আব্দুল্লাহ: দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী’র দাওরায়ে হাদীস (আরবী-মাস্টার্স) সমাপনী বর্ষের তরুণ আলেমদের ‘মুসলিম শরীফ” প্রথম খণ্ডের আখেরী দরস গতকাল (২৫ জানুয়ারী) বৃহস্পতিবার বেলা ২টায় অনুষ্ঠিত হয়েছে।
দরস পরিচালনা করেছেন জামিয়ার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও মুফতি আল্লামা কিফায়াতুল্লাহ। এ সময় পুরো দারুল হাদীস মিলনায়তন কানায় কানায় ভরপুর ছিল।
‘মুসলিম শরীফ’ প্রথম খণ্ডের সিলেবাসের শেষ হাদীসের দরস শেষে আল্লামা মুফতি কিফায়াতুল্লাহ (দা.বা.) বিদায়ী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে দিক-নির্দেশনা ও উপদেশমূলক প্রায় দেড় ঘন্টাব্যাপী বয়ান করেন। এ সময় পুরো দারুল হাদীস মিলনায়তন জুড়ে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছিল এবং আড়াই হাজার তারুণ আলেম আবেগঘন পরিবেশে গভীর মনোযোগের সাথে বয়ান শুনছিলেন।
আল্লামা মুফতি কিফায়াতুল্লাহ (দা.বা.) তরুণ আলেমদের উদ্দেশ্যে দিক-নির্দেশনামূলক যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার চুম্বাকাংশ নিম্নে পত্রস্থ করা হল-
“আমাদের আজকের সবক ফাযায়েলে কুরআন নিয়ে। মুসলিম শরীফ প্রথম খন্ডের এটিই শেষ সবক। আজকের আলোচনা কুরআন নিয়ে। তবে এটি শুধু নিচক সবক হিসেবে কিতাবের আলোচনা নয়। শুধু ইলমী বাহাস নয়। বরং সবকের সাথে এখানে থাকবে তোমাদের প্রতি শেষ সবকের শেষ নসিহতটুকু। আমি চাই এটি তোমাদের আগামী জীবনের পাথেয় হোক। চলার পথের মশাল হোক।
কুরআন পরিচয় কুরআনের ভাষায়
কুরআনের ফাযায়েল বলে শেষ করার নয়। কুরআন নিজেই নিজেই পরিচয় দিয়েছে। বিভিন্নভাবে; বিভিন্ন আঙ্গিকে। কখনো কুরআন পরিচয় দিয়েছে কিতাবে মুবিন হিসেবে। আবার কখনো পরিচয় দিয়েছে কিতাবে হাকীম বলে। কখনো আবার কুরআন নিজ পরিচয় তুলে ধরেছে বুশরা বলে রহমত বলে। এভাবে কুরআন আরো আরো নানা পরিচয়ে নিজেকে তুলে ধরেছেন। আকৃষ্ট করেছেন তার দিকে।
কূলহীন জ্ঞানের অথৈ সাগর কুরআন
কুরআন স্রষ্টার বাণী। কুরআন রবের কালাম। কুরআন কূলহীন জ্ঞানের অথৈ সাগর। প্রজ্ঞা ও হিকমতের আধাঁর এই কুরআন। প্রকৃত পক্ষে কুরআন তার মাঝে এত কিছু ধারণ করে আছে, যা বহন করার সাধ্য কারো নেই। কুরআন সকল জ্ঞানের আধাঁর। কুরআন সকল সমস্যার সমাধান।
যার বিষয়াবলী অতি বিস্তৃত। যার বর্ণনা অতি সুক্ষ। যার জ্ঞান খুবই গভীর। যার কোন অন্ত নেই। সীমা নেই। স্তর; তার উপর আরো স্তর। এভাবে শুরু হয় তবে শেষ আর হয় না। সর্বোপরি সত্যিই কুরআন এক মহাগ্রন্থ। মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে। তিনি যেমন মহান, তাঁর প্রতিটি কথাই মহান। তাঁর বাণীর ভার ও ওজন, ভাব ও বর্ণনা, মাহাত্ম ও বড়ত্ব, প্রশস্ততা ও গভীরতা ভাষা ও বর্ণনার ঊর্ধ্বে। বহু ঊর্ধ্বে। তবে হ্যাঁ, কিছু আঁচ করা যায়।
আল্লাহ তায়ালা ইর রশাদ করেন-
আয়াতের ভাবার্থ নিম্নরূপ- আমি যদি এই কুরআন পাহাড়ের উপর অবতীর্ণ করতাম এবং তার মাঝে কিছুটা বোধশক্তি দিয়ে দিতাম, আর সে তা দ্বারা যতটুকু উপলব্দি করার করতো, এতে আল্লাহর বড়ত্ব ও মাহাত্মের যে ছিঁটেফোটা অনুভূতি তার জন্মাতো, মহান রবের যেটুকু পরিচয় তার নিকট উদঘাটন হত, আল্লাহর আজাব গজবের যে ভয় তাকে আচ্ছন্ন করত, যা প্রকৃত বাস্তবতার তুলনায় একেবারে নগন্যই হতো। কিন্তু তারপরও এটুকুও তার পক্ষে বরদাশত করা কিছুতেই সম্ভব হতো না। আর তুমি দেখতে পেতে এই বিশাল পাহাড় কীভাবে আল্লাহর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে চৌচির হয়ে পড়ত। আর চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেত মাটিতে নিজের অস্তিত্ব মিটিয়ে দিত।
আর হে মানুষ সকল! শুনে রাখ, কেন আমি এই সব উদাহরণ তোমাদেরকে পেশ করি। এসব উদাহরণ এই জন্য যেন তোমাদের অনুভূতি একটু জাগ্রত হয়। তোমরা একটু চিন্তা কর। একটু বিবেচনা কর। একটু বুঝতে চেষ্টা কর। কি করা উচিত। কীভাবে বিলীন হতে হবে তোমাদের। আমার জন্য। আমার হুকুমের জন্য। এ শিক্ষা যাতে তোমরা নাও। এজন্যই এই উদাহরণ পেশ করা।
সচ্ছ একটি আয়না ‘কুরআন’
কুরআন একটি আয়না। সচ্ছ আয়না। কুরআন তুলে ধরেছে কি তোমার পরিচয়। কে তুমি। কি তোমার দায়িত্ব। কি তোমার কর্তব্য। কি হবে তোমার পরিণতি। কি হবে তোমার ভবিষ্যৎ। কিসে তোমার কল্যাণ। কিসে তোমার ধ্বংস। কিছুই বাদ পড়েনি। সব একেবারেই সব বলে গেছে এই কুরআন তন্য তন্য করে। খুলে খুলে। সঠিকভাবে। সহজভাবে। সবলীল ভাষায়।
কুরআন জীবন ঘনিষ্ঠ এক সংবিধান
কুরআন একটি জীবন ঘনিষ্ঠ সংবিধান। মানব জীবনের যাবতীয় উত্থান পতন অনুকূল প্রতিকূল সর্বাবস্থার বর্ণনা দিয়েছে। কুরআন বক্তব্য রেখেছে মানবের কর্ম নিয়ে। মানবের ধর্ম নিয়ে। মানবের বিশ্বাস নিয়ে। মানবের মানসিকতা নিয়ে। মানবের অস্থিরতা নিয়ে। মানবের ভাবনা নিয়ে।
স্রষ্টা নিয়ে, সৃষ্টি নিয়ে, জগত নিয়ে। এ সবের যাবতীয় সংশয়, আপত্তি এবং তার সঠিক ও বাস্তবমূখী উত্তর নিয়ে। ইহকালের বাস্তবতা, পরকালের যথার্থতা নিয়ে। আরো আরো মানব জীবনের যাবতীয় অঙ্গন নিয়ে।
কুরআনই সকল বিষয়ের মৌলিক উৎসধারা
কুরআনী একটি সুপার পাওয়ার হাউজ। এটি দ্বীনের যাবতীয় জ্ঞানে ভর্তি; টইটম্বুর। এখান থেকেই সিঞ্চিত হয় দ্বীনের সকল শাখা। যে যতটুকু এ থেকে পিছলে যাবে দ্বীন ও হক্ব, কল্যাণ এবং সফলতা থেকে সে ঠিক ততটুকুই ছিটকে পড়বে।
দ্বীন যেন বিস্তৃত সুবিশাল ফলবান এক বৃক্ষ। বৃক্ষের জীবন নির্ভর করে আলো, বাতাস, পানি ইত্যাদি সরবরাহের উপর। দ্বীন নামক ফলবান বৃক্ষটির বেঁচে থাকার যাবতীয় উপকরণ এই কুরআন থেকেই নির্গত ও নিসৃত। যে শাখা বা যে ব্যক্তির এই সরবরাহ কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবে ধীরে ধীরে তা সজীবতা হারাবে। এক সময় তার মৃত্যু হবে। শুকিয়ে কাষ্ঠে পরিণত হবে। ঘুণে ধরে তার অস্তিত্বকে বিনাশ করবে। হারিয়ে ফেলবে তার সবকিছু। ধ্বংস হবে তার এপার, ওপার ও সবই। নিক্ষিপ্ত হবে উনুনে। শেষ ঠিকানা হবে আগুনে। পরিণত হবে জাহান্নামের ইন্ধনে।
কুরআনের সাথে দ্বীনের সকল শাখা প্রশাখার নাড়ির সম্পর্ক। কেন্দ্রের সম্পর্ক। এখান থেকেই নির্র্দেশিত হয় দ্বীনের সকল কিছু। কুরআনই নির্ধারণ করে দিবে তোমার চলার গতি। কুরআনই বাতলে দিবে তোমার যাবতীয় ত্রুটি বিচ্যুতি। কুরআন একটি স্কেল, যা পরিমাপ করে দিবে দ্বীনের প্রতিটি বিষয়ের সীমারেখা। কুরআন একটি কষ্টি পাথর, যার পরশেই বেরিয়ে আসবে আসল আর নকল। কুরআন একটি স্বচ্ছ আয়না, যার মাঝে ভেসে উঠবে শরীয়তের বাস্তব নমুনা।
হাদীস
মানব জীবনের যাবতীয় দিক নির্দেশনা দিয়েছে আল কুরআন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা আরো ব্যাখ্যা করে আরো খুলে তুলে ধরেছেন উম্মতের সামনে। দ্বীনকে স্বচ্ছ শ্বেত পাথরের মতই পরিস্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন উম্মতকে। বাস্তব জীবনের সর্বক্ষেত্রে তার বাস্তবায়ন করে গেছেন। রেখে গেছেন উম্মতের জন্য উত্তম আদর্শ। নববী সীরাতের প্রতিটি অধ্যায় কুরআনী নির্দেশনার জ্বলন্ত মূর্ত প্রতিক।
ইলম ও উলামা
যুগে যুগে উম্মাহর শ্রেষ্ঠ সন্তানগণ আকঁড়ে ধরেছেন এই আদর্শকে। জীবনকে বিলিয়ে দিয়ে ইসলামের বৃক্ষকে রেখেছেন চির সজীব। জীবন বাজি রেখে দ্বীনের এই পতাকা উড্ডীন করেছেন আল্লাহর এই ভূখন্ডে। সময়ের প্রয়োজনী দ্বীনের সঠিক ও বাস্তবমুখী রূপ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরে উম্মাহকে চির ঋণী করে গেছেন তারা। এই ঋণ কিছুতেই শোধ হবার নয়।
তোমাদের করণীয়
হে আমার প্রিয় ছাত্ররা! তোমারাও মাদারাসায় ভর্তি হয়ে সেই কাফেলায় যুক্ত হতে এসেছ। এসেছ মিলিত হতে সেই সৌভাগ্যশীল জামাতের সাথে। নিজেকে কুরবান করতে দ্বীনের জন্য। নিজেকে উৎসর্গ করতে হক্বের জন্য। এই জন্য প্রয়োজন কুরআনের সাথে তোমাদের সুদৃঢ় আত্মার বন্ধন। কুরআনী এই সেতু বন্ধন ধরে তোমরা নিজেরাও বুঝে নিবে কুরআনের বিষয়বস্তুকে। বোধগম্য করবে কোরআনকে। তুলে ধরবে উম্মাহর সামনে তার আবেদন। তুলে ধরবে মানবতার সামনে তার বক্তব্য। মৃত্যু পর্যন্ত অবিচল থাকবে কুরআনের উপর। হক্বের উপর। সত্যের উপর।
দ্বীনের পূর্ণ বুঝ তোমার অর্জন করতে হবে
দ্বীনকে তোমাদের বুঝতে হবে তার সঠিক আকৃতিতে। দ্বীনের গভীর জ্ঞান তোমাদের অর্জন করতে হবে। রুসূখ ফিল ইলম তোমাদের আসতে হবে। দ্বীনের রঙ্গে রঙিন হতে হবে তোমাদের ভেতরটা। অন্তরটা তোমাদের ভরে যেতে হবে দ্বীনের সুবাসে। বাহ্যিকটাতো দ্বীনের সাজে সাজাবেই। দ্বীনের মৌলিক বিষয়াবলীকে পূর্ণ পরিপক্কতা ও বসিরতের সাথে জানতে হবে।
দ্বীন ও শরীয়তের প্রতিটি কাজকে, প্রতিটি হুকুম আহকামকে তার অবস্থানে রাখতে হবে। না এক্ষেত্রে অতিরঞ্জন করা চলবে, আর না শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে। মৌলিক বিষয়কে মূল হিসেবে জানতে হবে। গৌণ বিষয়াবলীকে গৌণ জেনেই আমলে আনতে হবে।
আর এই সব নির্দেশনার জন্য তোমাকে কুরআনেই ফিরে যেতে হবে। হাদীস এই বিষয়ে আরো খুলে বলবে। আমাদের আসলাফ ও আকাবিরগণ এবং মাজহাবের ইমামগণ এসব বিষয়ে তোমাকে পদস্খলন থেকে হেফাজত করবে।
সর্বপরি তোমাকে বিশেষ একটি স্তর ইলমের অতিক্রম করতেই হবে। তোমার এতটুকু যোগ্যতা আমাদের কাম্য যে, তুমি তোমার সর্ব বিষয়ে কুরআনে আলোকে সিদ্ধান্ত পৌঁছতে পার। দ্বীন এবং শরীয়ত সম্পর্কে বলা ইমামগণের কথাকে সূত্র ধরে হাদীস হয়ে একদম পৌঁছে যেতে পার মূল মাসদারে শরীয়ত; কুরআনে। যেন কুরআনের আলোকেই বুঝে নিতে পার শরীয়তের যাবতীয় বিষয়াবলীর কোনটির কি গুরুত্ব। কতটুকু গুরুত্ব। কোনটির কি কাজ। কি প্রয়োজনীয়তা। কোথায় প্রয়োজনীয়।
সর্বোপরি তোমার মাঝে শরীয়তের পূর্ণ সঠিক তাসাউর ও ধারণা আসা চাই। শরয়ী বিষয়ে তোমার মালাকা পরিপূর্ণতায় পৌঁছাই আমাদের কাম্য।
যোগ্যতাই তোমার প্রথম কথা
তোমরা সমাজে গিয়ে দ্বিনের খিদমত করবে। এজন্য তোমাদেরকে প্রথমে যোগ্য হতে হবে। এই দ্বীনের সবকিছুই আমানত। অযোগ্য হলে তুমি এমনিতেই খিয়ানত করে বসবে। অনেক ক্ষেত্রে তুমি যে খায়েন হয়ে বসেছ; তাও বুঝে উঠতে পারবে না। কারণ, পরিবেশটা এতই খারাপ, এতই নাজুক হয়ে গেছে। অতএব, তুমি ভালভাবে বুঝে শুনে দায়িত্ব নিবে। যে কাজের যোগ্যতা তোমার নাই, তা থেকে সর্বদা দূরে থাকবে। যোগ্য ব্যক্তিকেই তার কাজের জন্য সুযোগ করে দিবে। সেখানে তুমি দখল দিয়ে যেওনা।
যে কিতাব পড়ানোর যোগ্যতা নেই সেই কিতাব নিয়ে টানাটানি করোনা। অবস্থাভেদে প্রয়োজন হলে মকতবে ছোট্ট শিশুদেরকে আল্লাহর কালামের নাজারা পড়াও। শুদ্ধ করে হক্ব আদায় করে তাও যদি করতে না পার অন্য কাজ কর।
সর্বপরি দ্বীনের লিবাসে বা দ্বীনের অবয়বে কোন ধোঁকায় লিপ্ত হয়ো না। নিজেও প্রতারিত হয়ো না। দ্বীনের সকল কাজ সবাই করা জরুরী নয়। বাস্তবে সম্ভবও না। যৌক্তিকও না। অতএব, তুমি তালীমের যোগ্যতা না রাখলে ভিন্ন পন্থায় দ্বিনের খিদমত কর। তালীমের সহযোগী হতে পার বিভিন্ন ভাবে।
এছাড়া উম্মাহের ধ্বংসের জন্য তুমিই দায়ী
একথা কখনো ভাববে না তুমি অযোগ্য হয়েও কোথাও তালীম দিতে শুরু করলে; আর এতে তুমি দ্বীনের খেদমতের বড় অংশ নিলে। না! কিছুতেই না। রবং তুমি এতে গোনাহের পাপ বোঝাই করলে নিজের কাঁধে নেকী মনে করে। শুধু তালীম না। বরং দ্বীন দুনিয়ার সর্বক্ষেত্রেই এই একই নীতি। হয়তো তুমি মনে করবে এতে খিয়ানতের কি আছে। এতে তেমন কি অসুবিধা। সাবধান! এমন ধারণা কর না। এখনই এই মুহূর্তেই হয়তো তুমি তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখছ না ঠিকই। কিন্তু সূদুর ভবিষ্যতে তোমার এই একটি খিয়ানতেরই পথ ধরে পুরা উম্মাহের ধ্বংস নেমে আসবে। হয়তো তুমি এই হিসাব করতে পারছ না। পারবে না। কিন্তু জ্ঞানী মাত্রই এ কথাটি উপলব্ধি করতে সক্ষম। সহজে বুঝতে চাইলে একটি প্রবাদ বাক্যই তোমার জন্য যথেষ্ট মনে করছি। প্রবাদ আছে: আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও; আমি একটি শিক্ষিত জাতি তোমাদের কে উপহার দিব।
হাদীছে এসেছে: যখন অযোগ্যের হাতে অর্পিত হবে দায়িত্ব; তখন তুমি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষা কর।
জেনে রেখ! দ্বিনের যে কোন ক্ষেত্রেই কাজ করতে চাও প্রথমে তুমি ঐ কাজের যোগ্য হতে হবে। তুমি শুধু ঐ কাজের শেকেল পরেছ তার রুহ তোমার মাঝে নেই, তাহলে তুমি সম্পূর্ণই অযোগ্য থেকে গেলে। এ সূরত আর শেকেল নিয়েই যদি তুমি দ্বীনের ঐ কাজটি করতে যাও তাহলে তুমি নিশ্চিত দ্বীনের ঐ শাখাকে ধ্বংস করে দিলে।
তোমার অংশ তুমি পেয়েই যাবে
এভাবে তোমার মাঝে দ্বীনের পরিপূর্ণ বুঝ নেই। দ্বীনের তেমন কোন সমঝ নেই। তুমি পীর সেজে বসেছ। এলাকার বড় আলেম হিসেবে নিজের নাম ভাঙ্গিয়েছ। কি হবে দ্বীনের দশা। মানুষকে শরীয়তের নামে গোমরাহীর দিকে ডাকবে। মানুষকে দ্বীনের নামে ভন্ডামীর দিকে ডাকবে। এতে দ্বীনকে বিক্রি করে তুচ্ছ কিছু দুনিয়ার হাতছানি পাবে বটে। আর ঘৃণ্য দুনিয়ার জন্য তুমি দ্বীনের কি পরিমাণ ক্ষতি করে বসলে ভাবতেও তুমি পারবে না। অথচ তোমার ভাগ্যেও এই দুনিয়াটুকু অনায়াসেই তোমাকে ধরা দিত। এর জন্য দ্বীনের ক্ষতি করার দরকার ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে তুমি উল্টো ভাবতে পার যে, দ্বীনের কি বিশাল খিদমতই না তুমি আঞ্জাম দিয়ে দিলে। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
বাস্তবতা কে মেনে নিয়ে অগ্রসর হও সম্মুখ পানে
সুতারাং তোমার মাঝে যদি কোন যোগ্যতার কমতি থাকে তাহলে তা তুমি স্বীকার করবে। কেউ না জেনে দায়িত্ব দিতে গেলেও অপারগতা প্রকাশ করে দায়িত্ব ফিরিয়ে দিবে। এটিই তোমার দ্বীন। এটিই তোমার ঈমানের দাবী। এটিই তোমার ইলমের দাবী। এটিই তোমার ইসলামের দাবী। যদি তোমার মাঝে ঈমান, ইসলাম ও ইলমের কিছুটা হলেও থাকে।
কিন্তু তুমি যদি সেই অযোগ্যতার উপর পর্দা দিতে চেষ্টা কর। অযোগ্য সত্ত্বে যদি তুমি লুফে নাও তোমার সাধ্যের বাইরের দায়িত্ব, তাহলে নিশ্চিত যেন তুমি খেয়ানত করলে। দ্বীনের সাথে। ইলমের সাথে। ইসলামের সাথে। অতএব, সাবধান খিয়ানত করো না। কৃত্রিমতা ও প্রতারণাকে বাদ দিয়ে সহজ সরলভাবে বাস্তবতাকে মেনে নাও। সঠিক ও গ্রহণযোগ্য ভাবে দ্বীনের খিদমত করবে। আর এমন খিদমত ইখলাছের সাথে কম হলেও খেয়ানত মিশ্রিত খেদমতের তুলনায় অনেক বেশি। হাদীস তো তোমাদের জানাই আছে: তোমার ঈমানকে খাঁটি কর, অল্প আমালই নাজাতের জন্য যথেষ্ট। আরো বর্ণিত হয়েছে: তুমি আমলের মধ্যে ততটুকুই গ্রহণ কর; যতটুকু তোমার সাধ্যে কুলায়। আল্লাহই তৌফিকদাতা।
কাজী ছানাউল্লাহ পানীপতি (রহ.)এর ওসীয়তের অংশ বিশেষ
এই বছরের শেষ সবকে শেষ নসিহত হিসেবে তোমাদের দ্বীনের একদম সার নির্যাস কিছু বিষয় তুলে ধরছি। দ্বীনের মৌলিক কিছু বিষয়ের আলোচনা আমি তোমাদের সামনে করতে চাই। এই জন্য আমি সাথে বিশিষ্ট ফকীহ কাজী সানাউল্লাহ পানীপতী (রহ.)এর অসিয়তনামা সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আমি প্রায়ই সময় প্রায় জায়গাতে এই অসিয়তনামা সম্পর্কে বলে থাকি। এটি মালাবুদ্দাহের সাথে সংযুক্ত আছে। তোমরা সময় করে গুরুত্ব দিয়ে এটি দেখে নিবে। এবং বারবার বুঝে শুনে মুতালাআ করে নিজের সিফাতে পরিণত করবে।
দ্বীনের সারকথা
কাজী সানাউল্লাহ পানীপতি রহ. বলেন, দ্বীনের মধ্যে কামাল অর্জনের পন্থা হল; সবচেয়ে কামাল ব্যক্তি হযরত সায়্যিদুনা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ণ অনুসরণ করা। যে ব্যক্তির সাদৃশ্যতা তার সাথে যত বেশি হবে সে ততই কামাল এবং আল্লাহর দরবারে মাকবূল হবে। ফরয, ওয়াজিবের আদায় দিয়ে এই অনুসরণ শুরু হবে। শেষ হবে আদাব, মুস্তহাব ও দ্বীনের ছোট ছোট বিষয়গুলোরও সঠিক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে হারাম থেকে শুরু করে সামান্য সন্দেহযুক্ত বস্তু থেকেও বেঁচে থাকতে হবে।
নফল মুস্তাহাবের আধিক্যতা শরীয়তে এতটা গুরুত্ব নয়
অত:পর তিনি বলেন, যদি কেউ এমন কামালে ইত্তেবা করার হিম্মত করতে অক্ষম; দ্বীনের ওয়াজিবাত আদায় করা, হারাম, মাকরুহ এবং সন্দেহপূর্ণ বিষয় থেকে বেছে থাকার উপরই তুষ্ট; এটাকেও আল্লাহ তায়ালার বড় নিয়ামত হিসেবে গন্য করা চাই। যদিও বেশি বেশি নফল, মুস্তাহাব আমল এবং সুন্নাতের মধ্যে পরিপূর্ণ মশগুলী অর্জন সম্ভব না হয়। কারণ, আল্লাহ তায়াল বলেছেন-
অর্থাৎ মুত্তাকিরাই আল্লাহ তায়ালার বন্ধু। এখানে তাকওয়া থেকে উদ্দেশ্য হল, ওয়াজিবাত সমূহ আদায় করা। এবং হারাম, মাকরুহ এবং সন্দেহপূর্ণ বিষয়সমূহ থেকে বেছে থাকা। বেশি বেশি নফল এবং মুস্তাহাব আমলগুলো করা তাকওয়া জন্য আবশ্যক নয়।
তারপর কাজী ছানা উল্লাহ পানীপতি (রহ.) বলেন, সর্বনিকৃষ্ট হারাম হল নফসের সাথে সম্পৃক্ত মন্দ স্বভাবগুলো। নেফাক, হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, লালসা ইত্যাদি। তারপর সবচেয়ে নিকৃষ্ট হারাম হল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত হারাম কাজসমূহ।
অন্যের হক্বের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি
তারপর তিনি বলেন, কারো হিম্মত যদি এতই নিচে নেমে আসে। তার উপরাক্ত কোনটির থেকেই বেছে থাকার হিম্মত নেই; অন্তত সে যেন এমন সব কাজ থেকে বেছে থাকে যার কারণে কোন মানুষের হক্ব নষ্ট হয়। এটুকু হলেও কোন রকমে মেহেরবান রবের কাছে ক্ষমার আশা করা যায়। কিন্তু বান্দার হক্ব আল্লাহ তায়ালা মাফ করবেন না। এ ব্যাপারে অসংখ্য আয়াত এবং হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
কাজী ছানাউল্লাহ পানীপতি (রহ.)এর ওসিয়তনামা মতে (এবং বাস্তবতাও এমন) দ্বীনের মধ্যে সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বান্দার হক্ব। দ্বীনের অন্যান্য ফরায়েযের চেয়েও তার গুরুত্ব অনেক বেশি। ঈমানের পরে বান্দার হক্বের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। বান্দার হক্ব নষ্ট করে নামায রোযায় ব্যস্ত হলে কাল হাশরে পার পাওয়া যাবে না। এ বিষয়টির প্রমান কাজী সানাউল্লাহ পানীপতি (রহ.) উল্লেখ করেছেন।
এছাড়া হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা কি জান প্রকৃত দরিদ্র ও মিসকিন কে। সাহাবারা বললেন, যার কাছে দিনার দেরহাম নেই। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। বরং প্রকৃত দরিদ্র ও মিসকীন সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন পাহাড় পরিমান ইবাদত নিয়ে হাজির হবে; কিন্তু একজন এসে বলবে, হে আল্লাহ সে আমার উপর জুলুম করেছে। আল্লাহ তায়ালা তার আমলের কিছু সেই ব্যক্তিকে তার উপর জুলুমের বিচারে দিয়ে দিবেন। এভাবে একেকজন একেক অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উত্থাপন করতে থাকবে; আর আল্লাহ তায়ালা তার নেক আমলগুলো তাদেরকে দিতে থাকবেন। এমনকি একে একে তার সব নেক আমলগুলো শেষ হয়ে যাবে। তারপরও পাওনাদার ও অভিযোগ বাকি থেকে যাবে। তখন আল্লাহ তায়ালা পাওনাদারদের গুনাহ তার উপর চেপে দিবেন। এভাবে সে তাদের গুনাহের বোঝা বহন করে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক।
আহকামের চেয়ে আখলাকের অধিকগুরুত্ব বহন করে
দ্বীনের মাঝে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও ভারী মূল্যবান আমল হল আখলাক। মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার। তারপর হল আহাকমের গুরুত্ব। অথচ আমরা সম্পূর্ণ উল্টো ভাবে এই সবকিছুকে মূল্যায়ন করি। এজন্য প্রয়োজন সর্বপ্রথম দ্বীনকে সঠিকভাবে বুঝা। অত:পর নিজে সেই অনুযায়ী চলা এবং আম জনসাধরণ ও উম্মতকে হিকমতের সাথে সেই মতে চালানো। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করুন। আমীন।”
দরস ও বয়ান শেষে আল্লামা মুফতি কিফায়াতুল্লাহ তরুণ আলেমদেরকে নিয়ে বিশেষ দোয়া-মুনাজাত পরিচালনা করেন। দোয়ায় তিনি দাওরায়ে হাদীস সমাপনী বর্ষের তরুণ আলেমদের হক্বের উপর অটল থাকা এবং দ্বীন-ইসলাম, দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করে যাওয়াসহ বরকতময় জীবনের জন্য দোয়া করেন। পাশাপাশি করোনা ভাইরাস মহামারিসহ সকল রোগ-ব্যাধি, বিপদাপদ থেকে দেশ ও জাতির মুক্তি এবং কল্যাণ ও শান্তি কামনা করেন।
– আল্লামা মুফতি কিফায়াতুল্লাহ, ইসলামী গবেষক, গ্রন্থকার এবং মুহাদ্দিস ও মুফতি- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ