছু নিবেদন
- দারিদ্র বিমোচনে এনজিওদের থেকে কওমি মাদ্রাসার সফলতা বেশি!
- হজ্ব-ওমরায় গেলে আমরা সেখান থেকে কী নিয়ে ফিরব?
- সমাজে পিতা-মাতারা অবহেলিত কেন
- সংঘাতবিক্ষুব্ধ সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলামের সুমহান আদর্শ
কিন্তু এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায়ও রয়েছে। প্রথমত, নিজের কৌতূহল বাড়াতে হবে। নতুন নতুন দক্ষতা অর্জনের জন্য সময় নির্ধারণ করুন; সেমন- ৩০ দিনের চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন যে এই সময়ে আপনি একটি বিশেষ লক্ষ্য অর্জন করবেন। ছোট ছোট চ্যালেঞ্জ দিয়ে শুরু করুন এবং এখানেও চাপ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। যেমন- দৈনিক দুই ঘন্টা কোডিং এর কাজ শিখতে ব্যয় করতে পারেন কিংবা নতুন ভাষা শেখার পেছনে আধাঘন্টা সময় দিতে পারেন।
মজা করে শেখা যাবে এবং ক্যারিয়ারেও অর্থবহ হবে, এমন কাজ শিখতে পারেন। আপনার চাকরির সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত না হলেও, এসব দক্ষতা পরবর্তীতে ক্যারিয়ারে ইতিবাচক মাত্রা যোগ করতে পারে এবং নিজের কাছেও উৎফুল্ল লাগবে।
‘জব ক্রাফটিং’ আরও একটি বিশেষ উপায়, যার মাধ্যমে আপনি ধীরে ধীরে নিজের কাজের ধরন বদলে ফেলতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, সব কাজের উদ্যোগ একসাথে নেওয়া যাবে না। ছোট ছোট পদক্ষেপে এগোনোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৩. অবজ্ঞা অনুভব করা
কর্মক্ষেত্রে বা ব্যক্তিজীবনে যথাযথ গুরুত্ব না পাওয়া থেকে একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারেন। এর ফলে চ্যালেঞ্জের মুখে ব্যক্তি অসহায় অনুভব করেন এবং ভাবতে থাকেন যে তিনি আসলে যোগ্য নন। কর্মক্ষেত্রে উর্ধ্বতনদের কাছ থেকে সঠিক দিকনির্দেশনা না পেলে বা কাজের পরিসর সংক্ষিপ্ত করে দেওয়া হলে নিজেকে ছোট মনে হতে থাকে এবং ব্যক্তি হীনম্মন্যতায় ভোগে। দীর্ঘদিন যাবত এটি চলতে থাকলে একসময় ব্যক্তির মধ্যে সঞ্জীবনী শক্তি ও উদ্যম নষ্ট হয়ে যায় এবং সে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে।
এমন পরিস্থিতিতে থাকলে ব্যক্তির মনে হতে পারে যে তিনি কারো প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেন না এবং এই অক্ষমতা অনুভব থেকে দিন দিন হতাশার দিকে এগিয়ে যান। আশেপাশে মানুষ থাকা সত্ত্বেও যখন কঠিন পরিস্থিতিতে কোনো সাহায্য চেয়ে পান না, তখন অসহায় অনুভব হয়। মানুষ তাকে অবজ্ঞা করছে বা এড়িয়ে চলছে এমন অনুভূতি থেকে একসময় তিনি কোনো বিষয়ে চেষ্টা চালানোই বন্ধ করে দেন।
এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় হলো নিজের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং নিজস্ব বিশ্বাস নিয়ে কাজ করে যাওয়া। কী কী কাজ করবো না- তার একটি তালিকা করতে পারলে ভালো হয়। যেসব কাজে সবচেয়ে বিরক্তি আসে তা চিহ্নিত করে সেগুলো পুনঃমূল্যায়ন করা যেতে পারে।
আবার নিজের বসকে জিজ্ঞেস করতে পারেন যে আপনার কাজ তাকে সন্তুষ্ট করছে কিনা, কোনোকিছু পরিবর্তনের দরকার আছে কিনা। নিজে থেকে আগ্রহী হয়ে সৃজনশীল কাজের কথা বসকে জানান, যাতে তিনিও আপনার আগ্রহ দেখে খুশি হন এবং অনুপ্রেরণা দেন। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, কোন বিষয়গুলো আপনি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন সেদিকে নজর দেওয়া। অফিসের কাজের সময়ের বাইরে নিজের যত্ন নিন, রুটিন তৈরি করে দৈনিক জার্নালিং করতে পারেন কিংবা কোনো শখের কাজে সময় দিতে পারেন।
তবে প্রতিটি মানুষের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি আলাদা বলে তাদের দুশ্চিন্তার ধরন বা মানসিক অবস্থাও আলাদা হয়। একজন ব্যক্তি একই সাথে উপরে উল্লিখিত দুটি সমস্যায়ও পড়তে পারেন, আবার কেউবা একটি। নিজেকে আগে বুঝতে হবে যে আপনি কোন পরিস্থিতিতে আছেন এবং সে অনুযায়ী সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নিতে হবে।
সূত্র- টিবিএস।
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ