Home ইসলাম নবীযুগে বিভিন্ন ফরমানে হাদিস সংরক্ষণ

নবীযুগে বিভিন্ন ফরমানে হাদিস সংরক্ষণ

।। মুফতি মাহমুদ হাসান ।।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে তাঁর নির্দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে ফরমান পাঠানো হয়। সেগুলোতে লিখিতভাবে হাদিস সংরক্ষণ করা হয়। নিম্নে এমন কিছু ফরমান উল্লেখ করা হলো—

মদিনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের অধিবাসীদের জন্য লিখিত সনদ

হিজরতের পর নবী (সা.) একটি নীতিমালা লিপিবদ্ধ করিয়েছিলেন, যা ‘মদিনা-সনদ নামে পরিচিত। এতে মুহাজির ও আনসারি সাহাবিদের দায়িত্ব ও অধিকার, মদিনা ও আশপাশের আরব ও ইহুদি গোত্রসমূহের সঙ্গে মিত্রতা এবং নাগরিক ও সামাজিক বিধানাবলি উল্লিখিত হয়েছিল।

এই দলিলের বিভিন্ন অংশ হাদিসের প্রসিদ্ধ কিতাবসমূহে সনদসহ বর্ণিত হয়েছে। (দেখুন : সহিহ মুসলিম : হাদিস ১৫০৭; সুনানে নাসাঈ : হাদিস ৪৮২৯)
পূর্ণ দলিলটিও হাদিস, সিরাত ও ইতিহাসের বিভিন্ন গ্রন্থে সংরক্ষিত আছে।

হুদায়বিয়ার সন্ধি

ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে এই সন্ধি লিপিবদ্ধ হয়েছিল। এর বিভিন্ন অংশ সহিহ বুখারিসহ বিভিন্ন হাদিসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। (দেখুন : সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪২৫১, ২৬৯৮)

পূর্ণ সন্ধিপত্রটির জন্য দেখুন : সিরাতে ইবনে হিশাম, আররওযুল উনুফ : ৬/৪৬২-৪৬৪

নাজরানবাসীকে প্রদত্ত ফরমান

নাজরানবাসী খ্রিস্টানদের ওপর রাসুল (সা.) যে ফরমান পাঠান, তাতে তাদের সব শস্য ও সম্পদের বিপরীতে নির্ধারিত জিজিয়া কর আরোপ করা হয় এবং তাদের জান-মাল ও উপাসনালয়ের পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হয়। প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ও তাতে আছে। (পূর্ণ দলিলটি দেখুন : কিতাবুল খারাজ, আবু ইউসুফ পৃষ্ঠা ৪১; কিতাবুল আমওয়াল, আবু উবায়দ, পৃষ্ঠা ২৪৪-২৪৭)

আরও পড়তে পারেন-

আয়লাবাসীকে প্রদত্ত ফরমান

তাবুকের নিকটবর্তী একটি প্রাচীন জনপদ আয়লা। নবম হিজরিতে তাবুক-অভিযানে আয়লার শাসক ইউহান্না ইবনে রুবা নবী (সা.)-এর আনুগত্য স্বীকার করে জিজিয়া কর প্রদানে সম্মত হন। সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমসহ হাদিসের বিভিন্ন কিতাবে উল্লিখিত হয়েছে যে সে সময় নবী (সা.) একটি লিখিত দলিল প্রদান করেছিলেন। (দেখুন : বুখারি হাদিস ১৪৮১; ৩১৬১; মুসলিম : হাদিস ১৩৯২/১১-১২; পূর্ণ

দলিলটির জন্য দেখুন : সিরাতে ইবনে হিশাম, আররওজুল উনুফ : ৭/৩১৭)

তদ্রুপ ইসলাম গ্রহণকারী বহু গোত্রকে নবী (সা.) লিখিত দলিল প্রদান করেছিলেন। এসব দলিলে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং নবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে ‘আমান’ ও ‘জিম্মা’ লিপিবদ্ধ থাকত।

কিতাবুস সাদাকা

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, নবী (সা.) ‘কিতাবুস সাদাকা’ লিপিবদ্ধ করালেন; কিন্তু বিভিন্ন অঞ্চলের প্রশাসকদের কাছে পাঠানোর আগেই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়। এটা তাঁর তরবারির সঙ্গে খাপবদ্ধ ছিল। তাঁর ইন্তেকালের পর আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এই অনুযায়ী আমল করেছেন। তাঁর পর ওমর (রা.)। ওমর (রা.)-এর ওফাতের পর এই মূল্যবান দলিল তাঁর সন্তানদের কাছে সংরক্ষিত ছিল। (তিরমিজি ১/৭৯, আবু দাউদ ১/২২০)

বনু জুহাইরের প্রতি নির্দেশনামা

আবুল আলা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনুশ শিখখির (রা.) বলেন, ‘আমরা (বসরার) মির্বাদ নামক স্থানে ছিলাম। আমাদের কাছে একজন বেদুঈন এলো। তার কাছে ছিল এক খণ্ড চামড়া। সে তা বের করে বলল, তোমাদের কেউ কি এই দলিল পাঠ করে শোনাতে পারে? তাতে লিখিত ছিল—

‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহর পক্ষ থেকে উকলের বনু জুহাইর ইবনে উকাইশের জন্য। তোমরা যদি সাক্ষ্য দাও যে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল এবং নামাজ আদায় করো, জাকাত প্রদান করো, মুশরিকদের থেকে দূরে থাকো, গনিমতের সম্পদ থেকে এক-পঞ্চমাংশ ও নবীর অংশ প্রদান করো, তাহলে তোমাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে আমান (নিরাপত্তা)। ’ (মুসনাদে আহমদ ৫/৭৭-৭৮, আবু দাউদ : হাদিস ২৯৯২)

নির্ভরযোগ্য ইতিহাস ও জীবনী-গ্রন্থেও এরূপ অনেক দলিলের বিবরণ আছে।

দুমাতুল জান্দালবাসীর প্রতি নির্দেশনামা

দুমাতুল জান্দালের গোত্রপতি উকাইদির ইবনে আবদুল মালিককে একটি লিখিত ফরমান প্রদান করা হয়েছিল। (ইসাবা ১/২৪৫)

আবু উবায়দ কাসিম ইবনে সাল্লাম (রহ.) বলেন, ‘একজন শায়খ আমার কাছে এই দলিল নিয়ে এসেছিলেন। আমি তা পাঠ করেছি এবং হুবহু নকল করেছি। দলিলটি সাদা চামড়ায় লিখিত ছিল। ’ (দেখুন : আল আমওয়াল ২৫২-২৫৩)

ইয়েমেনবাসীর প্রতি নির্দেশনামা

ইয়েমেন বিজিত হওয়ার পর নবী (সা.) ওই অঞ্চলের শিক্ষক ও প্রশাসক হিসেবে আমর ইবনে হাজম (রা.)-কে প্রেরণ করেছিলেন। ইয়েমেনের অধিবাসীদের দ্বিন ও ঈমান শিক্ষাদানের দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত ছিল। সে সময় নবী (সা.) দ্বিনের গুরুত্বপূর্ণ বিধি-বিধানসংবলিত একটি লিখিত দলিল তাকে প্রদান করেন। এতে তাকওয়া-পরহেজগারির নির্দেশ এবং দাওয়াত-তালিম বিষয়ে নির্দেশনা ছাড়াও পবিত্রতা, সালাত, জাকাত, উশর, হজ-ওমরাহ, জিহাদ, গনিমত, দিয়াত, কোরআন মজিদ স্পর্শ করার জন্য পবিত্রতা প্রসঙ্গ এবং গোত্রীয় সংকীর্ণতার নিষিদ্ধতার প্রসঙ্গ ছিল। আমর ইবনে হাজম (রা.)-এর ইন্তেকালের পর এই মূল্যবান দলিল তাঁর পৌত্র আবু বকর ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে হাজমের কাছে সংরক্ষিত ছিল। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈন এই দলিলটিকে সুন্নতে নববীর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র মনে করতেন। (কিতাবুল মারিফাহ ওয়াত তারিখ ২১৬; আততালখিসুল হাবির ২/৪/১৮)

মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)-কেও পরবর্তী সময়ে ইয়েমেনে প্রেরণের সময় নবী (সা.) আরেকটি লিখিত দলিল প্রদান করেন, যাতে সদাকা ও অন্যান্য বিষয়ের বিধান ছিল। পরে এই দলিল বা তার নকল বিখ্যাত তাবেঈন মুসা ইবনে তলহা (মৃত্যু : ১০৩ হি.)-এর কাছে সংরক্ষিত ছিল। (দেখুন : মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক : হাদিস : ৭১৮৭)

তদ্রুপ নির্ভরযোগ্য ইতিহাস-গ্রন্থ ও জীবনী গ্রন্থে এ ধরনের আরো অনেক নির্দেশনামা, সন্ধিনামা ও নিরাপত্তানামার নমুনা বিদ্যমান আছে। ড. হামিদুল্লাহ (রহ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রাজনৈতিক ফরমানাদির একটি সংকলন প্রস্তুত করেন, যেখানে তিন শতাধিক ফরমান তিনি হাদিস ও সিরাতগ্রন্থ এবং ইতিহাসের পাতা থেকে খুঁজে বের করেন। আমরা উদাহরণস্বরূপ ওপরের কয়েকটি উল্লেখ করলাম।

এসব ফরমান প্রমাণ করে যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে বিভিন্নভাবে গুরুত্বপূর্ণ হাদিস ও নববী নির্দেশনা লিখিতভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছিল।

লেখক : শিক্ষক, ইসলামিক রিসার্চ

সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।