।। মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী ।।
হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মি’রাজ মানব জাতির ইতিহাসে অপরিসীম তাৎপর্যময় একটি ঘটনা। আরবী ‘আরাজ’ ধাতুজাত মি’রাজ শব্দের অর্থ হচ্ছে- সিঁড়ি, ঊর্ধ্ব গমন বা আরোহণ ইত্যাদি।
ইসলামী পরিভাষায় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কার পবিত্র মাসজিদুল হারাম থেকে জেরুজালেমের পবিত্র মাসজিদুল আক্বসায় উপনীত হওয়া এবং সেখান থেকে ঊর্ধ্বা-কাশসমূহ ভ্রমণ, সৃষ্টি-নিদর্শনসমূহ অবলোকন এবং মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের সান্নিধ্য লাভের অভূতপর্ব ঐতিহাসিক ঘটনাই মি’রাজ।
পবিত্র কুরআন এবং পবিত্র হাদীস গ্রন্থসমূহে মি’রাজের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও বিবরণ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা বনী ইসরাঈল ও সূরা নাজ্মে মি’রাজের বর্ণনা রয়েছে।
সূরা বনী ইসরাঈলে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন- “পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ তিনি করেছিলেন বরকতময়। তাঁকে তাঁর নিদর্শনসমূহ দেখাবার জন্য। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা”।
আর সূরা নাজমে হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঊর্ধ্বাকাশে যেসব নিদর্শন অবলোকন করেছিলেন, তন্মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন, “সে তো তাঁর প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলী দেখেছিল”।
পবিত্র হাদীস গ্রন্থসমূহে মি’রাজের ঘটনাবলীর যে বিবরণ দেয়া হয়েছে সংক্ষেপে তা এই- এক রাতে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাচা আবু তালিবের কন্যা উম্মে হানীর ঘরে নিদ্রামগ্ন ছিলেন। হযরত জিব্রাঈল (আ.) তাঁর কাছে আগমন করেন এবং তাঁকে পবিত্র কা’বা প্রাঙ্গণে নিয়ে যান। সেখান থেকে হযরত জিব্রাঈল (আ.)এর সঙ্গে বুরাকে আরোহণ করে বাইতুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত যান। অতঃপর তিনি বুরাকটি অদূরে বেঁধে রেখে বাইতুল মুক্বাদ্দাসের মসজিদে প্রবেশ করেন এবং ক্বিবলার দিকে মুখ করে দু’রাকআত তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামায আদায় করেন। নামায শেষে ঊর্ধ্বাকাশসমূহ ভ্রমণ শুরু করেন।
প্রতিটি আসমানের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ কালে তিনি পর্যায়ক্রমে হযরত আদম (আ.), হযরত ঈসা (আ.), হযরত ইউসুফ (আ.), হযরত ইদ্রীস (আ.), হযরত মূসা (আ.) এবং হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর সাক্ষাত লাভ করেন। এরপর তিনি বেহেস্ত ও দোযখ পরিদর্শন করেন। অতঃপর তিনি উপনীত হন সিদরাতুল মুন্তাহায়।
এখানেই তিনি মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনকে অবলোকন করেন তাঁর অনন্ত অনির্বচনীয় মহিমায়, পূর্ণ সৌন্দর্যে ও সুষমায়। এই নিকট সান্নিধ্যকালে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। সূরা নাজ্মে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে- “অতঃপর সে তাঁর আরও নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাঁদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল অথবা তারও কম। তখন আল্লাহ্ তাঁর বান্দার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করার তা করলেন”।
এই হলো পবিত্র কুরআন ও পবিত্র হাদীস অনুযায়ী মি’রাজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এই বিবরণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মি’রাজ করানোর পেছনে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের লক্ষ্য ছিল, তাঁর প্রিয়তম বান্দা ও রাসূলকে ঊর্ধ্বাকাশসমূহে বিদ্যমান তাঁর অপার রহস্যভরা সৃষ্টির নিদর্শনসমূহ অবলোকন করানো এবং তাঁর নিকটতম সান্নিধ্য দান করা। মানুষ যে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাত, মানবকুল শিরোমণি হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঊর্ধ্বাকাশ ভ্রমণের সুযোগ দিয়ে তিনি সে কথাই মানব জাতিকে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
মি’রাজের একটি বড় নিয়ামত হল- সেই রাতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে স্বীয় বান্দার জন্য দৈনিক ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামায’-এর বিধান জারি করা। ইবাদতসমূহের মধ্যে নামাযের স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপর্ণ ও তাৎপর্যময়। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি সাধন, নৈকট্য অর্জন এবং পবিত্রতম জীবন-যাপনের জন্য নামাযের গুরুত্ব ও ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযকে মু’মিনের জন্য মি’রাজ বলে বর্ণনা করেছেন। এতে মি’রাজ ও নামাযের সম্পর্কের দিকটিই কেবল প্রতিভাত হয়ে ওঠেনি, নামাযের গুরুত্ব ও তাৎপর্যও প্রতিফলিত হয়েছে।
মি’রাজ একটি বাস্তব ও ঐতিহাসিক ঘটনা। মি’রাজের এই সুযোগ আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মাত্র একজনকে দান করেছেন, যিনি সৃষ্টি জগতের রহ্মত স্বরূপ এবং আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম রাসূল। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মানব জাতিকে তাঁরই অনুকরণ-অনুসরণ করতে বলেছেন।
মি’রাজ সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা স্বয়ং এবং তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন, তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা প্রতিটি মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। মি’রাজ মানব জাতিকে যে শিক্ষা দিয়েছে সেই শিক্ষা অনুসরণ করার মধ্যে রয়েছে মঙ্গল ও কল্যাণ। সৃষ্টিকুল আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের নিদর্শনসমূহের বাগান। এই নিদর্শনসমূহ অবলোকন ও অনুধাবনের মধ্য দিয়ে মানুষ আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠতে পারে, নিজের ও অপরের মঙ্গল ও কল্যাণকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে তাঁর নিকটতম সান্নিধ্য অর্জন মানব জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আর এই লক্ষ্য অর্জন যে অসম্ভব নয় মি’রাজ সেই শিক্ষাই আমাদের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মি’রাজের শিক্ষা আমাদের জীবনকে আলোকিত করুক, অপার করুণায় আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে তাঁর নৈকট্য দান করুন, এই আমাদের কামনা।
লেখকঃ মুহাদ্দিস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা ঢাকা, খতীব- তিস্তা গেট জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর, উপদেষ্টা- উম্মাহ ২৪ ডট কম এবং কেন্দ্রীয় অর্থসম্পাদক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। ই-মেইল- muftijakir9822@gmail.com
উম্মাহ২৪ডটকম:এমএমএ