।। শায়খ সাঈদ আহমদ ।।
ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে বিস্তৃত বিশ্বাস করতে হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নিআমত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম। (আল-মায়িদাহ ৩)।
ইসলাম যে পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, এটা আজ অনেক নামধারী মুসলমান মানেন না বা বুঝতে চান না। কেউ কেউ পহেলা বৈশাখ বা হিন্দুদের পূজা ও খৃস্টানদের বড়দিন ইত্যাদি আসলে বলেন, ‘উৎসব-সংস্কৃতী সার্বজনীন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার’। অথবা বলেন, ‘সব বিষয়ে ধর্মকে টেনে আনবেন না।’
অথচ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- اَیَحۡسَبُ الۡاِنۡسَانُ اَنۡ یُّتۡرَکَ سُدًی ؕ
মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনিই ছেড়ে দেওয়া হবে? (আল ক্বিয়ামাহ আয়াতঃ ৩৬)।
অর্থাৎ মানুষ কি মনে করে তাকে দুনিয়ায় এমন স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেওয়া হবে যে, সে শরীয়তের কোন আইন-কানুনের আওতায় থাকবে না এবং যা খুশী তাই করতে থাকবে?
হাদীসে এসেছে, তিন প্রকার মানুষ ছাড়া সকলেই সব সময় শরীয়তের আইন-কানুনের আওতায় থাকবে। এ ছাড়া অন্য কারো জন্য ইসলামের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আলী (রাযিঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
তিন ব্যক্তি হতে কলম (শরীয়তের আইন) উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। এরা হলো-
১. নিদ্রিত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়
২. ছোট শিশু যতক্ষণ না সে বালেগ হয় এবং
৩. পাগল যতক্ষণ না সে সুস্থ হয়। (আবু দাউদ ৪৩৫১, পারিভাষিক সহীহ)।
সুতরাং উক্ত তিন প্রকার মানুষ ছাড়া আর কারো জন্য কোন ক্ষেত্রেই গুনাহের কলম বন্ধ হবে না এবং ইসলামের বাইরে যাওয়া যাবে না। তাই মুসলিম-মুমিন দাবিকারী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামকে টেনে আনা আবশ্যক।
এ জন্যই আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে আদেশ দিয়ে বলেন-
হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে-সম্পূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ অনুসরণ কর না। (আল-বাকারা, আয়াত: ২০৮)।
আয়াতটির শানে নুযুল:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ছালাম, ছা’লাবা ইবনে এয়ামীন, আছাদ প্রমূখ ইহুদী হতে মুসলমান হয়েছিলেন। কিন্তু পুরাতন ধারণার ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বলেন, আমরা ইহুদী থাকা অবস্থায় শনিবারের দিনকে সম্মান করতাম, এখন মুসলমান হওয়ার পরও আমাদেরকে শনিবার দিনকে সম্মান করার অনুমতি দিন। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। (বয়ানুল কোরআন)।
আরও পড়তে পারেন-
- ইবাদতের গুরুত্ব নিয়ে ঠাট্টা-তাচ্ছিল্য জঘন্য গুনাহ
- উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং মুসলিমবিদ্বেষ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য হুমকি
- ‘ইবাদুর রাহমান’ বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বিশেষ ১২টি গুণ
- মৃত্যুর স্মরণ জীবনের গতিপথ বদলে দেয়
- যে কারণে হিন্দুত্ববাদের নতুন নিশানা ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’
সুতরাং আকীদা-বিশ্বাসে, চিন্তা-চেতনায়, দেহ-মনে, পরিবার-সমাজে, লেনদেন-কায়কারবারে, সংস্কৃতী-উৎসবে, বন্ধুত্ব-শত্রুতায়, বিচার-শাস্তিতে, শিক্ষানীতি-রাজনীতিতে ও রাষ্ট্র পরিচালনা সহ সব ক্ষেত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, সর্বাত্মকভাবে ইসলামে প্রবেশ কর। কুরআন-সুন্নাহয় যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তারই অনুসরণ কর।
এর বাইরে অন্য কোন ধর্ম, ইজম, নীতি ও মত-পথ থেকে কিছু গ্রহণ করা বা মনগড়া রীতি-নীতি, বিদআত ও কুসংস্কার ইত্যাদি অনুসরণ করার মানসিক দুর্বলতা সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেল।
কেননা ইসলামের বিপরীত বাকি সব শয়তানের পথ। অন্য আয়াত ও হাদীসে এসেছে-
এটা আমার সরল-সঠিক পথ। সুতরাং তোমরা এর অনুসরণ কর। এছাড়া বিভিন্ন পথ/অন্য কোনও পথের অনুসরণ করো না, করলে তা তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এসব বিষয়ে আল্লাহ তোমাদেরকে গুরুত্বের সাথে আদেশ করেছেন, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (আল আনআম, আয়াত- ১৫৩)।
অর্থাৎ সব ক্ষেত্রে ইসলামই ‘সিরাতে মুসতাকীম’ (সরল পথ)। এ পথের কোন বিকল্প নেই। সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ কর। এ ছাড়া অন্য কোন ধর্ম বা আদর্শ অবলম্বন করলে, অন্য কোন পথে চললে সরল পথ হতে বিচ্যুত হয়ে যাবে এবং আল্লাহর পথ হারিয়ে শয়তানের পথে চলে যাবে।
হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন-
একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সরল রেখা টেনে বললেন, (মনে কর) এটি আল্লাহর পথ। তারপর সে রেখার ডানে-বামে আরও অনেকগুলো রেখা টানলেন। তারপর বললেন, এগুলো অন্যান্য পথ। যার প্রত্যেকটিতে শয়তান দাঁড়িয়ে সেই পথগুলোতে চলার জন্য (মানুষকে) আহবান করছে। তারপর তিনি এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। (মুসনাদে আহমদ ৪১৪২, সনদ হাসান)।
এছাড়া বিধর্মী ও বিজাতিদের সাথে সাদৃশ্য ও সাযুজ্যস্থাপন করতে কোরআনে কারীমে নিষেধ এসেছে এবং কঠিন ধমকি এসেছে হাদীস শরীফে।
ইরশাদ হয়েছে- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا تَقُولُوا رَاعِنَا وَقُولُوا انْظُرْنَا وَاسْمَعُوا وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٌ. (আল-বাকারা ১০৪)।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবনে কাছীর দামেশকী (রহ. মৃত্যু ৭৭৪ হি.) ও বদরুদ্দীন আইনী (রহ. মৃত্যু ৮৫৫ হি.) বলেন- نهي الله تعالي المؤمنين أن يتشبهوا بالكافرين في مقالهم وأفعالهم.
আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে কাফেরদের সাথে কথা ও কাজে সাদৃশ্যস্থাপন করতে নিষেধ করেছেন। (তাফসীর-ইবনে কাসীর ও উমদাতুল কারী ২৬/৩৯৬)।
সহীহ হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতি ঘোষণা করে ইরশাদ করেন-
হযরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কোন ব্যক্তি যে জাতি বা সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য স্থাপন করবে, ওই ব্যক্তি সেই জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে গণ্য হবে। (আবু দাউদ, ৪০৩১, হাদীসটি সহীহ)।
দারুল উলুম দেওবন্দের সাবেক মুহতামিম কারী তৈয়্যব সাহেব (রহ.) (মৃত্যু ১৪০২ হি.) “আত-তাশাব্বুহ ফিল ইসলাম” গ্রন্থে বলেন, “উক্ত হাদীস দ্বারা একথাই সুস্পষ্ট হয় যে, বিজাতীয় অনুকরণ ও সাদৃশ্য স্থাপন, চিন্তাধারা, অনুভূতি ও সৃষ্টিগত দিক দিয়ে যেমন নিজ অস্তিত্বকে বিলুপ্ত করার মাধ্যম, তেমনি শরীয়তের দিক থেকেও তা জীবনবিধানকে ধ্বংস করার একটি কার্যকর পন্থা।
তিনি আরো বলেন, প্রত্যেকটি জিনিস তা শরীয়ত বিষয়ে হোক বা অনুভূতি ও আদর্শগত বিষয়ে হোক, নিজের সত্তা ও অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত ও স্থিতিশীল রাখার জন্য ‘অপরের অনুকরণ ও সাদৃশ্য বর্জন’ নীতির মুখাপেক্ষী।
অন্যথায় সেই সত্তা অবশিষ্ট থাকে না, যা বর্তমানে বিদ্যমান; বরং সে যার সাথে সাদৃশ্য স্থাপন করেছে তার মধ্যে চেহারা-ছুরতে, আচার-আচরণে ও সামাজিক গণনায় অন্তর্ভুক্ত হয়।”
আর ইসলামে নামাজ, রোযা, হজ, যাকাত ও সূফিবাদের বয়ান যেভাবে আছে, তেমনিভাবে গুরুত্বের সাথে বিস্তৃতকারে আলোচিত হয়েছে মুয়াশারা তথা সহাবস্থান ও সমাজ জীবনের বিধি-বিধান ও নীতিমালা। তন্মধ্যে পোশাক-পরিচ্ছেদ, উৎসব-বিনোদন, শিল্প-সংস্কৃতী অন্যতম।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে বিস্তৃত বিশ্বাস গ্রহণ করে আমলের তাওফীক দান করুন।
লেখক: তরুণ আলেমে-দ্বীন, লেখক ও ইসলামী গবেষক এবং সিনিয়র শিক্ষক, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ