।। শায়খুল হাদীস মাওলানা তাজুল ইসলাম আশরাফী ।।
যিলহজ্জের প্রথম দশ দিন অতি বরকতপূর্ণ। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মুমিনদের জন্য বিশেষ উপহার।
এই দশ দিনের আমল ও ইবাদত আল্লাহর কাছে বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি প্রিয়। কুরআন ও হাদিসের অসংখ্য বর্ণনায় যিলহজ্জের দশ দিনের আমল-ইবাদতের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
এই দশ দিনের পুরো সময়টাই তো আমলের। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম সব ধরনের আমলই এ সময়ে করতেন। রোযা রাখাও এ সময়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল।
হাদিসে ইয়াওমে আরাফা বা ‘আরাফার দিনের রোযা’ রাখার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
আবু কাতাদা (রাযি.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘আরাফার’ দিনে সিয়াম পালনের ফযীলতের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন- আমি মনে করি, আরাফার দিনে সিয়াম পালনে আল্লাহতায়ালা বিগত বছরের গুনাহ ও আগামী বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। (সহীহ মুসলিম: হাদিস ১১৬২)।
হযরত হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যিলহজ্জের নবম দিন সিয়াম পালন করতেন এবং সিয়াম পালন করতেন আশুরার দিনে৷ (সুনানে আবু দাউদ, নাসায়ী, মুসনাদে আহমাদ)।
বিখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা মুবারকপুরী রহ. বলেছেন- হাফসা (রা.)-এর এ বর্ণনায় নবীজি যিলহজ্জের নবম দিন রোযা রাখতেন; এটা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে এবং এই দিনটিই ‘ইয়াওমে আরাফা’ বা আরাফার দিন। (মিন্নাতুল মুনইম শরহু সহীহ মুসলিম ২/২১১)।
উপরোক্ত উভয় হাদিসের বর্ণনায় বিষয়টি স্পষ্ট যে, ‘ইয়াওমে আরাফা’ বা আরাফার দিন হল সব জনপদের নিজ নিজ হিজরি তারিখ হিসেবে ৯ যিলহজ্জ, ৮ যিলহজ্জ নয়! কারণ এই রোযা আরাফা বা আরাফায় অবস্থান সংক্রান্ত আমল নয়।
বরং ৯ তারিখের বিশেষ আমল। কাজেই আমাদের দেশের হিসেবে ৮ যিলহজ্ব সৌদি আরবে হাজীদের আরাফায় অবস্থান হলেও আমরা রোযা রাখব ৯ তারিখেই।
[ দুই ]
‘ইয়াওমে আরাফা’ হচ্ছে ওই তারিখের (৯ যিলহজ্জের) পারিভাষিক নাম।
যেহেতু হজ্জের প্রধান রোকন ‘আরাফায় অবস্থান’ তারিখ হিসাবে ৯ যিলহজ্জে আদায় করা হয়, তাই এ তারিখেরই নাম পড়ে গেছে ‘ইয়াওমে আরাফা’ বা আরাফার দিন।
এ কারণে যেসব আমল আরাফা বা আরাফায় অবস্থানের সঙ্গে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট নয়; বরং যিলহজ্জের ৯ তারিখের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেগুলোকেও ‘ইয়াওমে আরাফা’ বা আরাফার দিনের আমল হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
তাই ৯ যিলহজ্জের রোযাকে আরাফার দিনের রোযা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
[ তিন ]
ইয়াওমে আরাফা বা আরাফার দিন যে ৯ জিলহজ এর আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো- ‘তাকবিরে তাশরিক’ সংক্রান্ত হাদিস।
এটি আরাফা বা হাজীদের আরাফায় অবস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো বিশেষ আমল নয়। এটি শুরু হয় ৯ যিলহজ্জ ফজর থেকে। অথচ যে দলিল দ্বারা ৯ তারিখ থেকে তাকবিরে তাশরিক শুরু হওয়া প্রমাণিত তাতেও ‘ইয়াওমে আরাফা’ আরাফার দিন শব্দই আছে।
আলী রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন- নবীজি ইয়াওমে আরাফা বা আরাফার দিন (৯ যিলহজ্জ) ফজরের পর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত তাকবিরে তাশরিক পাঠ করতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস: ৫৬৭৭)।
আরও পড়তে পারেন-
- মাহে যিলহজ্জ এবং কুরবানীর ফাযায়েল ও মাসায়েল
- পবিত্র কুরবানীঃ ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত করে
- কার উপর ‘কুরবানী’ আদায় করা ওয়াজিব?
- ‘কুরবানী’ মুমিন জীবনে যে শিক্ষা দিয়ে থাকে
- কুরবানীর ইতিহাস ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
এখানেও ‘ইয়াওমে আরাফা’ অর্থ ৯ জিলহজ। আর ৮ জিলহজ আরাফার দিনের রোজার প্রবক্তাদের কাছেও তাকবিরে তাশরিক ৯ জিলহজ থেকে শুরু হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত এবং এর স্বপক্ষে দলিলও উপরোক্ত এই হাদিস!
[ চার ]
গোটা মুসলিম উম্মাহর ইজমা আছে যে, ইয়াওমে আরাফার পরের দিনটিই ইয়াওমুন নাহর। হাদিসেও এ ধারাবাহিকতা প্রমাণিত রয়েছে।
এটি প্রমাণ করে, ‘ইয়াওমে আরাফা’ একটি তারিখের নাম। আর তা হচ্ছে ৯ জিলহজ আর ‘ইয়াওমুন নাহর’ও একটি তারিখের নাম। আর তা হচ্ছে ১০ জিলহজ ঈদের দিন।
কারণ আমাদের দেশের হিসেবে ৮ জিলহজকে ইয়াওমে আরাফা মেনে নিলে ইয়াওমে আরাফা ও ইয়াওমুন নাহরের মাঝে আরেকটি দিন স্বীকার করে নেয়া জরুরি। অথচ এটা ইজমার সরাসরি বিরোধী।
সুতরাং বোঝা গেল, এ জাতীয় বিচ্ছিন্ন চিন্তা ও বক্তব্য আরো কিছু ক্ষেত্রেও বিচ্ছিন্নতাকে অনিবার্য করে তুলবে।
কাজেই আমরা বিচ্ছিন্ন কথাকে না মেনে উম্মাহর ঐকমত্য সিদ্ধান্ত মেনে আগামী শুক্রবার ৯ জিলহজের এই ফজিলত পূর্ণ রোজা রাখার নিয়ত করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বোঝার এবং আমলের তাওফিক দান করুন আমিন।
লেখক: শায়খুল হাদিস- তিলপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা, খিলগাঁও, ঢাকা ও মিফতাহুল উলূম মাদ্রাসা, বাড্ডা, ঢাকা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক- সানমুন ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস, নয়াপল্টন, ঢাকা।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ