Home ইসলাম দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ইসলামের নির্দেশনা

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ইসলামের নির্দেশনা

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত গত সপ্তাহের এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলেছে, গত অক্টোবর পর্যন্ত সারা বিশ্বে তৃতীয় মাসের মতো খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে খাদ্যপণ্যের দাম গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৩১.৩ শতাংশ। বাংলাদেশেও গত ছয় মাসে ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে কয়েক দফায়। কোনো কোনো ভোগ্যপণ্যের মূল্য ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসলাম লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি রোধ করার নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো জনদুর্ভোগ কমাতে বাজার দর স্থিতিশীল রাখা।

বাজার দর নিয়ন্ত্রণে সাধারণ নীতি

বাজার দর নিয়ন্ত্রণে ইসলামের সাধারণ নীতি হলো পণ্য উৎপাদক পণ্যের মূল্য নির্ধারণে স্বাধীনতা ভোগ করবে। সাধারণ অবস্থায় রাষ্ট্র পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করবে না। কেননা পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিলে উৎপাদক পণ্যের মান কমিয়ে দিতে পারে। আনাস (রা.) বলেন, লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আপনি আমাদের জন্য মূল্য নির্ধারণ করে দিন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রব্যমূল্যের গতি নির্ধারণকারী, তিনিই একমাত্র সংকীর্ণতা ও প্রশস্ততা আনয়নকারী এবং তিনি জীবিকা দানকারী। আমি আল্লাহর সঙ্গে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করতে চাই, যেন তোমাদের কেউ আমার বিরুদ্ধে তার জান ও মালের ব্যাপারে জুলুমের অভিযোগ উত্থাপন করতে না পারে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩৪৫১)

আরও পড়তে পারেন-

বিশেষ অবস্থায় বিশেষ ব্যবস্থা

তবে বাজার মূল্য যদি অস্বাভাবিক রকম হয় এবং সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তবে ইসলাম বাজার দর নিয়ন্ত্রণের অনুমতি দিয়েছে। শায়খ তাহির বাদাভি বলেন, ‘উল্লিখিত হাদিস মাধ্যমে ইসলামের নবী ঘোষণা দিচ্ছেন যে বিনা প্রয়োজনে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা জুলুম। রাসুল (সা.) জুলুমের দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত থেকে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পছন্দ করেন। কিন্তু বাজারে যখন অস্বাভাবিক কার্যকারণ অনুপ্রবেশ করবে যেমন—কতিপয় ব্যবসায়ীর পণ্য মজুদকরণ এবং তাদের মূল্য কারসাজি, তখন কতিপয় ব্যক্তির স্বাধীনতার ওপর সামষ্টিক স্বার্থ প্রাধান্য লাভ করবে। এ অবস্থায় সমাজের প্রয়োজনীয়তা বা চাহিদা পূরণার্থে এবং লোভী সুবিধাভোগীদের থেকে সমাজকে রক্ষাকল্পে মূল্য নির্ধারণ করা জায়েজ। তাদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে না দেওয়ার জন্য এ নীতি স্বতঃসিদ্ধ।’ (নিজামুল ইকতিসাদি ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা ৭৮)

আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘মূল্য নির্ধারণ ছাড়া যদি মানুষের কল্যাণ পরিপূর্ণতা লাভ না করে, তাহলে শাসক তাদের জন্য ন্যায়সংগত মূল্য নির্ধারণ করবেন। কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করা বা কারো প্রতি অন্যায় করা যাবে না। আর মূল্য নির্ধারণ ছাড়াই যদি তাদের প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায় এবং কল্যাণ সাধিত হয়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান মূল্য নির্ধারণ করবেন না।’ (কিতাবুল মাজমু : ১২/১২১)

মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণগুলো

ইসলামী শরিয়ত মূল্যবৃদ্ধির প্রধান প্রধান কারণ চিহ্নিত করে তা প্রতিহত করার নির্দেশ দিয়েছে। যেমন—

১. মজুদদারি : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ মজুদদারি। বাজারে পণ্য সংকট থাকার পরও ব্যক্তি মুনাফার জন্য পণ্য গুদামজাত করে আটকে রাখা ইসলামে নিষিদ্ধ। বিশেষত তা যদি খাদ্যশস্য হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানের খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, আল্লাহ তার ওপর দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৫৫)

২. বাজার সিন্ডিকেট : বাজার দর নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা অসাধু ব্যাবসায়িক সিন্ডিকেট। ইসলামের নির্দেশনা হলো পণ্য উৎপাদনের পর তা স্বাধীনভাবে বাজারে প্রবেশ করবে। বাজার মূল্য বৃদ্ধির জন্য তা আটকে রাখবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার রাখে সে আল্লাহর জিম্মা থেকে বেরিয়ে যায়।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ২০৩৯৬)

৩. কালো বাজারি : কালোবাজারির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো হয়। কালোবাজারি সরাসরি প্রতারণা, জুলুম ও আর্থিক অসততার শামিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা নিজেরা নিজেদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ কোরো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৮)

৪. মধ্যস্বত্বভোগী : মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে ভোক্তা ন্যায্য মূল্যে পণ্য কিনতে পারে না। ইসলাম পণ্য উৎপাদনের পর তা বাজারজাতকরণ পর্যন্ত মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছে। আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের কাছ থেকে খাদ্য ক্রয় করতাম। নবী করিম (সা.) খাদ্যের বাজারে পৌঁছানোর আগে আমাদের তা ক্রয় করতে নিষেধ করলেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২১৬৬)

৫. কৃষির প্রতি অমনোযোগ : কৃষিকাজে অমনোযোগের কারণে খাদ্যপণ্যের সংকট তৈরি হয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়তে পারে। ইসলাম কৃষি ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে বলেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা জমিনের পরতে পরতে জীবিকা অন্বেষণ কোরো।’ (মাজমাউল জাওয়ায়িদ)

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে করণীয়

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে মুমিনরা নানাভাবে তা প্রতিহত করতে পারে। যেমন—

এক. মূল্য নির্ধারণ : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে রাষ্ট্র নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেবে। যেমন ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে।

দুই. বর্ধিত মূল্যের পণ্য বর্জন : ব্যবসায়ীদের অন্যায় মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সমাজ বর্ধিত মূল্যের পণ্য বর্জন করতে পারে। কেননা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে গোশতের মূল্য বৃদ্ধি পেলে লোকেরা তাঁর কাছে অভিযোগ করে তার মূল্য নির্ধারণের দাবি জানায়। তিনি বলেন, তোমরাই এর মূল্য হ্রাস করে দাও। তাদের কাছ থেকে গোশত কেনা ছেড়ে দাও। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৯/১৪১)

তিন. ক্রয়-বিক্রয়ে সহজতা : ব্যবসায়ীদের উচিত এমন কঠিন সময়ে ক্রয়-বিক্রয়ে সহজতা অবলম্বন করা। মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ এমন একজন ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যে ক্রেতা, বিক্রেতা, বিচারক ও বিচারপ্রার্থী অবস্থায় সহজতা অবলম্বনকারী ছিল। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৪৬৯৬)

ইসলামের দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক প্রকার শাস্তি। তাই দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে পাপ পরিহার করা এবং তাওবা করে ফিরে আসা আবশ্যক। আল্লাহ সবাইকে পার্থিব জীবনের এই সংকট থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন