সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকালে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় দিল্লিতে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা আলেমের নাম ছিল শাহ আব্দুর রহিম (রহ.)। সম্রাট আওরঙ্গজেবের পরিচালনায় যে ফাতাওয়াতে আলমগিরি লেখা হয়, তার উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন শাহ আব্দুর রহিম (রহ.)। তাঁর নামে মাদরাসার নাম হয় রহিমিয়া।
১৭১৮ খ্রিস্টাব্দে শাহ আব্দুর রহিম ইহলোক ত্যাগ করেন। তখন এই মাদরাসা পরিচালনার ভার পড়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবি (রহ.)-এর ওপর। শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)-কে বলা হয় ভারতবর্ষের প্রথম মুহাদ্দিস।
মূলত হানাফি ফিকাহ অনুসারে এবং নকশবন্দি সুফি চিন্তাধারায় মাদরাসাটি পরিচালিত হলেও শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)-কে ভারতের সব চিন্তাধারার আলেম-ওলামাদের পথপ্রদর্শক বলে ধরা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মাদরাসাটির প্রভাব ছিল সর্বজনস্বীকৃত।
১৭৬২-তে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইহলোক ত্যাগ করলে তাঁর পুত্র শাহ আব্দুল আজিজ (রহ.) মাদরাসাটির পরিচালনায় এগিয়ে আসেন। তাঁকে সহায়তা দান করেন তাঁর দুই ভ্রাতা শাহ আব্দুর রফি ও শাহ আব্দুল কাদের।
এই মাদরাসার ছাত্র ছিলেন সৈয়দ আহমদ শহীদ বালাকোটি (রহ.)। তিনি ১৮০৬ থেকে ১৮১১ এই পাঁচ বছর মাদরাসা রাহিমিয়াতে পডাশোনা করেন। বলা যেতে পারে, শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) যে আধ্যাত্মিক শিক্ষা শুরু করেন, তার প্রয়োগ শুরু করেন শাহ আব্দুল আজিজ। তাই দেখা যায়, প্রথম থেকেই এই মাদরাসার প্রতি ইংরেজদের রোষ ছিল। ধারণা করা হতো, এখান থেকে ইংরেজবিরোধী যাবতীয় আন্দোলন দানা বাঁধত।
শাহ আব্দুল আজিজের ইহলোক ত্যাগের পর তাঁর পুত্র শাহ মোহাম্মদ ইসহাক মাদরাসা রাহিমিয়ার কর্ণধার হন। ১৮৪৬-এ তিনি ইহলোক ত্যাগ করলে মাদরাসাটি বহু শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। মাদরাসা রহিমিয়া নামে মূল মাদরাসা রয়ে যায়।
১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের পর দিল্লিস্থ মাদরাসা রহিমিয়াকে সব বিদ্রোহের মূল কেন্দ্র ধরে নিয়ে ইংরেজরা রামজি দাসের কাছে বিক্রি করে দেয়। সে এটাকে গুদামঘর করে দেয়।
ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল মাদরাসা রহিমিয়ার মতো মাদরাসাগুলো থেকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জ্ঞান নিয়ে ইংরেজবিরোধী যাবতীয় আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু তারা সাহস পায়নি মাদরাসা রহিমিয়ার মতো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিতে। মহাবিদ্রোহের পর অনাথ ভারতীয়দের শেষ বাধাটুকুও হটে গেলে ইংরেজরা তাদের বিরোধিতার ন্যূনতম চিহ্নগুলো ধ্বংস করে দেয়।
ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল মুসলিমরা যত দিন শক্তিশালী আছে, তাদের সিংহাসন নিষ্কণ্টক হবে না। দৈহিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বলে বলীয়ান করে তাদের মাদরাসাগুলো ও মাদরাসা-ফেরত আলেমদের। তাই ইংরেজরা মহাবিদ্রোহের পর প্রথম যে কাজটিতে হাত দেয়, তা হলো আলেমদের নির্মূল করা এবং মাদরাসাগুলোকে নির্মূল করা।
আরও পড়তে পারেন-
- ধর্ষণ প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা
- কিশোর অপরাধ রোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে
- আদর্শ পরিবার গঠনে যে সব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরী
- ইসলামে সামাজিক সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখার গুরুত্ব
- মানুষ মারা যাওয়ার পর, তাঁর আত্মার কি হয় ?
১৮৫৭-এর ১০ মে উত্তর প্রদেশের শামলির থানা ভবন এলাকায় হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি (রহ.)-এর নেতৃত্বে রশিদ আহমেদ গাঙ্গোহি, কাশেম নানুতুবি, ইয়াকুব নানুতুবি ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি বিরোধী ভয়ংকর আন্দোলন গড়ে তোলেন, স্বাধীন এলাকা হিসেবে শামলিকে ঘোষণা করেন। যদিও পরবর্তীকালে শামলি দখল হয়ে যায় এবং হাজি ইমদাদুল্লাহ মক্কায় চলে যান।
মহাবিদ্রোহের পর মাদরাসা রাহিমিয়া এবং ছোটখাটো মাদরাসাগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর ও সংশ্লিষ্ট আলেমদের হত্যার ফলে ভারবর্ষের বুকে সামগ্রিক ইসলামচর্চা স্তব্ধ হয়ে যায়।
মহারানির রাজত্বে ক্ষমা প্রদর্শনের পর ভারতের বুকে পুনরায় ইসলামচর্চা শুরু হয়। এই সময় উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দে কাসেম নানুতুবি (রহ.), রশিদ আহমেদ গাঙ্গোহি (রহ.) ইত্যাদি একদা বিদ্রোহীদের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন করে ইসলামচর্চা শুরু হয়। কিন্তু এঁদের অন্তরে বিদ্রোহের আগুন সব সময় প্রজ্বলিত ছিল। দেওবন্দ মাদরাসার প্রথম দিককার ছাত্র শাইখুল হাদিস মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি (রহ.)-এর রেশমি রুমাল আন্দোলন পরবর্তীকালে বহু দেশ নেতার বিদেশি সাহায্য নিয়ে ভারতকে স্বাধীন করার অনুপ্রেরণা ছিল।
মাদরাসা রহিমিয়া ভারতবর্ষের বুকে সংঘটিত উপায়ে কোরআন-হাদিস চর্চা শুরু করলেও এবং তার ফলাফল পাওয়া গেলেও ইংরেজ কর্তৃক ভারতীয় মুসলিমদের আধ্যাত্মিক চেতনা ধ্বংসের প্রয়াসের পর ১৮৬৩-তে প্রতিষ্ঠিত দেওবন্দ মাদরাসা আরো সুসংহত উপায়ে কোরআন-হাদিস, ফিকাহচর্চা শুরু করে। শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও প্রায় দেড় শ বছরের বেশি সময় ধরে দেওবন্দ মাদরাসা তার লক্ষ্যে অটল। মানুষের স্বাধীন আচরণ, মুক্তি ও আল্লাহর জমিনে আল্লাহকে সার্বভৌম জেনে মানুষকে মুক্তির আস্বাদ দেওয়ার যে প্রচেষ্টা শেখ আহমদ সরহিন্দি (রহ.) আকবর ও জাহাঙ্গীরের দরবার থেকে শুরু করেছিলেন, সেই বাটন ধরে রেখেছে দেওবন্দ মাদরাসা। তাই দেখি, প্রাক্তন সোভিয়েত দখলদারত্বে থাকা কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান থেকে খোরাসান ও আফগান তালিবান সবাই মুক্তি ও স্বাধীনতার শিক্ষায় শিক্ষিত।
সূত্র- নবজাগরণ ডটকম অবলম্বনে।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ