।। বিনতে এন. এম. জাহাঙ্গীর ।।
দিন দিন প্রযুক্তির চমক যত বাড়ছে, ধীরে ধীরে (অনেকের কাছে) ততই কমে আসছে অফলাইন জগতের আকর্ষণীয়তা! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা হয়ত এতটাই এক্টিভ যে, দেশ-বিদেশে নিত্য-নতুন বন্ধু যুগিয়ে নিচ্ছি। অনলাইনের বাইরে নিজেদের অফলাইন জগতে আমাদের চরম দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে! পরস্পরের স্বজনদের মজলিসগুলোর মাঝেও যেন মনটা পড়ে থাকে, ম্যসেঞ্জারের ইনবক্সে বা নটিফিকেশনের তালিকায়! সন্তানদের সাথেও হয়ত মা-বাবারা আগের মত সময় দিতে পারেননা। যেটুকু সময় অবসর পান, তা-ও চলে যায় অনলাইনের পেছনে। আজকাল সন্তানদের মনের অভিমান ও অভিব্যাক্তিগুলোকে যদি তরজমা করা যেত, তবে তা হয়ত এমনি হত-
বিষন্ন এক বিকেলে জানালা দিয়ে খোলা আকাশ দেখছিল মেয়েটি। নীল আকাশের বুকে শুভ্র মেঘের বিচরণ দৃশ্য, প্রতিদিন তাঁকে মুগ্ধ করে!! নীল আকাশপানে চেয়েই সে মনের উচ্ছাস প্রকাশ করে! আবার বিষন্নতার সময়গুলোতেও সে আকাশের নীলিমায় সান্ত¡না খোঁজে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে..!! মনের নীলিমায় জমিয়ে রাখা না বলা কথাগুলো আজ তার হৃদয়াকাশকে মেঘলা-আধাঁর করে রেখেছে! কারো প্রতি তাঁর অভিযোগ নেই! অথবা সে অভিযোগ করতেও চায়না! সে শুধু জানতে চায় কিছু কথা। কিন্তু..সেই সাহস কখনো তাঁর নেই। তাই মনের কথা মনেই থেকে যায়। ‘জিজ্ঞাসা’ হয়ে প্রকাশিত হয়না এবং জবাব হয়েও ফিরে আসে না!
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
কোন কারণে সেই কথাগুলো নতুন করে আজ মনে পড়ছে! বরফের টুকরো সদৃশ মেঘমালার মাঝে মাঝে উঁিক দেয়া নীল আসমান ধীরে ধীরে গোধূলী বর্ণ ধারণ করছে। সে আজ নিজে নিজে গায়বিভাবে জিজ্ঞেস করল ও বলে গেল না বলা সেই কথাটি-
“আব্বু! অতীত ও বর্তমানের মাঝে এত তফাত কেন আব্বু! তুমি,আমি ও আমরা তো আগের মতই রয়েছি! তবু এত দূরত্ব কেন !! এত আজনাবী কেন লাগে আব্বুজি!! সকালে তুমি চলে যেতে তোমার কর্মস্থলে! সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে শেষ বিকেলে তুমি বাসায় ফিরে আসতে আব্বুজি! একসাথে আমরা নাস্তা করতাম, তাইনা বলো আব্বু! হোক টুকরো পিঠা বা শুকনো মুড়ি; সুস্বাদু হয়ে উঠতো, যখন তাতে সকলের হাতের ছোঁয়া লাগতো! আমি খেতে চাইতাম না। তুমি জোর করতে,কখনো তিরস্কার করতে! তবুও তো ভাল লাগতো! পিতৃস্নেহে মনটা শিশিরসিক্ত হতো আব্বু!! সারাদিনের জমিয়ে রাখা কত কথা বলতে তোমরা! আমি শুনতাম, কখনোবা বলতাম! কিন্তু…
গত দু’বছর আগে (আমার চরম অনিচ্ছাসত্ত্বেও) তোমার হাতে উঠলো স্মার্টফোন এবং অনেকটাই অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠলো ‘এতদিনের প্রিয় ছোট্ট ফোনটি’! আমার ভেতর থেকে প্রথমেই কেন যেন সাড়া আসছিল না! যেদিন তুমি স্মার্ট ফোন নাও, আমি গভীর রাতে ‘তাঁর’ কাছে খুব মিনতি করি..রব! আমাকে হেফাজত করো এই ধ্বংসাত্মক আসবাব হতে..! তা হয়ত তুমি জানো না! আব্বু! স্মার্ট ফোনের জগত এত রঙিন ও তুমি তাতে এভাবে রাঙিয়ে যাবে কখনো তো ভাবিনি! হোক না ভাল কিছু, কিন্তু সময়ের ইসরাফ, সেটা?! ধীরে ধীরে আমাদের সাথে সময় কাটানোর পরিমাণ কমে এলো। তবুও আমি বসে থাকতাম তোমার ওখানে, কিন্তু আব্বু তো স্মার্টফোনের জগতে বিভোর, সময় কোথায় কথা বলার! দিন যত যায়, ততই যেন কেমন আজনাবিয়্যাত হতে থাকি আমরা…!
আব্বু! আগে মাঝে মাঝে অভিমান লাগতো, গাল ফুলাতে ইচ্ছে করতো, কিন্তু এখন করি না! কারণ, তোমার হয়ত ‘আনস্মার্ট’ অভিমান ভালো লাগবে না আব্বু! প্রায়ই আমি তোমার কামরার দরওয়াজায় দাঁড়িয়ে থাকতাম, হয়ত আব্বু তাকাবে বা কথা বলবে, কিন্তু..আব্বু যে স্মার্ট জগতে!
এখন আর বিকেলে নাস্তার জন্য ‘তিন বয়সী’ হাতের একত্র হবার দৃশ্য অবলোকন করা হয় না! যেমনটা আর দু’এক বছর আগেও হয়েছে! এখন আব্বুর সাথে কথা হয় খুব কম! আব্বুর সাথে আর গল্প শোনা হয় না এবং হয় না বলাও! আমার কামরা হতে শুনতে পাই আব্বুর কণ্ঠ; আব্বু ইমোতে কথা বলেন দেশী-বিদেশী সব বন্ধু-সহকর্মী ও স্বজনদের সাথে! হয়ত তাঁরা স্মার্ট, আমি হয়তবা নই! আজও নীল আকাশের মেঘের শুভ্রতা আমায় মুগ্ধ করে, যেমন করতো আগে! আব্বুকে আমি ভালবাসি, যেমন ভালবাসি আম্মুকে! আব্বুকে আজ জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, আব্বু! কেন এমন হল?! আমি কি মুজরিম? নাকি স্মার্টফোন আমার থেকে স্মার্ট..?!”
– বিনতে এন, এম, জাহাঙ্গীর, ওয়াপদা কলোনী, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
মেইল- jahangirbwdb63@gmail.com
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ