ক্লিভ স্ট্যাডফোর্ড স্মিথ : ‘কয়েক দিন আগে আমার মক্কেল আহমেদ রব্বানির সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হলো। রব্বানি ২০ বছর ধরে কুখ্যাত গুয়ানতানামো কারাগারে বন্দী আছেন। এখন তাঁর বয়স ৩৯ বছর। গুয়ানতানামো কারাগারে আটক থাকা মোট কয়েদির যে অর্ধেক মানুষ আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পরও ছাড়া পাচ্ছেন না, রব্বানি তাঁদের একজন।
ওই কারাগারের বাস্তবতার সঙ্গে সংগীতশিল্পী ইগলসের বিখ্যাত গান ‘হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া’র কথার মিল পাওয়া যায়। ওই গানে হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তুমি যখন ইচ্ছা চেকআউট (হোটেলের রুম ছেড়ে দেওয়া) করতে পারো, কিন্তু কখনোই হোটেল ছেড়ে যেতে পারবে না।’
আমি কয়েক দিন আগেও আশা করছিলাম, অবকাশ মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই আহমেদ রব্বানি ছাড়া পাবেন এবং দ্রুত তিনি তাঁর দেশ পাকিস্তানে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু তা হয়নি। তিনি শিগগির ছাড়া পাচ্ছেন না, এটি আমি জানতে পারার পর তাঁকে ফোন করতে হয়েছিল। রব্বানির আইনজীবী হিসেবে আমাকে তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। আমি তাঁকে জানাতে বাধ্য হলাম, করাচিতে তাঁর শাশুড়ি হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়। মার্কিন সামরিক বাহিনী যদি এখনো তাঁকে মুক্তি দেয়, তাহলেও রব্বানির পক্ষে গুয়ানতানামো থেকে করাচিতে উড়ে আসা সম্ভব হবে। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না।
আরও পড়তে পারেন-
- ধর্ষণ প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা
- কিশোর অপরাধ রোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে
- আদর্শ পরিবার গঠনে যে সব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরী
- ইসলামে সামাজিক সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখার গুরুত্ব
- মানুষ মারা যাওয়ার পর, তাঁর আত্মার কি হয় ?
আমি যখন রব্বানিকে তাঁর শাশুড়ির অবস্থা জানাচ্ছিলাম, তখন তিনি একেবারে চুপ ছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বিষাদগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি ২০ বছর ধরে জেলে আছি। এই ২০ বছরে আমি বহু স্বজন হারিয়েছি। এঁদের মধ্যে দুজন আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। একজন হলেন আমার খালা। তিনি পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। তিনি আমাকে নিজের ছেলের মতো দেখতেন। আরেকজন হলেন আমার বাবা। আর এখন আমার শাশুড়ি চলে যাচ্ছেন।’
রব্বানি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আমার শাশুড়ি আমাকে এত স্নেহ করতেন যে আমার মনে হতো তিনি তাঁর নিজের ছেলেমেয়ের চেয়ে আমাকে বেশি ভালোবাসেন। আমার স্ত্রী আমাকে ছাড়া ২০টি বছর একাকী কাটাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর মা এত দিন ছিলেন। এখন তিনিও চলে যাচ্ছেন।’ আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। শুধু ভাবছিলাম, আমার দেশের সরকারের কারণে আজ একজন নির্দোষ মানুষকে কারাগারে পচে মরতে হচ্ছে।
আহমেদ রব্বানি তাঁকে জেলে আটকে রাখার প্রতিবাদে ২০১৩ সাল থেকে অনশন করে যাচ্ছেন। সেই তখন থেকে তাঁকে দিনে দুবার কারাকর্মীরা জোর করে খাওয়ান (ফোর্স ফিডিং)। এভাবে এত দিন চলার কারণে তাঁর দেহের ওজন অর্ধেকে নেমে এসেছে এবং নানা ধরনের রোগ তাঁর দেহে বাসা বেঁধেছে। আমি ১৫ বছর ধরে তাঁর হয়ে আইনি লড়াই লড়ছি। সেই সুবাদে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা করার সুযোগ হয়। আমি জানতে পেরেছি, এ ২০ বছরে রব্বানি বহুবার নিজেকে শেষ করে ফেলার চেষ্টা করেছেন। সে কারণে তাঁর শাশুড়ির খবরটি তাঁকে দেওয়া ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে ভাবছিলাম।
রব্বানি বলছিলেন, ‘যখন শুনেছিলাম, আমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, তার পর থেকে আমার স্বাস্থ্য ভালোর দিকে যাচ্ছিল। আমি নতুন আশায় বুক বাঁধছিলাম, আমার অবশিষ্ট স্বজনদের সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে। কিন্তু তারা আমাকে মুক্তি দেবে বলেও তা দিচ্ছে না। এখানে একটি দিন এখন আমার কাছে এক মাসের মতো লম্বা সময় মনে হয়।’ তিনি বললেন, ‘আমার দেশ আমাকে নিতে রাজি, আমেরিকা বলছে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে তাদের আপত্তি নেই; কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না।’
রব্বানি বলছিলেন, তাঁকে শুধু রাজনৈতিক কারণে আটকে রাখা হয়েছে। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের বলি হচ্ছেন। রব্বানি বললেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে কথা শেষ করে আবার অনশনে যাব। আমি আর বাঁচতে চাই না। জীবিত অবস্থায় যদি ফিরতে না পারি, তাহলে আমি চাই অন্তত আমার লাশটা কফিনে করে হলেও আমার স্বজনদের কাছে যাক।’
রব্বানি ফোন রেখে দিলেন। আমি জানি না, তিনি এখন কী অবস্থায় আছেন।
[আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত]
– ক্লিভ স্ট্যাডফোর্ড স্মিথ, যুক্তরাষ্ট্রের একজন সুপরিচিত মানবাধিকার আইনজীবী।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ