বর্তমানে চীনজুড়ে প্রায় ৩ কোটি অবিক্রীত বাসস্থান রয়েছে, যেগুলোয় থাকতে পারবে প্রায় ৮ কোটি মানুষ, যা জার্মানির মোট জনসংখ্যার সমান।
এছাড়া, প্রায় ১০ কোটি বাসস্থান রয়েছে যেগুলো বিক্রীত হলেও সেখানে বাস করে না কেউ। ক্যাপিটাল ইকোনোমিক্সের মতে, ২৬ কোটিরও বেশি মানুষ বসবাস করতে পারবে এই পরিত্যক্ত ফ্ল্যাটগুলোয়।
এসব আবাসন প্রকল্প অনেক বছর ধরেই সমালোচিত হয়ে আসছে। এসব প্রকল্পের ফলে সৃষ্টি হওয়া জনশূন্য শহরগুলোকে সবাই এখন চীনের “ভূতুড়ে শহর” নামে ডাকছে।
এই সমস্যার সূত্রপাত কোথায় এবং বর্তমানে এই প্রকল্পগুলোর চলমান অবস্থার উপর দৃষ্টিপাত করা হবে এই প্রতিবেদনে।
রিয়েল এস্টেট এবং এ সংশ্লিষ্ট খাতগুলো চীনের অর্থনীতির একটি বড় অংশ। দেশটির বার্ষিক জিডিপির ৩০ শতাংশই আসে এই খাত থেকে।
ক্যাপিটাল ইকোনমিক্সের এশিয়া সেক্টরের প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্ক উইলিয়ামসের মতে, নির্মাণ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের অর্থনৈতিক মুনাফা অন্যান্য প্রধান অর্থনৈতিক সেক্টরগুলোর চেয়ে বেশি। কয়েক দশক ধরে এ খাতই চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখতে সাহায্য করেছে।
কিন্তু বছরের পর বছর ধরেই সমালোচকরা প্রশ্ন করে আসছিলেন, প্রবৃদ্ধির এই ইঞ্জিনই কি চীনের জন্য একটি টাইম বোমা তৈরি করছে কিনা। এর পিছনে কারণ হিসেবে এসব প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য অনেক ডেভেলপারের নেওয়া বিশাল অঙ্কের ঋণের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন অনেকেই।
আরও পড়তে পারেন-
- উলামায়ে কেরামের প্রতি মুফতি শফী (রাহ.)এর দরদমাখা নসিহত
- কম্পিউটার চিপ শিল্প: জলবায়ুর উপর ফেলছে ভয়ঙ্কর প্রভাব
- ইরানি বিজ্ঞানীকে যেভাবে হত্যা করে ইসরায়েল
- ব্যতিক্রমী এক ইসলামী আইন গবেষক
- ইবাদতের গুরুত্ব নিয়ে ঠাট্টা-তাচ্ছিল্য জঘন্য গুনাহ
চীনের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত ডেভেলপার, এভারগ্রান্ড, তাদের তিন লাখ কোটি ডলারের ঋণের বোঝা নিয়ে অস্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির বৈশ্বিক নমুনাই বনে গিয়েছে।
তবে এভারগ্রান্ড একাই ধুঁকছে না। গত কয়েক মাসে বেশ কিছু ডেভেলপার তাদের নিজস্ব অর্থ সংকটের কথা প্রকাশ করেছে, এবং ঋণদাতাদের কাছে অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য সময় চেয়েছে।
মুডিজ অ্যানালিটিক্সের অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টিনা ঝু সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, ১২টি চীনা রিয়েল এস্টেট সংস্থা বছরের প্রথমার্ধে প্রায় ১৯,২০০ কোটি ইউয়ানের (প্রায় ৩০০ কোটি ডলারের) বন্ড পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি বলেন, “এটি বছরের প্রথম ছয় মাসে মোট কর্পোরেট বন্ড খেলাপির প্রায় ২০ শতাংশ, যা চীনের যেকোনো খাতের মধ্যেই সর্বোচ্চ।”
মহামারী এসব কার্যক্রমকে সাময়িকভাবে স্থবির করে দিয়েছিল। কিন্তু সবকিছু খুলে দেওয়ার পর থেকে নির্মাণকাজ আবারও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে চীনে। এবং দেশের বাসস্থানের বাজার সাময়িকভাবে ঊর্ধ্বগামী হয়েছিল এ সময়ে। কিন্তু এরপর আবারো নিম্নগামী হতে শুরু করেছে এ বাজার।
ঝু আরও উল্লেখ করেন, গত কয়েক মাসে মূল্য বৃদ্ধি ব্যবস্থা, আবাসন নির্মাণ শুরু এবং বিক্রয় উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। আগস্ট মাসে আবাসন খাতে বিক্রয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
একই মাসে, নতুন বাড়ির দাম ৩.৫ শতাংশ বেড়েছে, যা মহামারী-পরবর্তী বাজারে সর্বনিম্ন বৃদ্ধি।
উইলিয়ামস তার একটি গবেষণা প্রবন্ধে লিখেছেন, “চীনের আবাসিক সম্পত্তির চাহিদা ক্রমাগত হ্রাসের যুগে প্রবেশ করছে।” তিনি এটিকে “এভারগ্রান্ডে ও অন্যান্য উচ্চ-বিত্ত ডেভেলপারদের সমস্যার মূল” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এরপর আছে অসমাপ্ত প্রকল্পের সমস্যা। চীনে নতুন বাসস্থানের প্রায় ৯০ শতাংশ বিক্রি হয়ে যায় নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই। যার মানে, নির্মাতাদের যেকোনো বিপত্তি সরাসরি ক্রেতাদের প্রভাবিত করে।
ব্যাংক অফ আমেরিকার সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ অনুসারে, এভারগ্রান্ড প্রায় দুই লাখ আবাসন ইউনিট বিক্রি করেছে যেগুলো এখনো ক্রেতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম ডেভেলপার তাদের ক্রেতাদের খালি হাতে ফিরিয়ে দিবে, এই আশঙ্কা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে চীনা সরকার অবশ্য এ সংকট যেন ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে না পারে এবং এ সংকট থেকে সাধারণ মানুষ যেন সুরক্ষিত থাকে, সেদিকে মনোনিবেশ করেছে। গত মাসের শেষদিকে দেওয়া এক বিবৃতিতে পিপলস ব্যাংক অফ চায়না “রিয়েল এস্টেট বাজারের সুস্থ বিকাশ বজায় রাখার এবং আবাসন ভোক্তাদের বৈধ অধিকার এবং স্বার্থ রক্ষা করার” প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
যদিও এ বিবৃতিতে এভারগ্রান্ডের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়নি, তবে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্টদের অর্থ সহায়তা দেওয়া শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, সব কোম্পানিই কিন্তু সংকটের মুখে না। ক্যাপিটাল ইকোনমিক্সের একজন জ্যেষ্ঠ চীনা অর্থনীতিবিদ জুলিয়ান ইভান্স-প্রিচার্ডের মতে, যদিও কিছু কোম্পানি বেশ ভালোভাবেই ধুঁকছে, কিন্তু “বেশিরভাগ ডেভেলপার খেলাপির দ্বারপ্রান্তে নেই”।
“কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, বেশিরভাগ শীর্ষ ডেভেলপারই এভারগ্রান্ডের তুলনায় আর্থিকভাবে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এবং বাজারে ধস নামার আশঙ্কার মাঝে এরা তাদের ঋণ খরচে সাময়িক বৃদ্ধিকে কাটিয়ে উঠতে পারবে। বর্তমান বাজারের উত্তেজনার মাঝে অন্তত স্বল্প মেয়াদে ভোক্তাদের কিছুটা আশ্বাস দিবে এটি।”
কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই আর্থিক সামর্থ্যের কোনো মূল্য নাও থাকতে পারে। “আগামী দশকে আবাসন চাহিদার কাঠামোগত পতন সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। বহু বছর ধরে এই খাতের একত্রীকরণ ডেভেলপারদের ব্যর্থতার আসন্ন তরঙ্গের চেয়ে বেশি সম্ভাব্য বলে মনে হচ্ছে,” যোগ করেন ইভান্স-প্রিচার্ড।
সূত্র: সিএনএন
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ