Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন হজ্ব-ওমরায় গেলে আমরা সেখান থেকে কী নিয়ে ফিরব?

হজ্ব-ওমরায় গেলে আমরা সেখান থেকে কী নিয়ে ফিরব?

।। মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ।।

কদিন আগে আমার সন্তানদের সাথে আমি আলোচনা করছিলাম-হজ্ব-ওমরায় গেলে আমরা সেখান থেকে কী নিয়ে ফিরব? অনেক বন্ধুও মাঝেমধ্যে এ ধরনের প্রশ্ন করে থাকেন। তাই মনে হল, কিছু প্রয়োজনীয় কথাসহ এবিষয়ের উপর আলোচনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরি।

আবদ ও আবিদ হয়ে ফিরে আসা

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, এই সফরের মাধ্যমে আল্লাহ রাববুল আলামীনের কোনো না কোনো ইবাদত আদায় হয়ে থাকে। চাই তা ফরয, সুন্নত কিংবা নফল ইবাদতই হোক না কেন। তাই একজন মুমিনের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য ও আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে যে, সে আল্লাহর ঘর থেকে আল্লাহ তাআলার ইবাদতগোযার বান্দা হয়ে ফিরে আসবে!

آَئِبُوْنَ تَائِبُوْنَ لِرَبِّنَا حَامِدُوْنَ

অর্থ- হে আল্লাহ! আপনার হামদ ও শোকর আদায় করতে করতে পুনরায় আপনার দরবারেই আমরা ফিরে আসছি।

আমি সন্তানদেরকে এবং বন্ধুদেরকেও বলেছি যে, হজ্ব ও ওমরা শেষে সঙ্গে করে কী আনবেন-তা জানতে হলে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করুন, হাদীস ও সীরাতের কিতাব থেকে হজ্বের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট অধ্যয়ন করুন, আকাবিরের হজ্বের ঘটনাবলি পাঠ করুন। বাইতুল্লাহ এবং হজ্বের অন্যান্য শাআয়ের ও মাশায়ের যে সকল মহাপুরুষের ত্যাগ ও কুরবানীর সাক্ষ্য বহন করছে, কুরআন মজীদে তাঁদের অবস্থা ও বৈশিষ্ট্যাবলি পড়তে থাকুন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হজ্বের বিবরণ পাঠ করুন, তাঁর সাথে যাঁরা হজ্ব করেছেন তাঁদের ঘটনাবলি জানুন। তাহলে ইনশাআল্লাহ সহজেই বুঝতে পারবেন, হজ্বের শিক্ষা কী এবং সেখান থেকে কী আনতে হবে। এই নিবন্ধে শুধু কিছু মৌলিক শিক্ষার দিকে ইঙ্গিত করা হল।

১. তাওহীদ ও ঈামন-ইয়াকীন

তাওহীদের পূর্ণতা ও ঈমান-ইয়াকীনের দৃঢ়তা হজ্বের প্রথম ও চূড়ান্ত শিক্ষা। লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক … থেকে শুরু করে বিদায় তাওয়াফ পর্যন্ত হজ্বের প্রতিটি আমল এ সাক্ষ্যেরই মূর্ত রূপ যে, আমাদের তাওহীদ শুধু বিশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং আকীদা ও বিশ্বাসের সীমা অতিক্রম করে তা আমাদের কর্ম ও আচরণে, আমাদের চরিত্র, ব্যবহার ও চালচলনে মিশে গিয়েছে।

কাবার নির্মাতা, তাওহীদের ইমামের আচরণ-উচ্চারণ তো এই ছিল-

إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ

(তরজমা) আমি সম্পূর্ণ একনিষ্ঠভাবে সেই সত্তার দিকে নিজের মুখ ফেরালাম, যিনি আকাশমন্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি শিরককারীদের অন্তর্ভুক্ত নই। (সূরা আনআম- ৭৯ আয়াত)। তদ্রূপ-

إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ! لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ

(তরজমা) বলে দাও, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার ইবাদত, আমার জীবন, আমার মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক …। (সূরা আনআম, ১৬২-১৬৩ আয়াত)।

তাওহীদ পূর্ণ হয় মূলত আল্লাহ রাববুল আলামীনের মুহাববতের পরিপূর্ণতা ও নিসবতে ইহসান অর্জনের মাধ্যমে। আর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো হজ্ব ও ওমরায় এই দুটি জিনিসেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

ঈমান ও ইয়াকীন মজবুত করার জন্য হারামের সীমানায় প্রবেশ করার সময় হাজেরা রা.-এর ইয়াকীনপূর্ণ ঐ বাক্য স্মরণ করাই যথেষ্ট, যা তাঁর পাক যবানে উচ্চারিত হয়েছিল এক কঠিন মুহূর্তে। ইবরাহীম আ. যখন তাঁকে ও তাঁর দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈলকে তৃণলতাহীন, জনমানবশূন্য মরুপ্রান্তরে উপায়-উপকরণহীন নিঃস্ব অবস্থায় রেখে যাচ্ছিলেন তখন হাজেরা রা. একথা জানতে পেরে যে, আল্লাহ তাআলার নির্দেশেই তিনি এমনটি করছেন, অত্যন্ত নিশ্চিন্ত মনে দৃঢ়তাপূর্ণ ঐতিহাসিক বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন- اِذًا لَا يُضَيِّعُنَا (আল্লাহ তাআলাই আমাদের অভিভাবক)। সুতরাং তিনি আমাদের ধ্বংস করবেন না। (আসসুনানুল কুবরা, নাসায়ী, হাদীস- ৮৩২০; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস- ৪০৬৪)।

২. আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ

মুমিনের বৈশিষ্ট্যই হল আনুগত্য ও সমর্পণ। এজন্যই তার অপর নাম মুসলিম। হজ্বের বিধিবিধানই এমন যে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো আমলে এই সমপর্ণেরই অনুশীলন চলে। উপরন্তু কোনো হজ্ব বা ওমরাকারী যদি কাবাগৃহের নির্মাতা ইবরাহীম ও ইসমাইল আ.-এর অবস্থা স্মরণ রাখেন তাহলে তিনি হজ্ব থেকে আনুগত্য ও সমর্পণের শিক্ষা গ্রহণ না করে ফিরতে পারেন না।

إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ ! وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ

(তরজমা) যে ব্যক্তি নিজেকে নির্বোধ সাব্যস্ত করেছে, সে ছাড়া আর কে ইবরাহীমের পথ পরিহার করে? বাস্তবতা তো এই যে, আমি দুনিয়ায় তাকে (নিজের জন্য) বেছে নিয়েছি আর আখিরাতে সে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে। যখন তাঁর প্রতিপালক তাঁকে বললেন, ‘আনুগত্যে নতশির হও’, তখন সে (সঙ্গে সঙ্গে) বলল, আমি রাববুল আলামীনের (প্রতিটি হুকুমের) সামনে মাথা নত করলাম। (সূরা বাকারা- ১৩০-১৩২ আয়াত)।

পিতা-পুত্রের কুরবানী, আসমানী মহাপরীক্ষা এবং তাঁদের সফলতার বিবরণ-

رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ ! فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ ! فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ ! فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ ! وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ ! قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ ! إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ ! وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ ! وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآَخِرِينَ ! سَلَامٌ عَلَى إِبْرَاهِيمَ ! كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ ! إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِينَ

(তরজমা) ইবরাহীম বলল, আমি আমার প্রতিপালকের কাছে যাচ্ছি।তিনিই আমাকে পথ দেখাবেন। হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এমন পুত্র দান কর, যে হবে সৎ লোকদের একজন। সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতপর সে পুত্র যখন ইবরাহীমের সাথে চলাফেরা করার উপযুক্ত হল, তখন সে বলল, বাছা! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যবেহ করছি। এবার চিন্তা করে বল, তোমার অভিমত কী? পুত্র বলল, আববাজী! আপনাকে যার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে আপনি সেটাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে সবরকারীদের একজন পাবেন। সুতরাং (সেটা ছিল এক বিস্ময়কর দৃশ্য) যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিল। আর আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। নিশ্চয়ই আমি সৎকর্মশীলদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। এবং আমি এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে সে শিশুকে মুক্ত করলাম। এবং যারা তার পরবর্তীকালে এসেছে তাদের মধ্যে এই ঐতিহ্য চালু করেছি যে, (তারা বলবে) সালাম হোক ইবরাহীমের প্রতি, আমি সৎকর্মশীলদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই সে আমার মুমিন বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। (সূরা সাফফাত, ৯৯-১১১ আয়াত)।

৩. ধৈর্য্য, অবিচলতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা

শুধু ইসমাঈল আ.-এর কুরবানী ও সম্পর্কের ঘটনা থেকেই ধৈর্য্য ও অবিচলতা এবং ত্যাগ ও আত্মত্যাগের শিক্ষা লাভ করা সম্ভব। তিনি বলেছিলেন- يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ (তরজমা) আববাজী! আপনাকে যা নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে আপনি সেটাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে সবরকারীদের একজন পাবেন। (সূরা সাফফাত, ১০২ আয়াত)।

৪. আল্লাহর ফয়সালায় আস্থা ও সন্তুষ্ট থাকা

আল্লাহ তাআলার যে কোনো ফয়সালার প্রতি আন্তরিকভাবে সন্তুষ্ট থাকা হচ্ছে তাওহীদের অনেক বড় একটি শাখা। আল্লাহ তাআলাকে যে চিনতে পেরেছে, আল্লাহর প্রতি যার ভালবাসা আছে এবং যার মাঝে এই অনুভূতি আছে যে, আল্লাহও তাকে ভালবাসেন, তার মাঝে কি ‘রিযা বিলকাযা’র (আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা) গুণ না থেকে পারে?!

অথচ বাস্তবতা এই যে, আমার মতো দুর্বল ঈমানদার অসংখ্য মানুষ এই দৌলত থেকে বঞ্চিত। তারা যদি মক্কা ও মদীনায় ইবরাহীম আ., ইসমাঈল আ. ও হাজেরা রা. এবং সাইয়্যেদুল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মোবারক সীরাতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি পুনরায় স্মরণ করেন তাহলে তার মাঝেও ‘রিযা বিলকাযা’র গুণ উজ্জীবিত না হয়ে পারে না।

৫. বাইতুল্লাহর হেদায়েত ও বরকতসমূহ

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِلْعَالَمِينَ ! فِيهِ آَيَاتٌ بَيِّنَاتٌ مَقَامُ إِبْرَاهِيمَ وَمَنْ دَخَلَهُ كَانَ آَمِنًا وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ

(তরজমা) বাস্তবতা এই যে, মানুষের (ইবাদতের) জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর তৈরি করা হয়, নিশ্চয়ই তা সেটি, যা মক্কায় অবস্থিত, (এবং) তৈরির সময় থেকেই সেটি বরকতময় এবং সমগ্র জগতের মানুষের জন্য হিদায়াতের উপায়। (সূরা আল ইমরান, ৯৬-৯৭ আয়াত)।

কেউ বাইতুল্লাহর হজ্ব করল অথচ বাইতুল্লাহ যেসব হেদায়েত ও বরকতের কেন্দ্র তা নিয়ে আসতে পারল না তাহলে তার হজ্ব কেমন হজ্ব হল? বাইতুল্লাহর প্রধান হেদায়েত হল তাওহীদ ও একতা।আর তার প্রধান বরকত সম্ভবত শান্তি ও আমানতদারী রক্ষা।

ইসলামের ভিত্তিই হল তাওহীদ ও একতার ওপর। আর ঈমানের মৌলিক শিক্ষা হল শান্তি বজায় রাখা ও আমানতদারী রক্ষা করা। আল্লাহ তাআলা যাকে নিজ চোখে তাওহীদ ও নিরাপত্তার মূলকেন্দ্র দেখিয়েছেন এবং হজ্বের পূর্ণ সময় বিশেষত আরাফার দিনে ও আরাফার ময়দানে জাতি-বর্ণ, ভাষা-ভূমি, মত ও পথের সকল ভেদাভেদ ভুলে এক পোশাকে ও এক ভাষায় সকল মুমিনকে ‘লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক … ধ্বনিতে মুখর হওয়ার দৃশ্য অবলোকন করিয়েছেন। সে যদি তাওহীদ ও ইত্তেহাদ এবং আমন ও আমানতের সবক না নিয়েই ফিরে আসে তাহলে সে নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করল।

৬. আল্লাহর শাআয়েরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি

সূরা হজ্বে আল্লাহ তাআলা হজ্বের আহকাম ও বিধান বর্ণনা করে ইরশাদ করেছেন- ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللَّهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ عِنْدَ رَبِّهِ (তরজমা) এসব কথা স্মরণ রেখ। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ যেসব জিনিসকে মর্যাদা দিয়েছেন তার মর্যাদা রক্ষা করবে, তার জন্য এ কাজ অতি উত্তম তার প্রতিপালকের কাছে। (সূরা হজ্ব, ৩০ আয়াত)।

অন্যত্র ইরশাদ করেন- ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ (তরজমা) এসব বিষয় স্মরণ রেখ। আর কেউ আল্লাহর শাআয়েরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে এটা তো অন্তরস্থ তাকওয়া থেকেই উৎসারিত। (হজ্ব- ৩২)।

শাআয়ের বলা হয় এমন সকল কথা ও কাজ এবং এমন সকল স্থান ও সময়কে, যা আল্লাহ তাআলা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য নিদর্শন বা প্রতীক নির্ধারণ করেছেন। এগুলো মূলত আল্লাহ তাআলার কুদরত ও রহমতের নিদর্শন এবং ইসলামের প্রতীক। ইসলামের অনেক প্রতীক রয়েছে। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য হল চারটি। যথা- ক. কালামুল্লাহ (কুরআন মজীদ) খ. বাইতুল্লাহ ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ (যেমন-হারামের ভূমি, সাফা-মারওয়া, মীনা-মুযদালিফা, আরাফা ইত্যাদি)। গ. রাসূলুল্লাহ; আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ঘ. আল্লাহ তাআলার সকল ইবাদত-বন্দেগী। বিশেষত কালিমা, নামায, যাকাত, সওম, হজ্ব ইত্যাদি।

আরও পড়তে পারেন-

শাআয়েরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন হল ঈমান। আর ইসলামের কোনো শিআরের সামান্যতম অবমাননা হচ্ছে কুফর। আল্লাহ তাআলা যাকে শাআয়েরে মুকাদ্দাসা যিয়ারতের তাওফীক দিয়েছেন, নিজ চোখে বাইতুল্লাহ দেখিয়েছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মসজিদ ও রওযাতুল জান্নাহ যিয়ারত করিয়েছেন, তাঁর নিকটে দাঁড়িয়ে দরূদ ও সালামের নজরানা পেশ করার তাওফীক দিয়েছেন, তার মধ্যে তো শাআয়েরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি অন্যান্য মুসলমানের তুলনায় অনেক বেশি থাকা উচিত। তার ঈমান তো এত দৃঢ় ও আপোষহীন হওয়া উচিত যে, ইসলাম ও ইসলামের শিক্ষা এবং ইসলামের কোনো সম্মানিত ব্যক্তি বা সম্মানিত কোনো বস্ত্তর সামান্য অবমাননাও তার কাছে বরদাশতযোগ্য হবে না।

কোনো দেশের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী ব্যক্তিরা যখন হজ্ব ও ওমরার সৌভাগ্য লাভ করেন তখন আমরা তাদের নিকট এতটুকু ঈমানী গায়রত আশা করতে পারি যে, তারা নিজ দেশে এমন কোনো ব্যক্তিকে বরদাশত করবে না, যে ইসলামের কোনো শিআরের অবমাননা করে।তাদের কর্তব্য, এসব অবমাননাকারীর উপর ইরতিদাদের শাস্তি কার্যকর করে নিজেদের ঈমানী গায়রতের প্রমাণ দেওয়া।

৭. পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা

বাহ্যিক পরিপাটিতা ও আভ্যন্তরীণ পবিত্রতা এবং পরিচ্ছন্নতা ও নিয়মানুবর্তিতা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বাইতুল্লাহর হজ্বকারীগণ যখন বাইতুল্লাহর নির্মাতাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার ঘোষণা শোনেন যে-

وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ

(তরজমা) এবং আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে গুরুত্ব দিয়ে বলি যে, তোমরা উভয়ে আমার ঘরকে সেই সকল লোকের জন্য পবিত্র কর, যারা (এখানে) তাওয়াফ করবে, ইতিকাফে বসবে এবং রুকু ও সিজদা আদায় করবে। (সূরা বাকারা, ১২৫ আয়াত)।

وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَنْ لَا تُشْرِكْ بِي شَيْئًا وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ

(তরজমা) এবং সেই সময়কে স্মরণ কর, যখন আমি ইবরাহীমকে সেই ঘর (অর্থাৎ কাবাগৃহ)-এর স্থান জানিয়ে দিয়েছিলাম। (এবং তাকে হুকুম দিয়েছিলাম) আমার সাথে কাউকে শরীক করো না এবং আমার ঘরকে সেই সকল লোকের জন্য পবিত্র রেখ, যারা (এখানে) তাওয়াফ করে, ইবাদতের জন্য দাঁড়ায় এবং রুকু-সিজদা আদায় করে। (সূরা হজ্ব, ২৬ আয়াত)।

তখন অবশ্যই তার মাঝে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার আগ্রহ সৃষ্টি হবে। সুতরাং যে মসজিদের কোনো মুসল্লী হজ্ব করেছেন, যে মসজিদের পরিচালনা কমিটির কোনো সদস্য হজ্ব করেছেন সে মসজিদে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি কি অবহেলিত থাকতে পারে? সে মসজিদের অযুখানা-টয়লেট কি নোংরা থাকতে পারে?!

আর বাইতুল্লাহ তো শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতারই শিক্ষা দেয় না; পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও নিয়ম-শৃঙ্খলার পাশাপাশি বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ পবিত্রতারও শিক্ষা দেয়। সুতরাং হজ্ব ও ওমরার সৌভাগ্য যার হয়েছে তার অন্তঃকরণ হবে পবিত্র, আচার ও আচরণ হবে মার্জিত, ভাষা ও উচ্চারণ হবে ভদ্র ও শীলিত এবং তার পোশাক ও বেশভূষা হবে পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন।

সবচেয়ে বড় পবিত্রতা জীবিকা হালাল হওয়া

একথাও মনে রাখা জরুরি যে, ঈমানের পর সবচেয়ে বড় পবিত্রতা হল জীবিকা হালাল হওয়া। আয়-উপার্জনে হালাল-হারাম বেছে চলা। জীবিকা হালাল না হওয়ার অপবিত্রতা এমন যে, অযু-গোসল দ্বারা যতই পবিত্র করার চেষ্টা করা হোক তা পবিত্র হয় না। এ থেকে পবিত্রতা লাভের একমাত্র উপায় হল খাঁটি দিলে তওবা করা এবং হারাম উপার্জন ত্যাগ করে হালাল পন্থা অবলম্বন করা। পাশাপাশি যেসব মানুষের হক নষ্ট করা হয়েছে তা ফিরিয়ে দেওয়া। উপার্জন যতক্ষণ পবিত্র না হবে ততক্ষণ দুআ ও ইবাদত কবুল হবে না। তবে এ অবস্থায় ইবাদত-বন্দেগী ত্যাগ করবে না। কারণ এতে গুনাহ আরো বেশি হবে; বরং ইবাদতকে পরিশুদ্ধ ও কবুল করানোর সকল চেষ্টা অব্যাহত রাখবে।

উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারাম বেছে চলার মনোভাব সৃষ্টি বাইতুল্লাহর সফরের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা মক্কার মুশরিকরাও তো কাফের-মুশরিক হয়েও বাইতুল্লাহ নির্মাণের সময় এই প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, এর নির্মাণে কোনো হারাম অর্থ মিলিত করবে না।আর এ কারণেই অর্থের অভাবে হাতীমের অংশটুকু তাদের পক্ষে নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি।-সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ

মুশরিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে- إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا অর্থ : আল্লাহ তাআলা পবিত্র; আর শুধু পবিত্র বস্ত্তই তিনি কবুল করে থাকেন।

৮. পিতা-মাতার আনুগত্য

হজ্বের সৌভাগ্য যেসব সন্তানের হয়েছে তারা যদি হযরত ইসমাঈল আ.-এর দৃষ্টান্ত থেকে পিতামাতার আনুগত্যের শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারে তবে আর কোথা থেকে গ্রহণ করবে?

৯. স্বামীর আনুগত্য

প্রত্যেক স্ত্রীকেই বিবি হাজেরা রা.-এর দৃষ্টান্ত থেকে অন্তত এই শিক্ষাটুকু তো লাভ করা উচিত, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- أُنْظُرِيْ أَيْنَ أَنْتِ مِنْهُ فَإِنَّهُ جَنَّتُكِ أَوْ نَارُكِ অর্থ- তুমি ভেবে দেখ, তার নিকটে তোমার স্থান কোথায়? কারণ সে-ই তোমার জান্নাত কিংবা জাহান্নাম।

আর স্বামীদেরও উচিত, তারা যেন নিজেদেরকে এই হাদীসের নমুনা বানায়- خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِأَهْلِهِ، وَأَنَا خَيْرُكُمْ لِأَهْلِهِ তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যে নিজের স্ত্রীর জন্য সর্বোত্তম। আমি তোমাদের সবার চেয়ে আমার স্ত্রীদের জন্য উত্তম।

১০. সন্তানদের ঈমানী তরবিয়ত

ইবরাহীম আ. ও হাজেরা রা.-এর জীবন থেকে সকল পিতামাতার এই শিক্ষা লাভ করা উচিত। যেসব পিতমাতা

সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত তাদের জানা থাকা দরকার যে, আসল ভবিষ্যত হল আখিরাত। যে ব্যক্তি তার সন্তানের আখিরাতকে ধ্বংস করল কিংবা তাদের আখিরাত সাজানোর বিষয়ে কোনো চিন্তাই করল না, সে সন্তানের কোনো অধিকার ও দায়িত্ব পালন করল না। সে হল জালিম আর সন্তান হল মাজলুম। যে পিতামাতাকে আল্লাহ তাআলা হজ্বের তাওফীক দিয়েছেন সে এই জুলুম কীভাবে করতে পারে?!

এ সংকল্পগুলোও নিয়ে আসুন

ক. যে চোখ দিয়ে আল্লাহ তাআলা কাবা দর্শনের তাওফীক দিয়েছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হেরেম দেখিয়েছেন সে চোখের হেফাযত করব, এর অপব্যবহার করব না ইনশাআল্লাহ।

খ. আল্লাহ আমাদেরকে একটি নয়, দুটি হেরেম দান করেছেন (হেরেমে মক্কী ও হেরেমে মাদানী) এবং উভয় হেরেমে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য আমাকে দান করেছেন। আমি অধমকে হারামের মাধ্যমে মুহতারাম (সম্মানিত) করেছেন।তাই ভবিষ্যতে আমার এই সত্তাকে মন্দ কাজ ও গুনাহ দ্বারা কলুষিত করব না ইনশাআল্লাহ।

গ. হাদীস শরীফে আছে- مَنْ حَجَّ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمٍ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ অর্থাৎ- যে হজ্ব করল এবং সকল অশ্লীলতা ও গুনাহর কাজ থেকে বিরত থাকল সে সদ্যজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়।

তাই আল্লাহ তাআলার নিকট আশা, তিনি আমার হজ্ব কবুল করেছেন এবং এর বদৌলতে আমাকে নবজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ করেছেন। ইনশাআল্লাহ আমি এই নিষ্পাপত্বের হেফাযত করব। আল্লাহ না করুন-কোনো গুনাহ হয়ে গেলেও তাৎক্ষণিক তাওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে পুনরায় পবিত্র হয়ে যাব।

ঘ. ইনশাআল্লাহ সর্বদা নিজেকে কাবার মানুষদের সঙ্গে সংযুক্ত রাখব। কাবার হেদায়েত ও বরকত এবং কাবার মানুষগুলোর জীবন ও আদর্শকে হাতছাড়া করব না।

ঙ. এই সংকল্প করে আসুন যে, বিদায় হজ্বের বিভিন্ন স্থানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ঐতিহাসিক খোতবায় যে বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছেন তার সবকিছুকে মনেপ্রাণে মেনে এর উপর দৃঢ় ও অটল থাকব এবং মনে করব যে, এটা তো আমার নবীর বিদায়ী উপদেশ যা তিনি করেছিলেন হজ্বের সফরে, যে হজ্বের তাওফীক আল্লাহ তাআলা আমাকেও দান করেছেন।

চ. আমাকে মনে করতে হবে, হজ্বের যত ফযীলত ও ফাওয়ায়েদ আছে সবগুলোই মাবরূর হজ্বের সাথে সংযুক্ত। মাবরূর হজ্বের অর্থ নেক ও পবিত্র হজ্ব। আমার হজ্বটি মাবরূর হল কি না-এটা তো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাআলাই জানেন। তবে এর একটি বাহ্যিক নিদর্শনও রয়েছে। তা এই যে, হজ্বের পর দ্বীনদারী ও ঈমানী অবস্থার উন্নতি হবে। এর অর্থ শুধু নামায-রোযার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, নফল ইবাদতের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়া, বাহ্যিক বেশভূষা ঠিক হয়ে যাওয়া নয়। এসব তো আছেই; এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, নিজের জীবনে হালাল-হারাম বেছে চলা। হারাম উপার্জন থেকে বিরত থাকা। সততা ও বিশ্বস্ততাকে নিজের প্রতীক হিসেবে ধারণ করা। সকল প্রকার খেয়ানত, ধোঁকা ও প্রতারণা এবং জুয়া, সুদ-ঘুষের মতো সব ধরনের নাজায়েয কাজ, নাজায়েয লেনদেন এবং সকল অন্যায়-অপরাধ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা। মানুষের সঙ্গে সে সদাচরণ করবে। সব ধরনের অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করবে। কেননা, ঈমানের প্রকৃত উন্নতি তো হারাম, অশ্লীলতা, অবৈধ উপার্জন ও মানুষের অধিকার হরণ করা এবং তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করা থেকে বিরত থাকার মধ্যেই।

ছ. আল্লাহ তাআলা যখন তাঁর ঘর দেখা ও যিয়ারত করার তাওফীক দিয়েছেন তখন ইনশাআল্লাহ আমি এই নেয়ামতের মর্যাদা রক্ষা করব। আল্লাহর অনুগ্রহে জান্নাতে দাখিল হওয়া পর্যন্ত তাঁর শোকর আদায় করতে থাকব। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। আমীন।

আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের জন্য কী আনবেন

শুধু এবং শুধু যে জিনিসগুলো আনবেন তা হচ্ছে-

ক) উন্নত ও পবিত্র জীবন। যেন আপনার বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনও আপনাকে দেখে হজ্বের তামান্না করে এবং নিজেদের জীবনে আপনাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে।

খ) যমযম। যা ভূ-পৃষ্ঠে কাওছারের দৃষ্টান্ত। এর ইতিহাস ঈমান ও জিহাদের এক স্বতন্ত্র অধ্যায়।এর বৈশিষ্ট্য, ফাওয়ায়েদ ও ফযীলত প্রসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত।

গ) মদীনার খেজুর।

এর চেয়ে বেশি কিছু আনতে চাইলে কোনো দ্বীনী কিতাব কিংবা হিজাযের তৈরি এমন জায়নামায, যার মধ্যে কোনো ছবি, কোনো পবিত্র বস্ত্তর চিত্র বা কারুকাজ নেই।

এসব ছাড়া অন্য কোনো কিছু হারামাইন শরীফাইনের হাদিয়া হতে পারে না। কেননা, সৌদী বাজারের জিনিসপত্র সৌদী আরবের নয়। তাহলে তা হারামাইনের হাদিয়া কীভাবে হতে পারে? তাছাড়া সৌদী আরবের ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ, বিশেষত হজ্ব-ওমরার মৌসুমে ঐসব লোকদের হাতে থাকে, যারা আমাদের আপন নয়, পর। যাদের উদ্দেশ্যই হল, আগন্তুকদের লুটেপুটে খাওয়া। অতএব এদের প্রতারণার শিকার না হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

যে জিনিসগুলো আনবেন না

মনে রাখবেন, হেজাযে যেসব জিনিস ইসলাম ও মুসলিম হিজাযের শত্রুদের মাধ্যমে প্রবেশ করেছে তা হেজাযেরও নয়, হারামাইনেরও নয়। এসব জিনিস আপনি কখনো গ্রহণ করবেন না। এমনকি চোখ তুলেও এসবের দিকে তাকাবেন না। নিজের সঙ্গে এসব বস্ত্ত আনার তো প্রশ্নই আসে না। কারণ-

১. ইহুদি-খ্রিস্টান ও কাফের-মুশরিকদের সংস্কৃতি ও রেওয়াজ-প্রচলনের কোনো কিছু সঙ্গে করে আনবেন না। আপনার বা আপনার দেশের কোনো ত্রুটি ও দুর্বলতা যদি সেখানেও দেখতে পান তাহলে একে ঐ ত্রুটির পক্ষে বৈধতার দলীল বানাবেন না। বে-পর্দা, নির্লজ্জতা ও পশ্চিমা বেশভূষা সবকিছুই সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। এগুলো হারামাইনের শিক্ষা নয়। তেমনিভাবে অন্য সকল গুনাহর কাজ-যেখানেই হোক তা গুনাহ। আর হারামের এলাকায় তো এর ভয়াবহতা আরো বেশি।

বর্তমান সময়ের টেলিভিশন হল সাপের বাক্স-যেখানেই তা রাখা হোক না কেন। দাড়ি মুন্ডানো গুনাহ, যে দেশের মানুষই তা করুক না কেন। মোটকথা, ছোট-বড় সকল গুনাহ গুনাহই। তা যেখানেই হোক এবং যার দ্বারাই হোক।

আফসোস, খাদেমুল হারামাইন ও তাদের সহযোগীরা পশ্চিমাদের গোলামী করে নিজেদের ঈমানী গায়রাত হারিয়ে ফেলার দরুণ হারামের সীমানায় অশ্লীল ও গর্হিত কাজের জোয়ার বরদাশত করতে তাদের সম্ভবত কোনো কষ্টই হয় না।

২. তেমনিভাবে যেমনটি আমি আগেও আলকাউসারের পাতায় লিখেছি যে, গায়র-মুকাল্লেদিয়ত ও ফেকহী মাযহাবকে অস্বীকার করা, দ্বীনী বিষয়ে বেপরোয়াভাবে মতামত দেওয়াও হারামাইনের বস্ত্ত হতে পারে না। এসব জিনিস হিন্দুস্তান ও অন্যান্য দেশ থেকে হেজাযে প্রবেশ করেছে। ফিকহের অনুসরণই তো সালাফের মীরাছ। এটিই হচ্ছে হাদীস অনুসারে আমলের মাসনূন তরীকা। সেটি ত্যাগ করে গায়রে মুকাল্লিদিয়তের ফিতনাকে আরবের তোহফা-উপঢৌকন মনে করে সঙ্গে নিয়ে আসবেন না।

৩. বর্তমান কোনো কোনো আরবের দুর্বলতা দেখে আরবদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা সঙ্গে করে আনবেন না। আরবের সৎ ও আলেমদের সম্পর্কে তো নয়ই।

৪. সেখানে নামাযের পদ্ধতিগত যে দু’ চারটি ভিন্নতা চোখে পড়ে তাও সুন্নাহসম্মত এবং তারও মূল ভিত্তি সুন্নাহ। আর আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে নামায আদায় করা হয় তারও ভিত্তি সুন্নাহ।উভয় পদ্ধতিই সুন্নাহ ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এজন্য সেখানে কোনো ভিন্ন পদ্ধতি দেখে নিজ দেশের আলেমের প্রতি অনাস্থা নিয়ে আসবেন না যে, তারা আপনাকে নামাযের সঠিক পদ্ধতি শিক্ষা দেননি। বিষয়টি এমন নয়; বরং তারা আপনাকে যা শিখিয়েছেন তাও সঠিক এবং সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। পুরোপুরি সুন্নাহসম্মত। সুতরাং আপনি নিশ্চিন্তে সে অনুযায়ী আমল করতে থাকুন।

দলিল-প্রমাণ জানার প্রয়োজন মনে হলে মাওলানা আবদুল মতীন ছাহেব সংকলিত ‘দলিলসহ নামাযের মাসায়েল’ (প্রকাশক-মাকতাবাতুল আযহার বাড্ডা) ও শায়খ ইলিয়াস ফয়সালের ‘নামাযে পয়াম্বর’ (বাংলা অনুবাদ : নবীজীর নামায, প্রকাশক-মাকতাবাতুল আশরাফ বাংলাবাজার) কিতাব দুটি মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করুন।

আল্লাহ তাআলা আমাদের হারামাইনকে হেফাযত করুন এবং বাইতুল মুকাদ্দাসকে তাওহীদপন্থীদের হাতে ফিরিয়ে দিন আর হারামাইন ও বাইতুল মুকাদ্দাসের পবিত্রতা দ্বারা আমাদেরকে পুতঃপবিত্র করে দিন। আমীন।

[সূত্র- মাসিক আলকাউসার, অক্টোবর, ২০১১ সংখ্যা]

– মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক, শিক্ষাসচিব- মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া, ঢাকা।

অনুবাদ : আবদুল্লাহ ফাহাদ

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।