।। আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান কাসেমী ।।
গণমাধ্যমের কল্যাণে প্রতি দিনের নানা সংবাদ আমরা জানতে পারি। এসবের বড় একটি অংশ জুড়ে থাকে এখানে সেখানে ঘটে যাওয়া নানা সংঘাতের কথা। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সংঘাত, দলে দলে সংঘাত, শ্রেণীতে শ্রেণীতে সংঘাত। এসব সংঘাত কেঁড়ে নিচ্ছে অসংখ্য মানুষের প্রাণ। নিরীহ নারী, পুরুষ ও শিশুর প্রাণ। এতে সমাজে নানা জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব সংঘাতের হেতু ও যৌক্তিকতা যাই হোক, যে পক্ষেই যাক, মানবতা যে আজ অধঃপতনের চরমে নেমে এসেছে, সমাজে শ্রেণীগত সংঘাত চলছে, অস্থিতিশীলতা ও আশান্তি বিরাজ করছে, তা সহজেই বুঝে আসে।
আমরা কুরআন-হাদীস ও রাসূল (সা.)এর সীরাতে দেখতে পাই, ইসলাম মানব সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতির সব পন্থা শিখিয়েছে এবং শান্তি ও সম্প্রীতির পথে সমস্ত বাঁধা দূর করেছে। ইসলাম একটি শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করে মানব জাতিকে দেখিয়ে গেছে। সমাজের স্তরে স্তরে শান্তির আচরণ শিক্ষা দিয়েছে। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে মানুষের শান্তিময় আচরণ কি, তা শিক্ষা দিয়েছে। মানুষের সাথে মানুষের, মুসলিমের সাথে মুসলিমের, মুসলিমের সাথে অমুসলিমের শান্তি সম্প্রীতি রক্ষার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে। শিক্ষা দিয়েছে, মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, ছোট-বড় সবার সাথে কি আচরণ করতে হবে। এমন কি, জীব-জন্তুর সাথেও সুন্দর আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। বক্ষমান প্রবন্ধে এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা হবে।
শ্রেণীবোধের আবসানঃ সমাজে সংঘাত যে সব কারণে সৃষ্টি হয়, শ্রেণীবোধ এর অন্যতম। তাই আল্লাহ তায়ালা নারী, পুরুষ, জাতি, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের ব্যবধান ঘুচিয়ে সাম্যের বিধান জারি করে ইরশাদ করেছেন, “হে মানব জাতি! নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে একজন নর ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে অনেক জাতি ও গোত্রে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। নিশ্চয় তোমাদের মধ্য সবচেয়ে সম্মানিত হল, সবচেয়ে পরহেযগার ব্যক্তি। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান”। (সূরা হুজরাত- ১৩)।
বিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছিলেন, তোমাদের পরস্পরে রক্তপাত করা তোমাদের উপর হারাম, এই হজ্বের মাসে এই নগরে রক্তপাতের মত। তিনি বিদায় হজ্বের ভাষণে বর্ণবোধ চিরতরে মুসলিম সমাজ থেকে মুছে দিয়ে বলেছেন, আজমের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। স্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। এভাবেই রাসূল (সা.) শ্রেণীবোধ ও বর্ণবাদের দেয়াল গুঁড়িয়ে দিয়ে মানব সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আল্লাহ তায়ালার সাথে মানুষের শান্তিময় আচরণঃ এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “যারা ঈমান এনেছে এবং অন্যায়ের মাধ্যমে তাদের ঈমানকে আচ্ছন্ন করেনি, তাদের জন্যই রয়েছে নিরাপত্তা, আর তারাই হল সঠিক পথপ্রাপ্ত”। (সূরা আনআম- ৮২)। তাহলে বুঝা গেল, মানুষের সৃষ্টিকর্তা মহান অল্লাহ তায়ালার সাথে সুন্দর আচরণ হল, ঈমানদার হওয়া, ন্যায়ের পথে চলা, অন্যায় পরিহার করা। আর আল্লাহ তায়ালাকে অস্বীকার করা হল সংঘাত ও অশান্তির পথ।
সাধারণ মুসলিমের সাথেঃ আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, “মুমিনরা তো ভাই ভাই”। (সূরা হুজরাত, ১০)।
রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, “মুসলিম তো ঐ ব্যক্তি, যার কথা ও হাত থেকে অপর মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে”। (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস নং- ৭০৮৬)।
“নিজের জন্য যা পছন্দ করো, তা অপর মুসলিম ভাই কিংবা পড়শির জন্য পছন্দ করলেই তবে তোমরা প্রকৃত মুমিন হতে পারবে”। (বুখারী ও মুসলিম)।
এতেই সাধারণ মুসলিমের সাথে অপর মুসলিমের ভাই ভাই সম্পর্ক শুভ ও কল্যাণকর সম্পর্ক তৈরী হবে। সুতরাং মুসলিমদের পরস্পরে শান্তিময় আচার-আচরণ হল, পরস্পরের প্রতি শুভ ও কল্যাণকামী হওয়া, ভ্রাতৃসুলভ আচরণ করা। হিংসা, বিদ্বেষ, মিথ্যাচার ও প্রতিশোধ প্রবণতা হল সংঘাত ও অশান্তির আচরণ।
অমুসলিমের সাথেঃ আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, “তোমরা এসো আমাদের ও তোমাদের মাঝে ঐক্যমতের বাণীর দিকে, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত করব না। তার সাথে কাউকে শরীক করব না। আমরা একে অপরকে প্রতিপালক রূপে গ্রহণ করব না”। (সূরা আলে ইমরান- ৬৪)।
“তোমাদের জন্য হল তোমাদের দ্বীন, আর আমার জন্য হল আমার দ্বীন”। (সূরা কাফিরূন- ৬)।
“তারা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ডাকে, তোমরা তাদেরকে গালি দিও না, তাহলে ওরাও আল্লাহকে গালি দিবে অজ্ঞতা বশতঃ সংক্রমিত হয়ে”। (সূরা আনআম- ১৭)।
আরও পড়তে পারেন-
- মাহে যিলহজ্জ এবং কুরবানীর ফাযায়েল ও মাসায়েল
- পবিত্র কুরবানীঃ ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত করে
- কার উপর ‘কুরবানী’ আদায় করা ওয়াজিব?
- ‘কুরবানী’ মুমিন জীবনে যে শিক্ষা দিয়ে থাকে
- কুরবানীর ইতিহাস ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
“যারা তোমাদের সাথে ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ী-ঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদাচার করতে এবং ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে বারণ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ইনসাফকারিদেরকে ভালবাসেন”।
এ আয়াতগুলো সুন্দর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অতুলনীয় দিক-নির্দেশক। এর বিপরীতে অবস্থান মানেই বিশেষ কোন জাতি ও শ্রেণীকে সইতে না পারা, নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, সুন্দর সহাবস্থান এবং সামাজিক সম্প্রীতি ও শান্তিকে ব্যহত করা।
আত্মীয় স্বজনের সাথেঃ সম্প্রীতি ও সৌহার্দপূর্ণ আচার-আচরণ ও মন্দ স্বভাব বর্জনের বিধান জারি করে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, “আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং কোন কিছুকে তার অংশীদার করো না। মা বাবার সাথে সুন্দর আচরণ কর। সুন্দর আচরণ কর আত্মীয়ের সাথে, এতীমের সাথে, মিসকীনের সাথে, আত্মীয় পড়শির সাথে, অনাত্মীয় পড়শীর সাথে, পাশের সঙ্গীর সাথে, পথিকের সাথে এবং তোমাদের মালিকানাধীন (মানুষ ও প্রাণীর) সাথে। নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিক ও অহংকারীকে ভালবাসেন না”। (সূরা নিসা- ৩৬)।
জীব জন্তুর সাথেঃ রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, সব সৃষ্টি আল্লাহর পরিজন। তাই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি হল, যে তার পরিজনের সাথে সুন্দর আচরণ করল। (বাইহাকি, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং- ৭৪৪৭, যয়ীফ)।
আমরা এভাবে মানব জীবনের স্তরে স্তরে দেখতে পাই ইসলামের সুন্দর নির্দেশনা । যা সমাজের শ্রেণীবোধকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে এবং সমাজের স্তরে স্তরে শান্তি ও সম্প্রীতি নিশ্চিত করেছে। সমাজের স্তরে স্তরে সম্প্রীতির আদর্শ রূপায়িত হলেই মানব সমাজের সংঘাত দূর হবে।
আমরা রাসূল (সা.)এর পবিত্র সীরাতে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই, ইসলামের সে আদর্শের রূপায়ণ। শুধু নবুওয়্যাতের পর নয়, শুধু শৈশব থেকে নয়, সীরাত বলে, তিনি মায়ের গর্ভ থেকেই ছিলেন শান্তির অগ্রনায়ক। তাঁর গোটা জীবন ছিল শান্তি-সম্প্রীতির একটি জীবন্ত আদর্শ। তিনি ছিলেন শান্তি ও সম্প্রীতির মূর্ত প্রতীক। রাহমাতুল্লিল আলামীন। আমরা তার ব্যবহারিক জীবন থেকে কয়েকটি নমুনা পেশ করব।
রাসূল (সা.)এর ব্যবহারিক জীবনে এ আদর্শের রূপায়ন
১- নবুওয়্যাতের আগেঃ
ক-গর্ভাবস্থায়ঃ হযরত আমেনা (রাযি.) বলেছেন, আমি যে তাকে গর্ভে ধারণ করেছি অনুভব করিনি। এ কারণে কোন ভারিত্ব এবং অস্বস্তিও অনুভব করিনি অন্য নারীদের মত।
খ- শৈশবেঃ শৈশবে রাসূল (সা.) যখন দুধ মা হযরত হালিমা সাদিয়া (রাযি.)এর কোলে ছিলেন, তখন তিনি ডান পাশ থেকে শুধু পান করতেন, বাম পাশ রেখে দিতেন দুধ ভাইয়ের জন্য।
গ- যৌবনেঃ রাসূল (সা.) যৌবনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে অবদান রেখেছেন এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল, হিলফুল ফযূল ও হজরে আসওয়াদ পুনঃস্থাপন।
ঘ- হিলফুল ফুযূলঃ যখন রাসূল (সা.)এর বিশ বছর বয়স, তখন মক্কায় কোরাইশের বিভিন্ন শাখা গোত্র মিলে মাজলুম মানুষকে সাহায্য করা ও তার অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর নাম দেয়া হয়েছিল হিলফুল ফুযূল। রাসূল (সা.) সে সংঘের মজলিসে উপস্থিত থেকে শরীক হয়েছিলেন। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, আব্দুল্লাহ বিন জাদয়ানের ঘরে আমি একটি হিলফে (অংগিকার মজলিসে) উপস্থিত হয়েছিলাম। লাল উট অপেক্ষা তা আমার কাছে অনেক প্রিয় ছিল। ইসলামের সময়ও যদি এমন অংগিকারের জন্য আমাকে ডাকা হয়, তাতেও আমি সাড়া দিব। (মুসনাদ আহমদ)।
ঙ- হজরে আসওয়াদ পুনঃস্থাপনঃ রাসূল (সা.)এর বয়স যখন ৩৫ বছর, তখন কোরাইশরা কা’বা শরীফ নতুন করে নির্মাণ করছিল। কাবা শরীফ নির্মাণে অংশগ্রহণ ছিল মর্যাদার বিষয়। সব শাখা গোত্র অংশগ্রহণ করেছিল কা’বার নির্মাণ কাজে। যখন হজরে আসওয়াদ স্থাপনের সময় হল, তখন তাদের মাঝে মতবিরোধ দেখা দিল কে হজরে আসওয়াদ স্থাপ করবে, এ নিয়ে। এর সমাধা করার দায়িত্ব আসে রাসূল (সা.) এর উপর। তিনি বুদ্ধিদীপ্ত এক কৌশল গ্রহণ করে কোরাইশদেরকে একটি অবশম্ভাবী যুদ্ধ থেকে রক্ষা করেন।
আমরা দেখতে পেয়েছি, মহানবী (সা.) আমলের মাধ্যমে তার শান্তির মিশন শুরু করেছেন মায়ের গর্ভ থেকে। তা অব্যহত ছিল জন্মের পর শৈশবে, যৌবনে। এখন নবুওয়্যাতের পর তাঁর পবিত্র জীবন থেকে কয়েকটি উদাহরণ পেশ করব।
২- নবুওয়্যাতের পরঃ
রাসূল (সা.) ছিলেন শান্তির দূত। গোটা তেইশ বছর যাবত মানুষকে শান্তির পাথ দেখানো ও বাস্তবে আমল করে দেখিয়ে দেয়ার মাঝেই ব্যয় করেছেন। আমারা শুধু কয়েকটি উদাহরণ পেশ করব।
ক- মদীনা সনদঃ রাসূল (সা.) মদিনাতে হিজরত করার পর মুসলিম ও অমুসলিমের সুন্দর সহাবস্থানের জন্য শান্তি সম্প্রীতির সব বাঁধা অপসারিত করার জন্য মদীনার ইহুদীদের সাথে চুক্তি করেছিলেন। ইতিহাসে যাকে মদিনা সনদে অভিহিত করা হয়। এতে ৪২/৪৭টি ধারা ছিল। এর সব কয়টিই ছিল রাসূল (সা.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মদীনার ইসলামী সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ধারা হল-
(ক) জুলুম ও জালেমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকা (খ) দুর্বলকে সহযোগিতা করা (গ) মারামারি ও হানাহানি ব্যভিচারের মত অবৈধ (ঘ) মদিনায় মুসলিম ইহুদী সবার সুন্দর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান (ঙ) বহিরাগত আক্রমনের সম্মিলিত প্রতিরোধ (চ) কোরাইশকে আশ্রয় দেয়া হবে না এবং যারা তাদেরকে আশ্রয় দিবে ওদেরকে সাহায্য করা হবে না। এখানে জন সাধারনের শান্তি ও নিরাপত্তার সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা মদিনার মানুষের মুখে মুখে ছিল। ধারাটি হল, যে বের হবে সে নিরাপদ, যে মাদিনায় থাকবে সে নিরাপদ, তবে জুলুমকারি ও অপরাধী এর ব্যতিক্রম। যে সুশীল ও মুত্তাকী আল্লাহ তার আশ্রয় দাতা এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লহর রাসূল।
খ- হুদাইবিয়া সন্ধিঃ আরেকটি উল্লেখ যুগ্য শান্তি প্রকৃয়া হল হুদাইবিয়ার সন্ধি। ইতিহাস বলে, যখন ৬ষ্ট হিজরিতে মুসলমানদেরকে মক্কাবাসি ওমরাহ্ পালনে বাঁধা দেয়, তখন সাহাবায়ে কেরাম মৌলিকভাবে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। তা ছাড়া সেখানে কাফেররা মুসলিমদের স্বার্থ বিরোধী শর্তও জুড়ে দিয়েছিল। এর পরও রাসূল (সা.) হুদাইবিয়াতে সন্ধি করেছিলেন একমাত্র শান্তির লক্ষ্যে। আসলেই সে সন্ধি ছিল শান্তি। আল্লাহ একে সুস্পষ্ট বিজয় বলে অভিহিত কেরেছেন, “নিশ্চয় আমরা আপনাকে দান করেছি একটি স্পষ্ট বিজয়”। (সূরা ফাতহ- ১)।
গ- ফাতহে মক্কাঃ রাসূল (সা.) যে প্রেরিত হয়েছিলেন শান্তির বার্তা বাহক হিসেবে, এর আরেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হল মক্কা বিজয়। যা মানব ইতিহাসের বিরল দৃষ্টান্ত । বিজয়ের পর মক্কা বাসীরা যখন প্রাণের ভয়ে এদিক সেদিক পালাচ্ছিল তখন রাসূল (সা.) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি তোমাদের সাথে কী করব বলে তোমাদের ধারণা? তারা তখন বলেছিল, উত্তম (আচরণ), (আপনি আমাদের) উদার ভাই, উদার ভাইয়ের সন্তান। তখন রাসূল (সা.) ইরশাদ করলেন, যাও তোমরা সবাই মুক্ত। এরপর হযরত ইউসুফ (আ.)এর মত বললেন, আজ তোমাদেরকে কোন তিরস্কার করব না।
ঘ- বিদায় হজ্জঃ ইসলাম যে শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম এর আরেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হল, বিদায় হজ্বের ভাষণ। এখানে রাসূল (সা.) বলেছিলেন, তোমাদের পরস্পরে রক্তপাত করা তোমাদের উপর হারাম, এই হজ্বের মাসে এই নগরে রক্তপাতের মত। তিনি সেখানে সাম্প্রদায়িকতা চিরতরে মুসলিম সমাজ থেকে মুছে দিয়েছেন, আজমের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শেতাঙ্গের কৃষ্ণাঙ্গের উপর কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। এভাবেই রাসূল (সা.) সাম্প্রদায়িকতার মাথা গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। যারা ইসলামকে ও ইসলামের নবীকে সাম্প্রদায়িক মনে করে, তারা হয় মুর্খ আর না হয় জেনে শুনে উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে এমনটি করছে। মানব জাতির সার্বিক কল্যাণের নিয়ামক হিসেবে সে দিন কুরআন ও সুন্নার কথা বলে গেছেন। আমি তোমাদের মাঝে দুটি বিষয় রেখে গেলাম। যতক্ষণ সে দু’টি তোমরা আঁকড়ে ধরবে, ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবে না। সে দু’টি হল, আল্লাহর কিতাব ও তার রাসূলের সুন্নাত। (মুসলিম, হাদিস নং- ৩০০৬)।
আমরা দীর্ঘ আলোচনার পর বলতে পারি, সংঘাতপূর্ণ মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলাম ও রাসূল (সা.) মানব জাতির জন্য এক অনুপম আদর্শ স্থাপন করেছেন। এক আল্লাহর বিশ্বাস, তিনি জগতের সৃষ্টিকর্তা, তিনি ইবাদতের মালিক এবং এক পিতৃত্বের বিশ্বাস, আদম (আ.) সব মানুষের পিতা; এসবের মাধ্যমে শ্রেণীবোধ ও বর্ণবাদকে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। এরপর স্তরে স্তরে কার সাথে মানুষের শান্তিপূর্ণ আচরণ কি হবে, তা রাসূল (সা.) প্রয়োগিক পদ্ধতিতে শিখিয়ে দিয়েছেন। মানব রচিত কোন সমাজ দর্শনে এর কোন নজীর নেই। তাই বর্তমানের সংঘাতময় মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হল, ইসলাম ও রাসূল (সা.) এর আদর্শে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
– আল্লামা হাফেয নাজমুল হাসান কাসেমী, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক- জামিয়াতুন নূর আল-কাসেমিয়া ও রওজাতুস সালিহাত মহিলা মাদ্রাসা, উত্তরা, ঢাকা, সাবেক পরিচালক- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা এবং খতীব- বায়তুন নূর জামে মসজিদ, উত্তরা, ঢাকা।
উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ