[শায়খুল হাদীস আল্লামা তাকী উসমানী’র বয়ান থেকে অনুবাদ]
ইলম অর্থ জানা। জ্ঞান অর্জন করা। কোন বিষয়ে শুধু জ্ঞান অর্জন করাই যথেষ্ট নয়। এর কোন বিশেষত্ব নেই, নেই তেমন কোন তাৎপর্য।
শয়তানও জ্ঞানী ছিল। বলা হয়, শয়তান এতটাই জ্ঞানী ছিল ও বুদ্ধিমান ছিল যে, ইমাম রাযী (রহ.)কে পর্যন্ত ধোঁকায় ফেলে দিয়েছিল। ঘটনা নিশ্চয় শুনেছেন। ইমাম রাযী (রহ.)এর মত ব্যাক্তিত্বকেও ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে শয়তান। জ্ঞান তো তার (শয়তানের) কাছেও ছিল, অত্যন্ত চতুরও ছিল সে। এতটাই চতুর ছিল যে, আল্লাহর সামনে এমন প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল, যা শুধুমাত্র যুক্তির নিরীখে বিবেচনা করলে মেনে না নেয়ার কোন উপায় ছিল না। خَلَقْتَنِيْ مِنْ نَارٍ وَّ خَلَقْتَه مِنْ طِيْنٍ (আমাকে সৃষ্টি করেছ আগুন দ্বারা এবং তাঁকে সৃষ্টি করেছ মাটি দ্বারা।)
সুতরাং কোন বিষয়ে শুধুমাত্র আকল তথা বুদ্ধিমত্তার ভিত্তিতে জবাব দেয়া বড়ই জটিল ব্যাপার। থানভী (রহ.) বলেন, “শয়তানের ৪ গুণ ছিল। ১. বড় আলেম ছিল। ২. খুব বুদ্ধিমান ছিল (যার দরূণ আল্লাহর সামনে এমন কঠিন দলীল পেশ করেছে)। ৩. বড় আবেদ ছিল। যেমন হাদীসে এসেছে, সে খুব বেশী ইবাদাত করত। আলিম ছিল, আবিদ ছিল, আকিল (বুদ্ধিমান) ছিল, কিন্তু চতুর্থ গুণে দুর্বলতা ছিল- ৪. সে আশিক (আল্লাহর ভালবাসায় ভরপুর) ছিল না। যদি আশিক হত, তবে, خَلَقْتَنِيْ مِنْ نَارٍ وَّ خَلَقْتَه مِنْ طِيْنٍ – (আমাকে সৃষ্টি করেছ আগুন দ্বারা এবং তাঁকে সৃষ্টি করেছ মাটি দ্বারা) না বলে বলত, “তুমি আমার খালিক, সৃষ্টিকর্তা; তুমি যা হুকুম করেছ, আমি তাতেই মাথা নত করলাম”।
শয়তান আলিম, আবিদ, আকিল (বুদ্ধিমান) ছিল, কিন্তু আশিক ছিল না! যার ফলে সে পথভ্রষ্ট ও লাঞ্ছিত হয়েছে।
শুধু পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন যথেষ্ট নয়, এতে কোন বৈশিষ্ট্যও নেই। যদি যথেষ্ট হত, তবে শয়তানও সম্মানী হত। যেমন জ্ঞান বিষয়ে দেখতে গেলে এখানে আশেপাশে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি আছে, যেখানে ইসলামী স্টাডি শাখা আছে। এমনভাবে আমেরিকাতেও আছে। সেখানে তারা যা গবেষণা করছে, সেখানে এমন কিতাবাদির হাওয়ালা (রেফারেন্স) দিয়ে থাকে, যা অনেক সময় আমাদের অভিজ্ঞ বড় বড় আলেমগণও উক্ত কিতাব সম্পর্কে অবগত নন। এ ধরণের অজস্র মাক্বালা (থিথিস) লিখে যাচ্ছে। শিক্ষা সেখানেও আছে। শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জন যথেষ্ট নয়। বরং এমন শিক্ষা অর্জনের নাম ইলম, যা অর্জন করলে تَفَقَّهُ فِي الدِّيْن তথা দ্বীনের বুঝ আসে। এই দ্বীনের বুঝ কিতাব হতে, ইলম হতে আসে না। তা দ্বীন সম্পর্কে পারদর্শী ব্যক্তির সুহবত (সান্নিধ্য) হতে আসে। এরপর দ্বীনের বুঝ আসে।
দ্বীনের বুঝ বা জ্ঞানের অর্থ কী?
তা হচ্ছে দ্বীনের সমসাময়িক চাহিদা কি তা অনুধাবন করতে পারা। দ্বীনি তাকাযা অনুযায়ী আমল করার নামই হচ্ছে تَفَقَّهُ فِي الدِّيْن তথা দ্বীনি বুঝ। থানভী (রহ.)এর যুগে একটি বসতি ছিল, যেখানে মুরতাদ (ধর্মচ্যুত) হবার প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছিল। লোকেরা নাস্তিকতার পথ অবলম্বন করছিল। যা মারাত্মক ফিতনা ছিল। কিছু লোক ছিল, যারা প্রকাশ্যে কিছু বলত না, তবে ধর্মবিরোধী কথা বলা শুরু করেছিল।
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
হযরত থানভী (রহ.) তখন ঐসব মুসলমানের কাছে তাশরীফ নিলেন, যারা তখনও মুরতাদ হয়নি। হযরত বললেন, (ঐসময় সেখানে ১টি ঐতিহাসিক উদযাপন চলছিল) তোমরা নাকি নাস্তিক হয়ে যাচ্ছ?! জবাবে তারা বলল, না আমরা এমন কিছু করিনি। আমরা তো এখনও মুর্দার জন্য তাজিয়া (মৃত ব্যাক্তির জন্য শোক প্রকাশ) করি, আমরা মুসলমান! থানভী (রহ.) বললেন, আচ্ছা!! তোমরা তবে তাজিয়াও করো! হ্যাঁ, এভাবেই করবে।
বলতে গেলে, তাজিয়া করতে বলা, প্রকাশ্যে করা বিদআহ ও রসম নাজায়েয। কিন্তু তখন ইসলাম ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য করার উদ্দেশ্য ছিল। তখন বাধা দিলে নাস্তিকতার প্রতি তাদের ধাবিত হবার আশঙ্কা ছিল। আর যদি অন্তত এই কাজের উপর রেখে দেয়া যায়, তবে পরবর্তীতে ইসলাহ (সংশোধনের) সুযোগ পাওয়া যাবে। এটাই হচ্ছে জ্ঞান ও দ্বীনের বুঝের মধ্যকার পার্থক্য।
কোন সময়, কোন পরিস্থিতিতে দ্বীনের চাহিদা কী? সে সময় দ্বীনের জন্য কোন কাজে উপকার আছে, সেটা নির্ধারণ ও অবলম্বন করতে জানাটাই দ্বীনের সঠিক বুঝ ও জ্ঞান। এখন যদি একজন মুফতি সাহেবকে প্রশ্ন করেন, একজন আলেম ছিলেন, যিনি তাজিয়া করতে বলেছিলেন, এখন সেই মাওলানা সাহেবের কি হুকুম? যদি তিনি (মুফতি) প্রচলিত ইলমের ভিত্তিতে ফাতওয়া দেন, تَفَقَّهُ فِي الدِّيْن না থাকে; তবে তিনি বলবেন, ঐ আলেম ভুল বলেছেন, মানুষকে গোমরাহ করেছেন। তিনি পথভ্রষ্ট লোক।
মূলত: কোনস্থানে, কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে ফাতওয়া দিতে হবে, কোন বিষয়ে কঠোর হতে হবে, কোন বিষয়ে সহজ করতে হবে; এটা জানার নামই হল تَفَقَّهُ فِي الدِّيْن । এটা تَفَقَّهُ فِي الدِّيْن শুধূ কিতাব পড়ে, দরসগাহে (শ্রেণীকক্ষে) শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে বা সনদ (সার্টিফিকেট) অর্জনের মাধ্যমে অর্জিত হয় না। এটা আসে বুযুর্গদের সুহবতের (সান্নিধ্যের) মাধ্যমে।
প্রকৃতার্থে ‘জ্ঞান অর্জন’ বলে সঠিক জ্ঞান অর্জন করার কথা বলা হয়েছে। এজন্য আল-কুরআনে বলা হয়েছে لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّيْن (তারা যেন দ্বীনের বুঝ অর্জন করে) তথা দ্বীনি বুঝ ও জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
অনুবাদ: বিনতে এন, এম, জাহাঙ্গীর
সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ। ইমেইল- jahangirbwdb63@gmail.com
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ