।। শায়খ সাঈদ আহমদ ।।
পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে যিলহজ্ব মাস এবং এর প্রথম দশ দিনের অনেক ফযীলত ও গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে। এ দশ দিনকে বলা হয়েছে বছরের শ্রেষ্ঠ দিন। উক্ত দশ দিনের আমল আল্লাহ তাআলার কছে অধিক পছন্দনীয়।
যিলহজ মাসের ফযীলত
যিলহজ্ব মর্যাদাপূর্ণ মাস সমূহের একটি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—
মাসসমূহ হতে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। এটাই দ্বীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজেদের প্রতি (গুনাহ করে) জুলুম করো না। (তাওবা, ৩৬ আয়াত)।
আল্লাহ তাআলা সম্মানিত চারটি মাসে কারো উপর জুলুম করতে নিষেধ করেছেন। অন্যান্য মাসে জুলুম করা যদিও নিষিদ্ধ; এই মাসগুলোতে বিশেষভাবে নিষেধ করার মাধ্যমে এর অধিক গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)। হাদীসে এসেছে-
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাযি.) বলেন, বিদায় হজ্বে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জেনে রেখো! তোমাদের দিবসসমূহের আজ সর্বশ্রেষ্ঠ দিবস এবং এই মাস তোমাদের মাসসমূহের সর্বশ্রেষ্ঠ মাস। (ইবনে মাজাহ ৩৯৩১ ও মুসনাদে আহমাদ ১১৭৬২, সনদ সহীহ)।
যিলহজ্বের দশ দিনের ফযীলত
কুরআনে কারীমে এসেছে- وَلَیَالٍ عَشۡرٍ ۙ وَّالشَّفۡعِ وَالۡوَتۡرِ ۙ দশ রাতের এবং জোড় ও বেজোড়ের কসম। (আল ফাজর- ২)।
নির্ভরযোগ্য সনদে হযরত জাবির রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, এটা সেই দশ দিন; যে দিনগুলোর ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা সূরা ফজরে শপথ খেয়েছেন। আর জোড় হল যুলহিজ্জার ১০ তারিখ আর বেজোড় আরাফার দিন, যা যুলহিজ্জার ৯ তারিখ হয়ে থাকে। (মুসনাদে আহমদ- ১৪৫১১ও মুস্তাদরাক হাকেম- ৭৫১৭)।
কাজেই এসব দিনের শপথ করার মাঝে এর বিশেষ গুরুত্ব ও ফযীলতের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। অন্যত্র আল্লাহ তাআলার ইরশাদ— {وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ} আর যাতে তারা নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করে। (সূরা হজ্ব- ২৮)।
ইমাম বুখারী রহ. ইবনে আব্বাস রাযি. ‘র সূত্রে বলেন— উল্লিখিত আয়াতে নির্দিষ্ট দিনসমূহ দ্বারা যিলহজ্বের প্রথম দশ দিন বোঝানো হয়েছে। হাদীসে এসেছে-
হযরত জাবির রাযি. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, দুনিয়ার সবচে মর্যাদাবান দিন হলো যিলহজ্বের প্রথম দশ দিন।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
বলা হলো—আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাও কি এর সমান হতে পারে না? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী ব্যক্তিও; তবে যে ব্যক্তি জিহাদ করতে করতে শহীদ হয়ে যায়, (তার মর্যাদা এই দিনগুলোর চে’ও বেশি।) ইমাম হাইছামী রহ. বলেন, এই হাদীস বর্ণনা করেন ইমাম বাযযার রহ.। এর সনদ হাসান এবং বর্ণনাকারী সবাই বিশ্বস্ত।
হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. হতে বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলার কাছে (যিলহজ্বের) এই দশ দিনের নেক আমল ব্যতীত অধিক প্রিয় কোনো আমল নেই।
সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাও? তিনি বললেন,(হাঁ) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাও; তবে যে ব্যক্তি নিজ সত্তা এবং সম্পত্তি নিয়ে জিহাদ করতে বেরিয়ে কোনোকিছু নিয়ে ফিরে নি (তথা শহীদদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে) সে ব্যতীত। (তিরমিজি, বুখারী)।
দশ দিনের আমল ও করণীয়
হযরত ইবনে উমর রাযি. হতে বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলার কাছে যিলহজ্বের ওই দশ দিন এবং তাতে আমল করার চে’ অধিক মর্যাদাবান কোনো দিন এবং আমল নেই।
সুতরাং তোমরা ওই দিনগুলোতে বেশি বেশি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ও আলহামদু লিল্লাহ পড়ো। (মুসান্নাফু ইবনি আবী শায়বা, সনদ সহীহ)। সহীহ বুখারীতে এসেছে-
হযরত ইবনে উমর এবং আবু হুরায়রা রাযি. এই দশ দিন বাজারে যেতেন এবং তাকবীর পড়তেন। লোকেরাও তাঁদের সঙ্গে তাকবীর পড়ত। (বুখারী)। একটি দুর্বল সূত্রে বর্ণিত হাদীসে এসেছে-
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এই দিনসমূহের একদিন রোজা রাখা এক বছর রোজা রাখার ন্যায় এবং এর এক রাত আমল করা কদরের রাতে আমল করার মতোই ফযীলত। (ইবনে মাজাহ)।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, এই দিনসমূহের একদিনের রোজা একবছর রোজা রাখার মতো। আর এর আমলের প্রতিদান সাতগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে। (বায়হাকী)।
যিলহজ্বের দশ দিন এলে সাঈদ বিন জুবাইর রাযি. (ইবাদাত-বন্দেগিতে) এর উপর অসাধ্য হওয়া পর্যন্ত (তথা সাধ্যের সবটুকু দিয়ে) কঠোর মেহনত করতেন। (দারেমী)।
উম্মে সালামা রাযি. হতে বর্ণিত—রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখবে এবং কুরবানী করার ইচ্ছা করবে, সে যেনো (এই দশদিন) তার চুল ও নখ (কাটা থেকে) বিরত থাকে। (মুসলিম)।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আ’স রাযি. হতে বর্ণিত—রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি কুরবানীর দিনে ঈদ উদযাপন করতে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছি।
আল্লাহ তাআলা দিনটিকে এ উম্মতের জন্যে ঈদ হিসাবে নির্দিষ্ট করেছেন।
এক ব্যক্তি বললো, আমাকে একটু বলুন যে, আমি (আমার প্রতিপালিত) দুগ্ধবতী বা মালবাহী পশু ছাড়া অন্য পশু না পেলে কি তা দিয়েই কুরবানী করবো? তিনি বললেন— না, বরং তুমি তোমার চুল ও নখ কাটবে, গোঁফ ছোট করবে এবং নাভীর নীচের লোম কাটবে। এ কাজগুলোই আল্লাহর নিকট তোমার পূর্ণাঙ্গ কুরবানী। (আবু দাউদ)
বলাবাহুল্য, এ হাদীস থেকে বোঝা যায়, যে ব্যক্তি কোরবানি করার সামর্থ্য রাখবে না, সেও চুল নখ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকবে।
আরাফার দিনের ফযীলত
হযরত আবু কাতাদা (রাযি.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আরাফা দিবসের রোজা বিগত এক বছর ও আগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হবে বলে আল্লাহর প্রতি আমি আশা রাখি। (মুসলিম)।
উল্লেখ্য, এ ফযীলত পেতে আমাদের জন্য ৯ তারিখ তথা আমাদের কুরবানীর আগের দিন উক্ত রোজা উচিত হবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আরাফার দিনের দুআ সর্বশ্রেষ্ঠ দুআ। (তিরমিযী)।
এছাড়া ৯ তারিখের ফজর হতে ১৩ তারিখের আসর পর্যন্ত (মোট 23 ওয়াক্ত) প্রতি ফরয নামাজের পর একবার তাকবিরে তাশরিক বলা প্রত্যেক পুরুষের জন্য উচ্চস্বরে এবং নারীদের নিম্নস্বরে বলা ওয়াজিব। তবে ভুলে গেলে এর কাযা নেই। তাই নামাজের পর বিশেষভাবে স্মরণ রাখা কর্তব্য।
প্রখ্যাত মুফাসসির ইবনে কাসীর রহ. তদীয় তাফসীর গ্রন্থে বলেন, বস্তুত এই দশটি দিবস বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ দিবস। যেমনটা হাদীস থেকে বুঝা যায়। এমনকি এই দিনগুলোর মর্যাদা রমজানের শেষ দশক থেকেও অধিক। কারণ এ দিনগুলোয় নামাজ, রোজা, সদকা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতসমূহ একত্র হয়, যার উদাহরণ অন্যত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। হজ্ব পালন এই দশ দিন অন্যান্য দিনের চে’ বৈশিষ্ট্যময় হবার একটি অনন্য কারণ।
তবে কেউ কেউ বলেন, রমজানের শেষ দশকই অধিক মর্যাদাবান (তথা ফযীলতপূর্ণ)।
আর পরবর্তী উলামায়ে কেরাম এ দুই মতের সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে বলেন, যিলহজ্বের দশ দিন অধিক মর্যাদাবান এবং রমজানের শেষ দশকের রাতগুলো অধিক মর্যাদাবান। তাহলে কার্যত সমস্ত দলীলই অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের আমল করার তাওফীক দান করুন।
– মাওলানা সাঈদ আহমদ, যিম্মাদার- দাওয়াহ ও ইরশাদ বিভাগ এবং সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ