মুন্সি ফয়েজুদ্দিন-এর লেখা বাজাম-ই-আখির (দ্য লাস্ট অ্যাসেম্বলি) থেকে মূল ইংরেজি অনুবাদ করেছেন রানা সাফভি। দিল্লির লালকেল্লার ভেতরে শেষ দুই মোগল সম্রাটের জীবনবৃত্তান্ত ফুটে উঠেছে ফয়েজুদ্দিনের এই লেখায়। তারই সংক্ষিপ্ত অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
আলবিদা বা বিদায়
রমজানের শেষ শুক্রবারকে আলবিদা বলা হতো। দিনটি বেশ গুরুত্বের সাথে পালন করা হতো। বাদশাহ (অর্থাৎ, শেষ দুই মোগল সম্রাট; দ্বিতীয় আকবর শাহ ও বাহাদুর শাহ জাফর) এ দিন আনুষ্ঠানিকভাবে সঙ্গী সমভিব্যাহারে জামে মসজিদে যেতেন। মসজিদের সিঁড়িতেে বাদশাহর রাজকীয় হাওয়াদাটি একটি হাতির পিঠে বসানো হতো। বাদশাহ সেই আসনে বসে মসজিদে প্রবেশ করে অজুখানায় নেমে অজু করতেন। বাদশাহর পরিচারিকরা চেঁচিয়ে সবাইকে তার জন্য পথ তৈরি করার আহ্বান জানাতেন। শাহজাদা ও অন্যান্য সম্ভ্রান্তব্যক্তিরা বাদশাহর পিছে পিছে যেতেন।
নামাজ শুরু হলে ইমামের ঠিক পেছনে বাদশাহর জন্য জায়নামাজ বসানো হতো। তার বামপাশে যুবরাজ এবং ডানপাশে অন্য শাহজাদারা নামাজ পড়তেন। বাদশাহ ইমামকে খুতবা পাঠের জন্য অনুরোধ করতেন। ইমামসাহেব তখন মিম্বরের ওপর উঠে দাঁড়াতেন। দারোগা-ই-কুর (অস্ত্রাগার প্রধান) ইমামের কোমরে একটি তরোয়াল ঝুলিয়ে দিতেন। সেটার হাতলে হাত রেখে খুতবা দিতেন তিনি।
খুতবা শেষ হলে সকল পরলোকগত সম্রাটের নাম স্মরণ করা হতো। বর্তমান বাদশাহর নামের পালা এলে ইমামকে একটি আলখাল্লা দেওয়া হতো। এরপর দোয়া করা হতো। খুতবার পরে জুমা’র দুই রাকাত নামাজ পড়তেন ইমাম সাহেব।
নামাজ শেষে বাদশাহ আসার শরিফে রক্ষিত নবী মোহাম্মদের (স.) স্মৃতিচিহ্নে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতেন। এরপর কেল্লাতে ফিরে যেতেন তিনি।
২৯ রমজানের দিন চাঁদ দেখার জন্য দূত পাঠানো হতো। কেউ চাঁদের দেখা পেলে বা কোনো বার্তাবাহক যদি কোনো গ্রাম থেকে চাঁদ দেখার খবরের স্বাক্ষর করা চিঠি নিয়ে আসত, তাহলেই ঈদের উদযাপন শুরু হয়ে যেত। নকরখানাতে পরের দিনের ঈদ উৎসবের কথা ঘোষণা করতে ২৫ বার তোপধ্বনি করা হতো। সেদিন ঈদের চাঁদ দেখা না গেলে, ৩০ রমজানের দিন তোপধ্বনি করা হতো।
ঈদ-উল-ফিতর
সে রাতেই তোপ, সামিয়ানা, কার্পেট ইত্যাদি জিনিসপত্র ঈদগাহে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। হাতিগুলোর গায়ে আলপনা আঁকা হতো, বিভিন্ন গহনা দিয়ে এগুলোকে সাজানো হতো। সকালবেলা বাদশাহ গোসল সেরে হীরে-জহরত মোড়ানো আলখাল্লা গায়ে চাপতেন। দস্তরখানের ওপর সেমাই, দুধ, মিষ্টি, শুকনো ফল, ও পোলাও পরিবেশন করা হতো। বাদশাহ ওই খাবারগুলো পবিত্র করার কাজটি করতেন। এরপর সবগুলো খাবার তিনি চেখে দেখতেন। মুখ ধুয়ে বাইরে বের হতেন তিনি। বাইরে শিঙা বাজিয়ে বাদশাহর আগমন ঘোষণা করা হতো।
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
ফৌজদার খান হাতিকে হাঁটু গেড়ে বসাতেন। হাওয়াদার আসনটি হাতি থেকে এক ফুট দূরত্বে স্থাপন করা হতো। হাতিতে চড়ে বাদশাহ দিওয়ান-ই-আম-এ রওনা দিতেন। প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে ২১ বার তোপধ্বনি করা হতো। বাদশাহ ও তার সঙ্গীদল ঈদগাহের প্রধানফটকে পৌঁছানোর পর দলটি দুই ভাগ হয়ে যেত। আরেকবার তোপধ্বনি করা হতো। হাতি থেকে নেমে হাওয়াদার-এ আসন গ্রহণ করতেন বাদশাহ। তার পাশে ভবিষ্যৎ দিল্লীশ্বর নালকিতে (পালকি) উপবেশন করতেন। বাকিরা পদব্রজে ঈদগাহে প্রবেশ করতেন।
প্রবেশের পর তার জন্য তৈরি করা বিশেষ তাবুতে প্রবেশ করতেন বাদশাহ। মুয়াজ্জিনের আল্লাহু-আকবর ধ্বনির সাথে সাথে সবাই ইমামের পেছনে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য দাঁড়াতেন। নামাজের পরে বাদশাহ ও ভবিষ্যৎ-সম্রাট বাদে বাকি সবাই উঠে দাঁড়াতেন। ইমামকে খুতবা পাঠের জন্য আহ্বান করা হতো। ইমামের কোমরে একটি তরোয়াল, ও একটি তীর-ধনুক বেঁধে দেওয়া হতো।
এরপর আগের মতোই তরোয়ালের হাতল ধরে খুতবা পাঠ করতেন ইমাম। বাদশাহর নাম ঘোষণা করা হলে ইমামকে একটি আলখাল্লা দেওয়া হতো। নামাজ শেষ হলে খুতবার সম্মানার্থে একবার তোপধ্বনি করা হতো।
নামাজ শেষে কেল্লায় ফেরত যেতেন দিল্লির বাদশাহ। এরপর ময়ুর সিংহাসনে বসে দিওয়ান-ই-খাস পরিচালনা করতেন তিনি। সবার কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করে তাদেরকে মালা ও পাগড়িচিহ্ণ পরিয়ে দিতেন তিনি। এরপর মহলে প্রবেশ করে রূপার সিংহাসনে বসে নারীদের কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করতেন বাদশাহ।
সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট।
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম