Home ফিকহ ও মাসায়েল প্রসঙ্গঃ আখেরী চাহার শোম্বা এবং সফর মাসের ভিত্তিহীন কতিপয় আমল

প্রসঙ্গঃ আখেরী চাহার শোম্বা এবং সফর মাসের ভিত্তিহীন কতিপয় আমল

।। আল্লামা মুফতি জসিম উদ্দিন ।।

শরীয়ত স্বীকৃত কোন সিদ্ধান্তকে ভুল বলা যতটা পাপ, নিজের তৈরি করা শরীয়ত বহির্ভূত কোন রীতিনীতিকে দ্বীন মনে করা ততটাই অপরাধ। মানুষের ধারণা ও মানসিক উদ্ভাবিত কাজের নাম ধর্ম নয়। বরং ঐশী বাণী কোরআন ও সারওয়ারে আলমের বাণী দ্বারা প্রমাণিত বিষয় সমূহ এবং যার উপর উম্মাহর ঐক্যমত রয়েছে এমন আমলের নামই ধর্ম।

মহানবী (সা.)এর প্রতি ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ,কিন্তু ভালোবাসা ও বিশ্বাসের আড়ালে মানব রচিত কোন আচার-অনুষ্ঠানকে ধর্মের মর্যাদা দেওয়া যায় না। পৃথিবীতে চলমান এই “সময়” মহান আল্লাহ তায়ালাই সৃষ্টি করেছেন এবং বিভিন্নভাবে সুবিন্যস্ত করেছেন। বছর, মাস, সপ্তাহ, দিন, রাত ইত্যাদি তিনিই সাজিয়েছেন। আর তিনিই আপন হিকমত ও কুদরত বলে বছরের কিছু মাস, মাসের কিছু দিন এবং দিনের কিছু অংশকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত করেছেন।

কোরআনুল কারীমের ভাষ্যমতে বছরের চারটি মাস অধিক সম্মানিত। আল্লাহ তাআলা বলেন-

إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِندَ اللّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَات وَالأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلاَ تَظْلِمُواْ فِيهِنَّ أَنفُسَكُمْ

অর্থাৎ- যেদিন আসমান জমিন সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই মাসসমূহের গণনা আল্লাহ তায়ালার নিকট তার বিধান মতে চারটি। তন্মধ্যে চারটি মাস অতি সম্মানিত। এটি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম অতএব এ মাস সমূহে তোমরা স্বীয় আত্নার উপর জুলুম করো না। (সূরা ত্বাওবা- ৩৬)।

উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা চন্দ্র বছরের মাসগুলোর সংখ্যা উল্লেখ করেছেন এবং উক্ত আয়াতে আরও বলেছেন- “ইসলাম একটি সরল দ্বীন, সুতরাং এই মাসগুলিতে  স্বীয় আত্মার প্রতি জুলুম করো না।” অর্থাৎ সারা বছর আল্লাহর দেওয়া পথে না চলে, বিভিন্ন কুসংস্কারের মধ্যে পড়ে নিজ আত্মাকে অত্যাচার না করা। সফর আল-মুজাফফর ইসলামি বছরের দ্বিতীয় মাস। কিছু কিছু মানুষকে বলতে শোনা যায় যে, এই মাসে অনেক বিপদ-আপদ অবতীর্ণ হয়। অথচ বাস্তবতা হলো শরীয়তে এর কোন ভিত্তি নেই। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “সংক্রমণ, অশুভ লক্ষণ এবং সফরের কুদৃষ্টি সবই মূর্খ চিন্তা, তবে তোমরা কুষ্ঠরোগীর কাছ থেকে পলায়ন কর যেমন সিংহ প্রাণী থেকে পালায়ন করে”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ২১৭৭)।

উল্লেখ্য, সফর মাসে বিশেষ কোন নামাজ বা রোজাও নেই। এ মাসের কোনো দিবসে বা রাত্রে কোনো প্রকার সালাত আদায়ের বিশেষ কোন ফযীলতে হাদীসে বর্ণিত হয়নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় তার সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। সমাজে এই মাসকে কেন্দ্র করে অনেক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা প্রচলিত রয়েছে। সেগুলোকে আমরা তিন ভাগে বিভক্ত করতে পারি। যথা-

প্রথমত: সফর মাসের ‘অশুভত্ব’ ও ‘বালা-মুসিবত’ বিষয়ক।
দ্বিতীয়: সফর মাসের প্রথম তারিখে বা অন্য সময়ে বিশেষ সালাত।
তৃতীয়: আখেরী চাহার শোম্বা বা সফর মাসের শেষ বুধবার বিষয়ক।

সফর মাসের অশুভত্ব ও এ মাসের বালা-মুসিবত

কোনো স্থান, সময়, বস্তু বা কর্মকে অশুভ,অমঙ্গলময় বলে মনে করা ইসলামী আক্বিদার ঘোর পরিপন্থী একটি কুসংস্কার। আরবের লোকেরা জাহেলী যুগ থেকে ‘সফর’ মাসকে অশুভ ও বিপদাপদের মাস বলে বিশ্বাস করত। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের এ কুসংস্কারের প্রতিবাদে বলেন- لا طيرة ولا هامة ولا صقر

অর্থাৎ- ইসলামে কোন অশুভ অযাত্রা নেই, কোন ভূত-প্রেত বা অতৃপ্ত আত্মা নেই এবং সফর মাসের অশুভত্বের কোন অস্তিত্ব নেই। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ২১৫৮)।

অথচ তারপরেও মুসলিম সমাজে অনেকের মধ্যে পূর্ববর্তী যুগের এ সকল কুসংস্কার রয়ে গেছে। এই সকল কুসংস্কারকে গুরুত্ব সহকারে আদায়ের জন্য অনেক বানোয়াট কথা হাদীসের নামে সমাজে প্রচার করেছে জালিয়াতগণ। এ সকল জাল কথার মধ্যে রয়েছে- এ মাস বালা মুসিবতের মাস। এ মাসে এতো লক্ষ এতো হাজার বালা নাযিল হয়। এ মাসেই আদম (আ.) নিষিদ্ধ ফল খেয়েছিলেন। এমাসেই হাবীল নিহত হন। এ মাসেই নূহে (আ.) এর কাওম ধ্বংস হয়। এ মাসেই ইবরাহীমকে (আঃ) আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। এ মাসের আগমনে রাসূলুল্লাহ (সা.) ব্যথিত হতেন এ মাস চলে গেলে তিনি খুশি হতেন। এবং তিনি নাকি বলতেন-

من بشرني بخروج صفر بشرته بالجنه ( بدخول الجنه)

অর্থাৎ- “যে ব্যক্তি আমাকে সফর মাস অতিবাহিত হওয়ার সুসংবাদ দিবে, আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশের সুসংবাদ দান করব” (রাহাতুল ক্বুলূব পৃ.১৩৮) ইত্যাদি অনেক কথাই তাঁরা বানিয়েছে। আর সরলপ্রাণ মুসলিম জন সাধারণ তাদের এ সকল জালিয়াতি বিশ্বাস করে বিভ্রান্তিতে পড়ছেন। অথচ সকল মুহাদ্দিসিনে কেরাম এ বিষয়ে একমত যে, সফর মাস সংক্রান্ত এসব কথা একেবারে ভিত্তিহীন ও হাদিসের নামে জালিয়াতি।

সফর মাসের প্রথম তারিখে বা অন্য সময়ে বিশেষ সালাত

উপরোক্ত তাদের মিথ্যা কথাগুলোঊর উপর ভিত্তি করে সমাজে একটি ভিত্তিহীন ‘সালাতের’ উদ্ভাবন হয়েছে। বলা হয়ে থাকে-  কেউ যদি সফর মাসের ১ম রাত্রিতে মাগরিবর বা এশারের পর নির্দিষ্ট কিছু সূরা দিয়ে চার রাক‘আত সালাত আদায় করে, তবে সে বিপদ থেকে রক্ষা পাবে, অমুক অমুক পুরস্কার পাবে ইত্যাদি। এগুলো সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা, যদিও অনেক সরলপ্রাণ বক্তা ও লিখক যাচাই-বাছাই না করেই তাদের বই বা ওয়াজে তা উল্লেখ করেছেন। (রাহাতুল কুলুক, পৃ,১৩৮-১৩৯, বারো চাঁদের ফযীলত পৃ.১৪)।

আখেরী চাহার শোম্বা বা সফর মাসের শেষ বুধবার

আখেরী চার শোম্বাঃ আখেরি চাহর শোম্বা মূলত আরবি ও ফার্সি ভাষার মিশ্রিত শব্দ। প্রথম শব্দ ‘আখেরি’ আরবি ও ফার্সিতে পাওয়া যায়। যার অর্থ হলো- শেষ। ফার্সি ‘চাহর’ শব্দের অর্থ হলো- সফর মাস এবং ফার্সি ‘শোম্বা’ শব্দের অর্থ হলো- বুধবার। অর্থাৎ ‘আখেরি চাহর সোম্বা’র অর্থ দাঁড়ায়- সফর মাসের শেষ বুধবার। দিনটিকে মুসলিম উম্মাহ খুশির দিন হিসেবে জানে এবং খুশির দিন হিসেবেই উদযাপন করে থাকে।

সাফরের শেষ বুধবারের কথা লোকদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, ঐ দিন মহানবী (সা.) রোগমুক্ত হয়ে গোসল করে মদীনার বাইরে চলে যান। এই সব কথা ভিত্তিহীন, এর কোন সত্যতা নেই। বহু মানুষ সফর মাসের শেষ বুধবারকে একটি বিশেষ দিবস হিসেবে পালন করে থাকে এবং এতে বিশেষ কোন আমল আছে বলে মনে করে। ‘মকসুদুল মোমিনীন’ ও ‘বার চান্দের ফযীলত’ এবং এ জাতীয় যেসব অনির্ভরযোগ্য পুস্তক-পুস্তিকা এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে প্রচলিত, তাতেই এই বিষয়টি রয়েছে।

মকছুদুল মুমিনীন ও বার চান্দের ফযীলত এবং এ জাতীয় অনির্ভরযোগ্য কিছু বইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী সফর মাসের শেষ বুধবারকে আখেরী চাহার শোম্বাহ বলে। তাঁদের ভাষ্যমতে রসূলুল্লাহ (সা.)জীবনের শেষ দিকে একবার এক ইহুদীর যাদুর কারণে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এই দিনে তিনি একটু সুস্থতা বোধ করেন এবং গোসল করে মসজিদে জামাতে শরিক হন।এতে খুশি হয়ে হযরত ওসমান রা. তাঁর নিজ খামারের ৭০টি উট যবাই করে গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। খুশিতে আত্মহারা সাহাবীগণ আনন্দ প্রকাশ ও শুকরিয়া আদায় করে নফল রোযা রেখেছিলেন এবং নফল নামায পড়েছিলেন। সুতরাং এটা মুসলমানদের জন্য একটি খুশির দিন এবং  উদযাপনের একটি দিবস।

আরও পড়তে পারেন-

এ ছাড়াও এজাতীয় বইগুলোতে এ দিনের বিভিন্ন করণীয় উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো একেবারেই ভভিত্তিহীন। তাতে আরো উল্লেখ আছে যে,বুধবার অশুভ এবং যে কোনো মাসের শেষ বুধবার সবচেয়ে অশুভ দিন। আর সফর মাস যেহেতু অশুভ, সেহেতু সফর মাসের শেষ বুধবার বছরের সবচেয়ে বেশি অশুভ দিন এবং এ দিনে সবচেয়ে বেশি বালা মুসিবত নাযিল হয়। এ সব ভিত্তিহীন কথাবার্তা অনেক সরলপ্রাণ মুসলমান বিশ্বাস করে থাকেন। যেমন- সফর মাসে একলাখ বিশ হাজার ‘বালা’ নাজিল হয় এবং সবদিনের চেয়ে ‘আখেরী চাহার শোম্বাতে (সফর মাসে শেষ বুধবার) নাজিল হয় সবচেয়ে বেশী। সুতরাং ঐ দিনে যে ব্যক্তি বিশেষ নিয়মে চার রাকাত নামায আদায় করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ঐ মসিবত থেকে রক্ষা করবেন এবং পরবর্তী বছর পর্যন্ত তাকে হেফাজতে রাখবেন। (রাহাতুল ক্বুলূব পৃ. ১৩৯)।

এগুলোর সবই ভিত্তিহীন এবং কোন সত্যতা নেই। কারণ-

(ক) হাদীস বিশারদ ও ইতিহাসবিদ কারো মতেই রাসূলের (সা.) এর সুস্থতার তারিখ সফরের আখেরী চাহার শোম্বা ছিল না। ( ফাতহুল বারী- ১০/২৩৭, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া- ২/১৫৪; শরহুয যুরকানী- ৯/৪৪৬-৪৪৭)।

(খ) জাদুর ঘটনা হাদীস ও সীরাত-গ্রন্থসমূহে বিস্তারিতভাবে এসেছে। কিন্তু কোথাও জামাতে শরীক হতে না পারা ও জাদুর প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার পর গোসলের কথা উল্লেখ নেই।

(গ) রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়েছে সোমবারে। এর চার-পাঁচদিন পূর্বে তাঁর সুস্থতার জন্য যে সাত কুঁয়া থেকে সাত মশক পানি আনা হয়েছিল এবং সুস্থতার জন্য তার দেহ মোবারককে ধৌত করা হয়েছিল তা কি বুধবারের ঘটনা না বৃহস্পতিবারের? ইবনে হাজার ও ইবনে কাছীর একে বৃহস্পতিবারের ঘটনা বলেছেন। (দ্র. ফাতহুল বারী- ৭/৭৪৮, কিতাবুল মাগাযী- ৪৪৪২; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ৪/১৯৩; সীরাতুন নবী, শিবলী নুমানী- ২/১১৩)।

(ঘ) যদি বুধবারের ঘটনা হয়ে থাকে তবে সফর মাসের শেষ বুধবার কীভাবে হচ্ছে? অথচ এসব কুসংস্কারের পৃষ্ঠপোষকতাকারীগণ সকলে ইন্তেকালের তারিখ বারো রবিউল আওয়াল বলে থাকেন। সোমবার যদি বারো রবিউল আওয়াল হয়ে থাকে তাহলে এর পূর্বের বুধবার তো সফর নয়, রবিউল আউয়ালই হচ্ছে।

(ঙ)  রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অনেক মুসিবত এসেছে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে নাজাত দিয়েছেন। তায়েফ ও অহুদে আহত হয়েছেন, আল্লাহ তাকে সুস্থ করেছেন। একবার ঘোড়া থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছেন, যার কারণে মসজিদে যেতে পারেননি, আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করেছেন। তাঁর সুস্থতা লাভের এই সব আনন্দের স্মৃতিগুলোতে কি দিবস উদযাপনের কোনো নিয়ম আছে? তাহলে আখেরী চাহার শোম্বাহ, যার কোনো ভিত্তি নেই, তা কীভাবে উদযাপনের বিষয় হতে পারে?

তবে আমাদের দেশে ‘আখেরী চাহার শোম্বার প্রসিদ্ধি এ কারণে নয়, অন্য কারণে। প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) সফর মাসের শেষ দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি সফর মাসের শেষ বুধবারে কিছুটা সুস্থ হন এবং গোসল করেন। এরপর তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এ অসুস্থতাতেই তিনি পরের মাসে ইন্তিকাল করেন। এজন্য মুসলিমগণ এ দিনে তাঁর সর্বশেষ সুস্থতা ও গোসলের স্মৃতি উদযাপন করেন।

এ বিষয়ে প্রচলিত কাহিনীর সার-সংক্ষেপ প্রচলিত একটি পুস্তক (বার চান্দের ফযীলত, ১৫ পৃষ্ঠা) থেকে উদ্ধৃত করছি- হযরত নবী করীম (সা.) দুনিয়া হইতে বিদায় নিবার পূর্ববর্তী সফর মাসের শেষ সপ্তাহে ভীষণভাবে রোগে আক্রান্ত হইয়া ছিলেন। অতঃপর তিনি এই মাসের শেষ বুধবার সুস্থ হইয়া গোসল করতঃ কিছু খানা খাইয়া মসজিদে নববীতে হাযির হইয়া নামাযের ইমামতী করিয়াছিলেন। ইহাতে উপস্থিত সাহাবীগণ অত্যধিক আনন্দিত হইয়াছিলেন। আর খুশীর কারণে অনেকে অনেক দান খয়রাত করিয়াছিলেন। বর্ণিত আছে, হযরত আবু বকর (রা) খুশীতে ৭ সহস্র দীনার এবং হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাযি.) ৫ সহস্র দীনার, হযরত ওসমান (রাযি.) ১০ সহস্র দীনার, হযরত আলী (রা) ৩ সহস্র দীনার এবং হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা) ১০০ উট ও ১০০ ঘোড়া আল্লাহর ওয়াস্তে দান করিয়াছিলেন। তারপর হইতে মুসলমানগণ সাহাবীগণের নীতি অনুকরণ ও অনুসরণ করিয়া আসিতেছে। হযরত নবী করীম (সা.)এর এই দিনের গোসলই জীবনের শেষ গোসল ছিল। ইহার পর আর তিনি জীবিতকালে গোসল করেন নাই। তাই সকল মুসলমানের জন্য এই দিবসে ওজু-গোসল করতঃ ইবাদাত বান্দেগী করা উচিৎ এবং হযরত নবী করীম (সা.)এর প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করতঃ সাওয়াব রেছানী করা কর্তব্য।

উপরের এ কাহিনীটিই কমবেশি সমাজে প্রচলিত ও বিভিন্ন অনির্ভরযোগ্য গ্রন্থে রয়েছে। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেও কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে এ ঘটনার কোনো প্রকারের উল্লেখ পাই নি। হাদীস তো দূরের কথা কোনো ইতিহাস বা সীরাত গ্রন্থেও এ ঘটনার কোনো উল্লেখ নেই। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোনো মুসলিম সমাজে ‘সফর মাসের শেষ বুধবার’ পালনের রেওয়াজ বা এ কাহিনী প্রচলিত আছে বলে আমাদের জানা নেই।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সর্বশেষ অসুস্থতা

রাসূলুল্লাহ (সা,) কোন মাসের কত তারিখ থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কারণ হিজরি দ্বিতীয় শতক থেক ঐতিহাসিকগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনের ঘটনাবলি ঐতিহাসিক দিন-তারিখ সহকারে সাজাতে চেষ্টা করেন। তাঁর অসুস্থতার শুরু সম্পর্কে অনেক মতভেদ রয়েছে।এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক (১৫১ হি/৭৬৮ খৃ) বলেন-

اُبْتُدِئَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ بِشَكْوَاهُ الَّذِيْ قَبَضَهُ اللهُ فِيْهِ … فِيْ لَيَالٍ بَقِيْنَ مِنْ صَفَرٍ، أَوْ فِيْ أَوَّلِ شَهْرِ رَبِيْعِ الأَوَّلِ

অর্থাৎ- ‘‘রাসূলুল্লাহ (সা.) যে অসুস্থতায় ইন্তিকাল করেন, সে অসুস্থতার শুরু হয়েছিল সফর মাসের শেষে কয়েক রথাকতে, অথবা রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে। (আস-সীরাহ আন-নববিয়্যাহ- ৪/২৮৯)।

কী বার থেকে তাঁর অসুস্থতার শুরু হয়েছিল, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ  বলেছেন শনিবার, কেউ বলেছেন বুধবার এবং কেউ বলেছেন সোমবার তার অসুস্থতার শুরু হয় (আল-মাওয়াহিব আল লদুনিন্নাহ, ৩/৩৭৩)।

কয়দিনের অসুস্থতার পরে তিনি ইন্তিকাল করেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, ১০ দিন, কেউ বলেছেন, ১২ দিন, কেউ বলেছেন ১৩ দিন, কেউ বলেছেন, ১৪ দিন অসুস্থ থাকার পরে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইন্তিকাল করেন। (শরহুল মাওয়াহিব লিযযারকানী, ১৩/৮৩)।

তিনি কোন তারিখে ইন্তিকাল করেছিলেন, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন ১লা রবিউল আউয়াল, কেউ বলেছেন, ২রা রবিউল আউয়াল এবং কেউ বলেছেন, ১২ই রবিউল আউয়াল তিনি ইন্তিকাল করেছেন। সর্বাবস্থায়, কেউ কোনোভাবেই উল্লেখ করেননি যে,অসুস্থতা শুরু হওয়ার পর মৃত্যুর পূর্বে তিনি সুস্থ হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থাতেই, ইন্তিকালের কয়েকদিন আগে তিনি গোসল করেছিলেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। বুখারী সংকলিত হাদীসে আয়েশা (রা) বলেন-

إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ لَمَّا دَخَلَ بَيْتِي وَاشْتَدَّ بِهِ وَجَعُهُ قَالَ هَرِيقُوا عَلَيَّ مِنْ سَبْعِ قِرَبٍ … لَعَلِّي أَعْهَدُ إِلَى النَّاسِ (لَعَلِّى أَسْتَرِيحُ فَأَعْهَدُ إِلَى النَّاسِ) … ثُمَّ خَرَجَ إِلَى النَّاسِ ، فَصَلَّى لَهُمْ وَخَطَبَهُمْ

অর্থাৎ- রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন আমার ঘরে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেল, তখন তিনি বললেন, তোমরা আমার শরীরের উপরে সাত মশক পানি ঢাল,যেন আমি আরাম বোধ করে লোকদের নির্দেশনা দিতেপারি। তখন আমরা এভাবে তাঁর দেহে পানি ঢাললাম। এরপর তিনি মানুষদের কাছে বেরিয়ে যেয়ে তাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করলেন এবং তাদেরকে খুতবা প্রদান করলেন এবং উপদেশ প্রদান করলেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ২১৬৯)।

এখানে সুস্পষ্ট যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর অসুস্থতার মধ্যেই অসুস্থতা ও জ্বরের প্রকোপ কমানোর জন্য এভাবে গোসল করেন, যেন কিছুটা আরাম বোধ করেন এবং মসজিদে যেয়ে সবাইকে প্রয়োজনীয় নসীহত করতে পারেন। এ গোসল করার ঘটনাটি কত তারিখে বা কী বারে ঘটেছিল তা হাদীসের কোনো বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় নি। তবে আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অন্যান্য হাদীসের সাথে এ হাদীসের সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে, এ গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ইন্তিকালের আগের বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ ইন্তেকালের ৫ দিন আগে। (ফতহুল বারী- ৮/১৪২ পৃষ্ঠা)।

১২ই রবিউল আউয়াল রাসূলের ইন্তিকাল হলে তা ঘটেছিল ৮ই রবিউল আউয়াল। উপরের আলোচনা থেকে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, সফর মাসের শেষ বুধবারে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সুস্থ হওয়া, গোসল করা এবং এজন্য সাহাবীগণের আনন্দিত হওয়া ও দান-সাদকা করা এ সকল কাহিনীর কোনোরূপ ভিত্তি নেই।

যেহেতু মূল ঘটনাটিই প্রমাণিত নয়, সেহেতু সে ঘটনা উদযাপন করা বা পালন করার প্রশ্নই ওঠে না। এরপরেও আমাদের বুঝতে হবে যে, কোনো আনন্দের বা দুঃখের ঘটনায় আনন্দিত বা দুঃখিত হওয়া এক কথা, আর প্রতি বছর সে দিনে আনন্দ বা দুঃখ প্রকাশ কর ভিন্ন কথা। উভয়ের মধ্যে আসমান-যমীনের পার্থক্য।

রাসূলুল্লাহর (সা.) জীবনে অনেক আনন্দের দিন বা মুহূর্ত এসেছে, যখন তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন, শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য আল্লাহর দরবারে সাজদা করেছেন। কোনো কোনো ঘটনায় তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণও আনন্দিত হয়েছেন ও বিভিন্নভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পরের বছর বা পরবর্তী কোনো সময়ে সে দিন বা মুহূর্তকে তারা বাৎসরিক ‘আনন্দ দিবস’ হিসেবে উদযাপন করেন নি। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)এর নির্দেশ বা সাহাবীদের কর্ম ছাড়া এরূপ কোনো দিন বা মুহুর্ত পালন করা বা এগুলোতে বিশেষ ইবাদত বিশেষ সাওয়াবের কারণ বলে মনে করার সুযোগ নেই।

উপরের আলোচনা থেকে আমার জানতে পেরেছি যে, সফর মাসের শেষ বুধবারের কোনো প্রকার বিশেষত্ব হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এ দিনে কোনোরূপ ইবাদত, সালাত, সিয়াম, যিকির, দোয়া, দান, সদকা ইত্যাদি পালন করলে অন্য কোনো দিনের চেযে বিশেষ কোনো সাওয়াব বা বরকত লাভ করা যাবে বলে ধারণা করা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। এজন্য আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী(রহ.) তার ঐতিহাসিক আল-আসার গ্রন্থের ১১১নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, সফর মাসের শেষ বুধবারে যে বিশেষ নফল সালাত বিশেষ কিছু সুরা, আয়াত ও দোয়া পাঠের মাধ্যমে আদায় করা হয়, তা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।

সুতরাং সফর মাসের বিশেষ কোনো ঘটনা বা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে পক্ষ-বিপক্ষ মতভেদ না করাই উত্তম। হাদিসের অনুসরণ ও অনুকরণে নেক আমল ও ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেদের নিয়োজিত করলেই মিলবে অনেক সাওয়াব।

তাছাড়া প্রত্যেক আরবি মাসেই রয়েছে সুন্নাত ইবাদতের দিকনির্দেশনা। সাথে সাথে সাপ্তাহিক ইবাদতেরও দিকনির্দেশনা রয়েছে। যা পালনে রয়েছে অনেক মর্যাদা ও সাওয়াব। যেমন-

প্রত্যেক সপ্তাহে জুমআর দিনের ইবাদত। সোম ও বৃহস্পতিবারে রোজা পালন। আবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিয়মিত আমল ছিল প্রত্যেক আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে নফল রোজা রাখা। যাকে আইয়ামে বিজের রোজা বলা হয় ইত্যাদি।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নেক আমলের প্রতি মনোযোগী হওয়ার পাশাপাশি সমস্ত কুসংস্কার থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: মুফতি, মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও সহযোগী পরিচালক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম এবং প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব- নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ড চাট্টগ্রাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।