Home বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সিলিকন ভ্যালির শীর্ষ নির্বাহীর পদে কেন শুধু ভারতীয়রাই এগিয়ে থাকছে

সিলিকন ভ্যালির শীর্ষ নির্বাহীর পদে কেন শুধু ভারতীয়রাই এগিয়ে থাকছে

ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রযুক্তিবিদরা, যাদের মধ্যে অনেকেই প্রিমিয়ার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (IITs) এবং দেশের অন্যান্য বিশিষ্ট প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলিতে পড়াশোনা করেছেন, তারা এখন বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি সংস্থাগুলির নেতৃত্ব দিচ্ছেন৷

টুইটারের প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এর সহপ্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসি। চলতি সপ্তাহে তার জায়গায় নতুন সিইও পরাগ আগারওয়ালের নাম ঘোষণা করেছে টুইটার। সিলিকন ভ্যালির প্রভাবশালী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির সর্বোচ্চ পদে আগারওয়েলের নিয়োগ ভারতীয়দের গর্ব ও উদযাপনের কারণও হয়েছে।

পরাগের নিয়োগকে অভিনন্দন জানিয়ে ভারতীয়দের অনেকেই টুইট করেছেন।

মাহিন্দ্রা গ্রুপের ব্যবসায়ী আনন্দ মাহিন্দ্রা মজা করে টুইট করেন, ‘এটা কি সিলিকন ভ্যালিতে ভারতীয় সিইও ভাইরাস, যার কোনো টিকা নেই?’

কৌতুকের নেপথ্য ঘটনা আসলেই চমকপ্রদ। সিলিকন ভ্যালিতে একের পর এক শীর্ষ সংস্থায় ভারতীয়রা সিইও হচ্ছেন। সেই তালিকার সাম্প্রতিকতম সংযোজন পরাগ আগরওয়াল।

ভারতীয়রা কেন সিলিকন ভ্যালির মতো বৈশ্বিক তথ্যপ্রযুক্তির কেন্দ্রে নেতৃত্বে আসছেন, তা জানতে হলে একটু পেছন ফিরে দেখা দরকার।

শুরু থেকেই ভারত সরকার তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষাকে বেশ গুরুত্ব-সহকারে নেয়। প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটস অব টেকনোলজি (আইআইটি)। দেশজুড়ে এর বিভিন্ন শাখায় হাজার হাজার ছাত্র সরকারি খরচে পড়াশোনার সুযোগ পায়।

১৯৮০-র দশকে আইআইটির গ্রাজুয়েটরা উন্নত সুযোগ-সুবিধা পেতে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন শুরু করেন। তারা এখন মার্কিন ভূখণ্ডে সাফল্যের নিত্যনতুন রেকর্ড গড়ছেন।

ভারতে বেড়ে ওঠা এমন বিখ্যাত কয়েকজন সিইওর মধ্যে রয়েছেন গুগল ও এর প্যারেন্ট কোম্পানি আলফাবেট এর সিইও সুন্দর পিচাই; মাইক্রোসফটের সত্য নাদেলা; আইবিএম-এর অরবিন্দ কৃষ্ণ; অ্যাডবির শান্তনু নারায়ণ এবং ডাটা স্টোরেজ কোম্পানি নেটঅ্যাপের জর্জ কুরিয়া।

স্বদেশীদের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত ভারতীয়দের অনেকে এ সাফল্যের নানান কারণ ব্যাখ্যা করেছেন, যার অন্যতম হলো; সময়োপযোগিতা।

এইচসিএল টেকনোলজিসের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা অজিত কুমার বলেন, ‘৮০-র দশকে যখন কম্পিউটার সায়েন্স ও ইলেকট্রনিক্সে মাস্টার্স করতে আসা ভারতীয়দের সংখ্যা বাড়ছিল, ঠিক তখনই আমেরিকানদের মধ্যে এই দুটি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ঝোঁক কমছিল। সে সময়ে মার্কিন প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ পাওয়া ভারতীয়রা আজ উচ্চপদে উঠে এসেছেন। সেজন্য আজ যুক্তরাষ্ট্রের আইটি পেশাজীবীদের উল্লেখযোগ্য অংশই ভারতীয়।’

প্রযুক্তি জায়ান্টদের শীর্ষ পদে উঠে আসা সব সিইও তাদের নিজস্ব পথে চলেছেন। তবে সবার উত্থানের পেছনে কিছু অনুঘটক প্রায় সমান মাত্রায় কাজ করেছে বলে অনুমান করা হয়।

যেমন ছোট থেকেই বিজ্ঞান ও গণিতের ওপর বেশি জোর দেওয়া। বেশিরভাগ ভারতীয় পিতামাতাই সন্তানদের এসব বিষয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনার তাগিদ দেন। তারা জানেন, এসব বিষয়ে দক্ষতা ক্যারিয়ারে নিশ্চিত সাফল্যের চাবিকাঠি।

পরাগ আগওয়াল সিইও পদ পাবার পর তার মা বলেছেন, ‘পরাগ ছোট থেকেই কম্পিউটার ও মোটরকার ভালোবাসত; আর অঙ্ক ছিল ওর প্রিয় বিষয়।’

১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারতে শিক্ষাক্ষেত্রে রয়েছে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা। অল্পসংখ্যক ছাত্রই আইআইটিতে ভর্তি হওয়ার মতো সন্তোষজনক গ্রেড পায়। চলতি বছর আইআইটির ১৬ হাজার সিটের বিপরীতে ২২ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে।

এ নিয়ে বহুজাতিক বাণিজ্যিক পরামর্শক সংস্থা ম্যাককিন্সে অ্যান্ড কোম্পানির একজন অবসরপ্রাপ্ত পার্টনার অশোক আলেক্সান্ডার বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির চেয়েও আমাদের আইআইটিতে ভর্তি হতে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত চেষ্টা ও পছন্দ বড় ভূমিকা রাখে।’

যেমন পরাগ আগারওয়াল নিজ রাজ্য মহারাষ্ট্রের সেরা ছাত্রদের একজন ছিলেন। তিনি আইআইটি পরীক্ষায় টিকে যান এবং এ খাতেই ক্যারিয়ার গড়ার লক্ষ্যস্থির করেন।

তার একজন প্রাক্তন স্কুল সহপাঠী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সেরা ছাত্রদের মধ্যেও পরাগের মেধা আলাদাভাবে নজর কাড়ত।

আইআইটি শিক্ষার্থীর সামাজিক কদরও কম নয়। টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাম কাক্কর নামের ওই সহপাঠী বলেন, ‘আইআইটির সব ছাত্র তার নিজ শহরে হিরো। কিন্তু প্রথমবর্ষেই ১০-এ ১০ পেয়ে পরাগ সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। সবাই বুঝতে পারে ওর মতো চৌকস ছেলে শহরে কেন, গোটা রাজ্যেই নেই।’

শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের বাছাইপর্ব

দেশ-বিদেশের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো সেরা মেধাবীদের খোঁজে প্রতি বছর আইআইটির ২৩টি ক্যাম্পাসে রিক্রুটমেন্ট চালায়। চলতি বছরও অনেক গ্রাজুয়েট স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছেন। কাউকে কাউকে চাকরি শুরুকালীন বেতন অফার করা হয়েছে বার্ষিক ২ কোটি রুপি।

যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্যেও মেধা খোঁজার অন্যতম ক্ষেত্র আইআইটি কলেজগুলো। সিলিকন ভ্যালির টেক জায়ান্টরা এখানকার সেরাদের সেরা ছাত্রদের আকর্ষণীয় বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নিয়ে যায়।

৮০-র দশকে সিলিকন ভ্যালিতে অভিবাসন করে আসা আইআইটির সাবেক ছাত্র অজয় লাভাকারে জানান, আমাদের আইটি কলেজ ব্যবস্থায় গাণিতিক বিশ্লেষণ এবং প্রকৌশল দক্ষতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। অন্যান্য বিষয়েও রয়েছে সর্বাত্মক মান নিশ্চিতের চেষ্টা। এজন্যই ফরচুন-৫০০ বা মার্কিন পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত শীর্ষ ৫০০টি কোম্পানির পরিচালনায় ভারতীয়দের ওপর আস্থা বেড়েছে।

তিনি বলেন, ‘ভারতে বেড়ে ওঠার আরেকটি দিক হলো, আপনি শিক্ষা জীবন থেকেই অনিশ্চিত পরিবেশের মধ্যে তাল মিলিয়ে চলার গুণটি রপ্ত করেছেন। শিখেছেন সীমিত সম্পদ কাজে লাগিয়ে বড় লক্ষ্য অর্জনের উপায়।’

ক্যালিফোর্নিয়া বে এরিয়ার একটি বীমা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ফার্মে ইতঃপূর্বে কাজ করেছেন লাভাকারে। এখন তিনি ভারতীয় স্টার্টআপগুলোর বিনিয়োগের পাশাপাশি এর তরুণ প্রতিষ্ঠাতাদের পরামর্শ সহযোগিতা দেন।

লাভাকারে সঠিকভাবেই প্রতিকূলতা মানিয়ে চলার গুণটির কথা বলেছেন। কারণ ভারতে সরকারি হিসাবেই ২৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র শ্রেণির। অনেক অঞ্চলে রয়েছে বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের সংকট। এসব বাধার সাথে মানিয়ে জীবনধারণ শিখেছেন ভারতীয়রা। সম্পদ ও সুবিধার অভাব পূরণের এ পরিবেশে উদ্ভাবনী চেষ্টাকে তারা গুরুত্ব দেন। সীমিত সম্পদ কাজে লাগিয়ে দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর এই উদ্ভাবনী চেষ্টাকে ভারতীয়রা ‘জুগাড়’ বলেন। এটি আজ তাদের জাতীয় পরিচয়েরই অংশ।

আরও পড়তে পারেন-

ভারতীয়দের ‘জুগাড়’ নিয়ে প্রশংসা করেছেন ব্যবসা বিশেষজ্ঞরা।

‘জুগাড় ইনোভেশন’ বইয়ে এটির লেখকত্রয়—নাভি রাদজু, জয়দিপ প্রভু এবং সিমোন আহুজা—লিখেছেন, অল্প সম্পদ দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়ার এই গুণের ফলে ভারতের ব্যবসাগুলো জটিল ও সীমিত সম্পদের বৈশ্বিক বাস্তবতায় টিকে থাকা ও বিকশিত হওয়ার দক্ষতা অর্জন করেছে।

২০১৬ সালে স্ট্যানফোর্ড সোশ্যাল রিভিউ ম্যাগাজিনে লেখা নিবন্ধে একাডেমিক জামাল বোকাউরি সামাজিক উদ্ভাবনামূলক নেতৃত্বে জুগাড়কে যুক্ত করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি বলেছেন, ‘আধুনিক কোম্পানিগুলোয় এখন নতুন প্রজন্মের ও বিশ্বাসের প্রধান কর্মকর্তা দরকার…… যারা চারপাশের পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলাফেরা ও ব্যবসায় নেতৃত্ব দিতে পারবেন। একইসাথে যারা নিজ প্রতিষ্ঠানকে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার বৃহত্তর সুযোগ নেওয়ার দিকে এগিয়ে নেবেন।’

তার সাথে একমত পোষণ করে লাভাকারে জানান, তিন দশক আগে তিনি যখন সিলিকন ভ্যালিতে কর্মজীবন শুরু করেন, তখন তাকে পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউই ছিল না। ছিল না পরিচিতদের নেটওয়ার্ক। এসময় তিনি অন্যান্য সফল ভারতীয় যেমন- সান মাইক্রোসিস্টেমের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিনোদ খোসলা এবং হটমেইলের প্রতিষ্ঠাতা সাবির ভাটিয়ার সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

এখন সফল ভারতীয়রা নবাগতদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারেন এমন নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রথম প্রজন্মের সফল ভারতীয়রা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের স্বদেশীদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে শুধু সিলিকন ভ্যালির শীর্ষ পদগুলোতেই নয়, নিজ দেশে ভারতেও অনেক তরুণ উদ্যোক্তা আজ সফল ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে উঠছেন।

সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।