।। বিনতে এন. এম. জাহাঙ্গীর ।।
হৃদয়াকাশ যখন মেঘাচ্ছন্ন হয়, দুর্যোগের গুরু-গম্ভীর মেঘগুলো যখন হৃদয়কে অমানিশার ঘোরে ঘিরে নেয়, তখন ‘তিনি’ সান্ত্বনার উপকরণ প্রেরণ করেন। জীবনের এই ছোট পরিসরে আমি বারবার তা উপলব্ধি করেছি।
জীবনে ছোট-বড় সব দুর্যোগ তো তাঁরই প্রেরিত। তিনি দু:খ-কষ্ট প্রেরণ করেন, আমাদের কল্যাণের জন্য! তাঁর দিকে আমাদের রুজু হবার জন্য! জীবনের দু:খ-কষ্ট, সুখ বা আনন্দ; সব তো আসে আসমানের ওপার হতে, আসমানের মালিকের পক্ষ হতে! আমরা যদি সুখ-দু:খ দু’টোকেই মুুচকি হাসি দিয়ে গ্রহণ করতে পারি ‘শোকরান ইয়া রব’ বলে, তবেই রব খুশী হন! প্রতুত্তরে হয়ত কুদরতিভাবে হেসে উঠেন রব নিজেও! কিন্তু আমরা তা পারি না সবসময়…।
(তাকদীরের ব্যাপারে) অবুঝ হতেই আমি তাকদীর বিশ্বাস করি এবং অবনত মস্তকে মেনে নিতে চেষ্টা করি তাকদীরের ফায়সালাকে! যখন অস্থির হয়ে পড়ি, তখন অস্থিরতা বেড়েই চলে… আর যদি কুরআনী ভাষায় বলতে পারি ও ভাবতে পারি এভাবে وافوض امري الي الله (আমি আমার সমস্ত বিষগুলো অর্পণ করছি রবের তরে..) তবেই শান্তি! রব তখন প্রেরণ করেন কোন না কোন সান্ত্বনা! কত সুন্দর!! কত কৌশল সাওয়াব প্রদানের!
বেশ কিছুদিন আগের রোদমাখা প্রভাতি! রোদের সোনালী কিরণ আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে! জানালা গলে আলো-উত্তাপ এসে পড়েছে বিছানাতেও। ঘুমটা ভেঙেই গেল এবং উঠে বসলাম। ছোট্ট মামাত ভাই জাবিরকে বললাম, এই আম্মু কই! বললো, ১০তলায় গিয়েছে। মনটা কেন যেন বিষন্ন লাগছিল। খানিক পরই দেখি আম্মু-আব্বু দ্রুতপদে আমার কামরার দিকে এগিয়ে আসছেন। আম্মুর হাতে দু’টো বুলবুলি পাখি। আরে! আরে! সবাই বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ল!
আম্মু বললেন, ১০তলার বাসায় পেয়েছি পাখি দু’টো। যুবায়েরের হাত হতে উড়েই গেল একটি পাখি। ওরা বেশ ছোটাছুটি করল, কিন্তু আর পাওয়া গেল না পাখিটি। তাই আব্বু ছেড়ে দিতে বলল অপর পাখিটিও। আমার খুব মায়া লাগছিল। হাতের তালুতে বসিয়ে রেখেছিলাম, আর ভাবছিলাম, আদীব হুযুর (মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ হাফিযাহুল্লাহ) এর ভাষ্য ‘তুমি যদি সত্যিকারার্থেই মুহব্বত করো কোন গাছকেও, সে তা বোঝবে তোমার হাতের ছোঁয়াতেই!’ আমি বলি আমার ভাষায় এভাবে- ‘মুহাব্বাতের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠে প্রতিটি আচরণ-উচ্চারণে, এমনকি হাতের ছোঁয়ায়ও!’
আরও পড়তে পারেন-
- ধর্ষণ প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা
- কিশোর অপরাধ রোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে
- আদর্শ পরিবার গঠনে যে সব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরী
- ইসলামে সামাজিক সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখার গুরুত্ব
- মানুষ মারা যাওয়ার পর, তাঁর আত্মার কি হয় ?
আমি পাখিটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর আব্বুর নির্দেশমত হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম গ্রীলের বেশ খানিকটা বাইরে। হাত দোলায়িত করছিলাম যেন উড়ে যায়, কিন্তু মনে মনে বলছিলাম ‘যাস নে পাখি উড়ে/ মনটা গেছে জুড়ে’ । সত্যিই পাখিটি বুঝতে পেরেছিল মনের আকুতি। কিছুতেই যাচ্ছিল না পাখিটি। কিন্তু কেউ বুঝতেই চাচ্ছে না যে, কেন সে যাচ্ছে না। পরিশেষে আব্বু আমার কাছ হতে নিয়ে হাত বাড়ালেন আর বুলবুলিটি উড়ে গেল। হারিয়ে গেল দৃষ্টিসীমা হতে। কিন্তু স্মৃতি হয়ে আছে আজো হৃদয়পটে! ক্ষণিকের জন্য হাতে বসেছিল, বুঝতে পেরেছিল মনের আকুতি। সত্যিই- “মুহাব্বাতের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠে প্রতিটি আচরণ-উচ্চাণে, এমনকি হাতের ছোঁয়ায়ও”।
কেন এসেছিল পাখিটি! হয়ত সান্ত্বনার উপকরণ হয়ে! হয়ত সে আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছে দুনিয়ার ফানাইয়্যাত বা ক্ষণস্থায়ীত্ব! এভাবেই প্রাণপাখি উড়ে যাবে সকলের। আমিও শামিল হব উড়ে যাওয়া প্রাণপাখিদের কাফেলায়! যেতে চাইবে না অনেকে, তবু উড়িয়ে নেয়া হবে ওপারে! আমার আমাল, দ্বীনি খিদমাহ ও বিশুদ্ধ ফিকির যেন সমুজ্জ্বল ও সুদূরপ্রসারী কল্যাণের বার্তা হয়ে থাকে, আগামী উম্মাহর দ্বীনি জীবনযাত্রার পরতে পরতে..
সামান্য অবুঝ-বাকহীন একটি প্রাণীও বোঝে দিলের আকুতি! ‘মায়ের চেয়েও দয়ালু’ যেই মহান মালিক, আবদিয়্যাত ও সামান্য ইখলাছের বদৌলতে আমরা হতে পারি সেই রবের কতই না আপন! তাঁর পেয়ার ও সন্তুষ্টিভাজন! ক্ষণিকের এই অতিথি পাখিটির কাছে জীবনের অতি সুন্দর এক নাসীহা পেয়ে আমি সত্যিই শোকরগুজার হে রব! এ তো ‘পাখিকে’ উসিলা করে, আসমানের মালিকের পক্ষ হতে সান্ত্বনার আয়োজন! দুনিয়ার বিষাদ-বিষন্নতার চে’ আখিরাতের ফিকিরের প্রতি মনোনিবেশের আহ্বান!
হে অনুপ্রেরণাদানকারী পাখি! দুনিয়ার উপকরণে হতে চাই ‘মুসাফিরা’ (সামান্য পাথেয়ের অধিকারী) এবং ইলমী-আমালে হতে চাই ‘মুফাক্কিহা’ (গভীর-বিস্তৃত দীনি ইলমের অধিকারী)। নীল দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া হে বুলবুলি! সবুজপাখি হয়ে আমিও যেতে চাই জান্নাতের নয়নাভিরাম শ্যামলিত গুলবাগে..!
লেখক: ওয়াপদা কলোনী, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে।
মেইল- jahangirbwdb63@gmail.com
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ