।। আরজু মুন জারিন ।।
আমার স্বভাবে একটা নেতিবাচক দিক ছিল পূর্বে, যা আমি মনে করতাম ইতিবাচক গুণ। যা আমার দৃষ্টিতে ছিল সঠিক তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়ে যেতাম।এমনকি আপন পর মা বাবা সবার বিরুদ্ধে মত প্রচেষ্টায় লেগে যেতাম । ধারনা ছিল খানিকটা এমন, আমি ই ঠিক সবাই ভূল। আমার এই মনোভাবের জন্য আমি কোথাও প্রতিষ্ঠিত হতে পারিনি। অনেক চাকরী ছেড়ে চলে এসেছি। কোন সমালোচনা আগে একেবারে সহ্য করতে পারতাম না। বিরুদ্ধ মতের লোকদের মনে করতাম আমার প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ।
এখন সংশোধনে আসতে সমর্থ হয়েছি। আসলে ভূলে যাই পৃথিবীতে কোন সৃষ্টি বা মানুষ কখনোই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়।এমনকি সৃষ্টিকর্তা ও আমাদের সমালোচনায় আছেন।
বেশ মনে পড়ছে ছোটবেলায় দেখতাম দরজার ফাঁক দিয়ে মাকে। পাশের বিল্ডিং এর দুই চাচী আমার মায়ের প্রিয় বান্ধবী ঝগড়া তর্কে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে। আমার সরল মা বোকার মত হাসতেন কখন অপ্রস্তত হয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিতেন। ঘরে ও ছিল এক অবস্থা, মা কখনই কারও সাথে তর্ক করতেন না, জিততেন না। আমি রেগে যেতাম মায়ের অসহায় চেহারায়। কেন মা তাদের ভূল কথার জবাবে কিছু বলে না। তর্কে জেতাকে আমার সবচেয়ে বড় জয় মনে করতাম ওই পরিস্থিতিতে।
খানিক পরে আমার ওই ভুল যেত ভেঙ্গে, যখন দেখতাম দুই চাচীকে মাথা নীচু করে বাসায় ঢুকতেন। আমার মা হাসিমুখে তখন ই আপ্যায়ন শুরু করে দিতেন আগের ঝগড়া ভুলে।
ধৈর্য্য সহিষ্ণুতা এর শিক্ষাটা তখন থেকে মায়ের কাছে থেকে শেখা। চলতে চলতে পথ অতিক্রম করতে আরেকটা জিনিস শেখা হল তর্কে জেতাটা সত্যিকার জেতা নয়। সত্য সঠিক সময়ে প্রকৃতি প্রতিষ্ঠিত করে দেয় অনাড়ম্বরে কোন তর্ক চেষ্টা ছাড়া। তাই বলে কখনও অন্যায় ভুলের প্রতিবাদ করা নিষেধ তা বলি না। বিবেকের চোখ কান খোলা রেখে পথ চলা চাই।
আমার আরেকটা সরল স্বীকারোক্তি সবার জন্য। আমি লেখায় নিজেকে যেরকম চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছি সত্যি বলতে আমি ততটুকু ভাল নই। আমারও অনেক বড় বড় দোষ ত্রুটি আছে। তার অর্থ আবার এ নয়- আমি ভান করে নিজেকে ভাল বোঝানোর চেষ্টা করি। ভাল কথা লিখি, যাতে তার প্রভাব আমার মনে পড়ে।একদিন যাতে এই প্রভাবে সত্যি সত্যি নিখাঁদ ভাল মানুষ হয়ে যেতে পারি।
[ দুই ]
আমরা কীভাবে একে অপরের শ্রদ্ধাভাজন এবং আস্থাভাজন হতে পারি?
আমার এ লেখার উদ্দেশ্য সবার কাছে এ মতবাদ সরাসরি প্রচার করা নয় যে,
সদা সত্য কথা বল
কখনও মিথ্যা বলিওনা
গুরুজনে মান্য ভক্তি কর
চুরি করা মহাপাপ।
আমরা জানি এটা কত সহজ সরল কথা, মনেও করি সহজ । গভীরভাবে পালন করতে গেলে যথেষ্টই কঠিন। সঠিকভাবে তাৎপর্য্য বোধ গভীর উপলব্ধি সহ পালন শতভাগ সহজ নয়।
আমি সাধারনত যা দেখি, ভাবি এবং জীবন পথ চলায় যা শিখেছি বা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তা লিখি। কখনও কিছু আবেগের প্রকাশ যদি বাড়তিও থাকে, তা ভাল উদ্দেশ্যে আরেকজনের উপকারে প্রেরণা দেওয়ার ভাবনা থেকেই করি । তারপরেও মনে রাখতে হবে, বাড়তি প্রশংসা অনেকটা মিথ্যের শামিল।
কখনও কখন এমন হয় কিছু মানুষের জন্য অনেক করার পরও তাদের সন্তষ্টি অর্জন করা যায় না। ক্রমাগত গালি দিয়ে যাচ্ছে সবসময় নিন্দা করছে আড়ালে। মানুষের সামনে আমাদের ছোট করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। শত ইগনোর করা সত্ত্বেও আমাদের তার মুখোমুখি যুদ্ধে দাড় করানোর চেষ্টা করায়। এরকম হয় মাঝে মাঝে তাইনা?
আমার আছে এরকম কয়েকজন । আগে ছিল না, এখন হয়েছে। আমি অনেক ধরনের মত প্রচার করি। বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে কথা বলি। ফেসবুকে পাবলিকলী ছবি পোষ্ট করি।
যাই হোক, আমরা মানুষ। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হল, আক্রমণ হল আমিও আক্রমণ করি প্রতিবাদ করি। রেগে যাই, ক্ষেপে যাই। আরও বেশী যখন মনে হল একেবারে অহেতুক আক্রমণ হয় তখন বলতে বাধ্য হই, ও আমার প্রতি জেলাস।
এখন একটু ভাবি।আসলে কি তাই?
আইনষ্টাইনের গতিবিদ্যার সূত্রটি কি বলে?
“প্রতিটি ক্রিয়ারই একটি বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে” সত্যি তাই।
আমি যা করি যা ভাবি, তার ফল আমার কাছে ফিরে আসবে। কখনও আমার অলস মস্তিষ্কের ভাবনা ও কর্ম হয়ে আমার কাছে ফিরে আসে প্রাকৃতিক ক্রিয়ায়।
একটা ঘটনা পড়েছিলাম মহাজাতক এর মেডিটেশান বইতে। ঘটনাটি হুবহু মনে করতে পারছি না। কম বেশী এরকম। এক সেক্রেটারী, সে দিনরাত পরিশ্রম করে মেহনত করে কাজ করছিল বসের সন্তষ্টির জন্য। বস সন্তষ্ট হওয়া দুরে থাক সবসময় অযথা রুঢ় ব্যাবহার করে, বেতন বাড়ায় না। ধন্যবাদ বলে না কাজের শেষে। একদিন বসের খারাপ ব্যাবহার এর কারণে চোখে পানি চলে এসেছিল। সে ভাবছিল কি কারণে আমার সাথে এই ব্যাবহার করছে? বিদ্যূৎ চমকের মত পরক্ষণে তার মাথায় খেলে গেল আরে উনি তো এই ব্যাবহার করছেন যা আমি তার সম্পর্কে ভাবছি। আমি মনে মনে তাকে অশ্রদ্ধার চোখে দেখছি। তাকে মনে মনে বেয়াদব বলছি, কৃপণ বলছি, কোলাব্যাঙ বলছি, অসুন্দর হওয়ার কারণে। আমি বলছি মনে মনে তিনি বলছেন সরাসরি। তিনি শুধু আমার ভাব না আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
আরও পড়তে পারেন-
- উলামায়ে কেরামের প্রতি মুফতি শফী (রাহ.)এর দরদমাখা নসিহত
- কম্পিউটার চিপ শিল্প: জলবায়ুর উপর ফেলছে ভয়ঙ্কর প্রভাব
- ইরানি বিজ্ঞানীকে যেভাবে হত্যা করে ইসরায়েল
- ব্যতিক্রমী এক ইসলামী আইন গবেষক
- সমাজে পিতা-মাতারা অবহেলিত কেন
আমাদের নেতিবাচক ভাবনা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়ে আমাদেরই আঘাত করে। তাই, এ থেকে উত্তরণের জন্য মনকে সুন্দর শৃংঙ্খলায় আনা অন্যের প্রতি নেতিবাচক ভাবনা থেকে সরিয়ে আসা জরুরি।
তার জন্য প্রথমে আমরা আস্তে আস্তে একটু একটু আমাদের মন থেকে নেতিবাচক চিন্তার ঝড় সরাতে হবে। তাতে আস্তে আস্তে নেতিবাচক কথা সরে যাবে জীবন থেকে এবং নেতিবাচক ক্রিয়া ও দুর হয়ে যাবে জীবন থেকে। যদি আমি কখনই খারাপ না ভাবি, তাহলে কি খারাপ কাজ করব কখন ও। লেখাটি আমি খুব সরলভাবে সরল ভাষায় লিখলাম সবার বোধগম্যতার জন্য । খানিকটা এই রকম- সদা সত্য কথা বলিও এর জায়গায়-
“সদা সত্য ভাবিও,
সুন্দরভাবে সৎভাবে”।
এই হোক সবার শ্লোগান, সবার ভাবনা।। সবার অনেক সুন্দর জীবন কামনায়…।
[ তিন ]
ভক্তি মূল
ভক্তি মূক্তি
ভক্তিতে শক্তি।
পাথর মূর্তির পদতলে
মন্দিরে ফলাহার, প্রসাদ, পূজায়
মসজিদে প্রার্থনায়, গির্জায় উপাসনায় —
পূজারী, নামাযী জানে কি অসীম ভক্তিতে
মহাশক্তির অর্পনে এই মহার্ঘ্য।
মহাশক্তিও বুঝতে পারে ভক্তের হৃদয়ের ভক্তি। তৃতীয় পক্ষ্যের চোখে এ হয়ত নেহায়াত লোকাচার বা এই রীতিনীতি তার বোধগম্যতার বাহিরে। যার আচার তার কাছে যেমন শ্রদ্ধার। স্রষ্ট্রার কাছে যেমন আকাঙ্ক্ষার। আমি নিমিত্তের কাছে হোক তা বোধের।
আমাদের বোধকে জাগ্রত করি। বোধ দিয়ে বোধ করি দুই চোখ এর সাথে তৃতীয় চোখ। অন্তর্নিহিত দৃষ্টিকে জাগ্রত করি।
আমার মা চলে গেলেন কাল আচমকাই। জন্ম হলে মৃত্যূ তো অবধারিত। আমি ও চলে যাব একদিন এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে আমার মায়ের মত।
খুব জানতে ইচ্ছে করে মত্যূর পরের জগতটা কেমন। মৃত্যূর পরে যদি আবার বেঁচে ফিরে আসা যেত, তাহলে মৃত্যূ পরের আবহ এবং যন্ত্রণা নিয়ে লিখতে পারতাম।
মায়ের মারা যাওয়ার মূহূর্তের কষ্টটা অনূভব করতে ইচ্ছে হচ্ছে । মা আর আমি আমাদের সব আনন্দ, বেদনা ভাগ করে নিতাম। তাতে আমাদের ব্যাথা বেদনা কমে যেত, যেমন অনেক খানি আনন্দের পরিমান বেড়ে যেত বহুলাংশে।
মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিল আমার বড় বন্ধুর মত। গভীর একটা কানেকশান সবসময় কাজ করত আমাদের সবসময়। কোন কারণে মন খারাপ হলে বা শরীর অসুস্থ হলে সঙ্গে সঙ্গে মায়ের ফোন চলে আসত। আমি বলতে চাইতাম না টেনশন করেন বলে। কিন্তু না বললেও আমার কোন অনুভূতি তাঁর কাছে গোপন থাকত না। খুব দূঃশ্চিন্তা হচ্ছিল মাকে কবে দেখব, কীভাবে এখানে আনব, ভেবে। আমাকে দূঃশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করতে হয়ত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন এই পৃথিবী ছেড়ে।
অনেক কিছু করার ছিল মায়ের জন্য । করতে পারিনি। অনেক দোওয়া চাই সবার কাছে আমার মায়ের জন্য। তাঁর পরকালের জীবন যেন ভাল ও শান্তির হয়।
অনেক ভালবাসা কৃতজ্ঞতা রইল আমার মা সহ সব মায়ের জন্য। সব মায়েরা ভাল থাকুক এইজীবনে এবং পরের জীবনে।
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম