।। যাইনাব বিনতে মুহাম্মাদ আলী ।।
আমার তো কোন দোষ ছিল না। আমি ছিলাম নির্দোষ। কিন্তু তাও আমি এভাবে অপমানিত হলাম! অপমানে প্রচুর কান্না আসছে। ইচ্ছে করছে সব্বাইকে বুঝিয়ে বলি আমি দোষী নই।
না! আসলে এমন কোন কিছুই করার প্রয়োজন নেই। আমি কাদঁবো অবশ্যই! অভিযোগও করবো! আমার রবের দরবারে! আমি কখনো একা নই। মহান রাব্বুল আলামীন আমার পাশেই আছেন সব সময়!
একমাত্র তিনিই সব জানেন, তিনিই দেখেছেন সব। এভাবে চিন্তা করতেই মিটে গেলো আমার সব দুঃখ। কারণ প্রভুর দরবারে জমা দিয়েছি আমার সব অভিযোগ। নিশ্চয়ই রব আমাকে উপযুক্ত প্রতিদান দেবেন। আমার রব তো আমাকে বলেই রেখেছেন-
” তোমরা আমাকে ডাকো। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো।” [১]
আমাদের ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য সবসময়ই আমার রব প্রস্তুত আছেন। আমরাই বরং রবের সাথে কথা বলছি না। আমরা গিয়ে অফিসের বসের কাছে তদবির করছি প্রমোশনের জন্য। আত্মীয়ের কাছে গিয়ে সুপারিশ চাচ্ছি চাকরির জন্য। পীরের কাছে গিয়ে হাজার হাজার টাকা নর্দমায় ফেলছি সন্তানের জন্য। মন্ত্রীর পেছনে দৌঁড়াচ্ছি সরকারি প্রজেক্টের কন্ট্রাক্টের জন্য। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের জন্য দলবেঁধে চলে যাচ্ছি মাজারে। দোয়ার জন্য যাচ্ছি হুজুরদের কাছে।
আমরা এদেরকে যেই ক্ষমতা দিচ্ছি, সেই ক্ষমতা তাদের নেই। তারপরেও তাদের কাছে আমাদের কত অনুনয় বিনয়! অথচ যিনি একমাত্র দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন তাঁকেই ভুলে আছি হয়তো নিজেরই অজান্তে।
এত দৌঁড়ঝাপের প্রয়োজন তো নেই। আমার রবকে বললেই আমাদের সব ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি নিজেই। সব সমাধান করে দেবেন আমাদের উপযুক্ত সময়েই!
দুঃখের কথা – মন খারাপের গল্প -জীবনের যত অভিযোগ – না পাওয়ার বেদনা কাকে জানাবেন? প্রিয় কোন বন্ধুকে? পরম আত্বীয়কে? স্বামীকে? স্ত্রীকে? সন্তানকে? নাকি দূর সম্পর্কের কাউকে?
জানাতে পারেন যে কোন কাউকেই! অত:পর বেড়ে যাবে আপনার আরো চিন্তা – আরো দুঃখ -আরো বেদনা। কারন দুঃখ লাঘব তো কেউ করতে পারলোই না তার মধ্যে সময়ে অসময়ে আপনার দুর্বল জায়গায় আঘাত করে আপনাকে হাসির পাত্র বানাতেও কার্পণ্য করবে না এ ছোট্ট পৃথিবীতে থাকা আপনার আশে পাশের শুভাকাঙ্ক্ষীরা! তাই,
“মনের কথা মনেই থাক
জানুক শুধু আমার রব
এক বেলায় দিলের আশা
ঠিক সময়ে ফলবে সব।” [২]
যদি কখনো কখনো সাহায্য সহযোগিতা করে দেখবেন একদিন ঠিকই দেখিয়ে দেবে। খোঁটা দেবে। আপনাকে কাজে লাগাবে। বিনিময় চাইবে। মানুষের কাছে নিজের সমস্যা বলে ছোট হবেন না। বরং আমার রবের কাছে বলুন, তিনি নীরবে শুনে নীরবেই সমাধান করে দেবেন।
তাই, মনের যত যন্ত্রণা আছে, দুঃখ আছে, স্বপ্ন আছে, চাওয়া পাওয়া আছে সব খুলে বলুন আপনার রবকে। হোক সেটা যে কোন মুহুর্তে, সেজদাতে, মোনাজাতে, গভীর রাতে সালাতে দাড়িয়ে! বলতে থাকুন প্রান খুলে, চাইতে থাকুন হৃদয় উজাড় করে! তিনি আপনাকে দিতে কার্পণ্য করবেন না। সময় -অসময়ে আপনার দুর্বল জায়গায় আপনাকে আঘাত করবে না, আপনার কথা চারদিকে বলে বেড়াবেন না, আপনাকে হাসির পাত্র বানাবেন না। বরং তিনি আপনার সব দোয়া কবুল করবেন তারঁই সময় মতো! তিনি ভালো করেই জানেন, কখন আপনার কি প্রয়োজন? তিনি জানেন কোনটি আপনার দুনিয়াতে প্রয়োজন আর কোনটি আখেরাতে। তিনি যা করবেন তা আপনার কল্যানের জন্যই করবেন।
পাপের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন? এমন কোন গুনাহ নেই যা আপনি করেন নি? এত বেশি গুনাহ করেছেন যার অধিকাংশ মনেও নেই? রাতের নির্জনে গুনাহ করেছেন?
ব্যাপার না! কারণ আপনি এখন আপনার রবের দরবারে অনুতপ্ত। আপনার মনে এখন রাব্বে কারীমের ভয় জাগ্রত হয়েছে। আর ভাবছেন এত গুনাহ করলাম কিভাবে এখন গুনাহমুক্ত হবেন?
এতে করে আপনার শুধু অল্প কাজ করতে হবে। তাওবার সাথে সাথে দৃঢ়ভাবে প্রত্যেক গুনাহগুলো বর্জন করার ওয়াদা করবেন আমার রবের সাথেই। আর কেঁদে কেঁদে সব বলবেন রাব্বে কারীমের দরবারে। দেখবেন মনে মনে রবের সাথে এমন কানেকশন তৈরি হবে আপনি শুধু রবের সন্তুষ্টির জন্যই সব করবেন।
হাসান আল-বসরী রহি’মাহুল্লাহকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, “একজন বান্দা তার গুনাহর জন্য আল্লাহর কাছে তাওবাহ করে, আবার গুনাহ করে। সে পুনরায় তাওবাহ করে কিন্তু আবার সে গুনাহ করে ফেলে। এইভাবে বারবার গুনাহ করতে এবং তারপর আল্লাহর কাছে তাওবাহ করতে কি তার লজ্জিত হওয়া উচিৎ নয়?” হাসান আল-বসরী রহি’মাহুল্লাহ উত্তরে বলেন, “শয়তান তো এটাই চায়। এইভাবে বারবার সে বান্দাকে গুনাহতে লিপ্ত করবে, যাতে করে সে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে তাওবাহ করা ছেড়ে দেয়। সুতরাং সেই বান্দা যেন (আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হয় এবং) তাওবাহ করতে ক্লান্ত না হয়।” [৩]
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
চমৎকার এই কথামালাটি এখানে তুলে ধরার প্রয়োজন মনে করলাম- “স্রষ্টা বলেছেন, ‘তুমি যাকে’ই আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসবে’, আমি তাকে’ই তোমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাবো। এবং তোমাকে একা করে রাখব। তিনি আরও বলেছেন, ‘কখনো বলবেনা আমি তাকে ছাড়া বাঁচবোনা।’ তবে আমি তাকে ছাড়াই তোমাকে বাঁচাবো। এবং পেছনের অনুগত সব আবেগ কেড়ে নিয়ে, তোমাকে দিব্যি সামনে নিয়ে যাব! তুমি কী দ্যাখো না? ঋতুরাও বদলাতে থাকে। ছায়া দেয়া গাছের পাতাও যায় শুকিয়ে। ধৈর্য্যে হারিয়ে যায়। কিন্তু তোমার স্রষ্টা ধৈর্যশীল ও পরম দয়ালু, সেই ঝরে যাওয়া পাতার ডাল থেকেই আবার সবুজ পাতা গজায়, তুমি কী দ্যাখো না তোমার স্রষ্টার এই নিদর্শন?
যে মানুষটাকে তুমি নিজের অংশ ভাবতে, সেই মানুষটাই একদিন অচেনা হয়ে যায়। তোমার মন ভেঙে যায়! এমনকি তোমার বন্ধুও শত্রুতে পরিণত হয় আর শত্রুও খানিক সময় পরে পরিণত হয় বন্ধুতে। যে মানুষটাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে সেও প্রতারণা করে। তবে তুমি কেন স্রষ্টা বিমুখ হয়ে মানুষকে ভরসা করো?
অদ্ভুত এই পৃথিবী! যখন তুমি ভাবো এটা হবে না কখনো, কিন্তু পরোক্ষণে সেটাই হয়। সেটাই হবার নয় কী? তুমি বলো, ‘আমি পড়বোনা’ অথচ তুমি পড়ো। তুমি বলো, ‘আমি বিস্মিত হবোনা!’ অথচ তুমি রোজ বিস্মিত হও। এবং সবচেয়ে বিচিত্র বিষয় হচ্ছে- তুমি বলতে থাকো ‘আমি মরে গেছি’ অথচ তুমি বাঁচো। অথচ তুমি বেঁচে থাকো। তোমার স্রষ্টা তোমাকে বাঁচায়, তোমার স্রষ্টা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখে! [৪]
মাঝে মাঝে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমাদের দুর্বল করে দেন, অধিক শক্তিশালী হবার জন্য। আবার কখনো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমাদের হৃদয় চূর্ণ করে দেন, আমাদের পরিপূর্ণ করার জন্য। কখনো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমাদের দুঃখ সইতে দেন, অধিক সহনশীল হবার জন্য। কখনো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমাদের ব্যর্থতা দেন, জীবন সংগ্রামে জয়ী হবার জন্য। আবার কখনো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমাদের একাকীত্ব দেন, অধিক সচেতন হবার জন্য। কখনো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমাদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেন, তাঁরই রহমতের মূল্য বুঝার জন্য!
আল্লাহ রব্বুল আলামীন__ইরশাদ করেছেন- “এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করবো কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে, তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।” [৫]
এই সব পরীক্ষায় আমরা প্রায় সবাই-ই কম বেশি পড়ে থাকি! কিন্তু আমাদের রব তো আমাদের খুব ভালোবাসেন। তাইতো আমাদেরকে সৃষ্টির সেরা আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে পাঠিয়েছেন। শুধু এতটুকুই নয় আমাদেরকে মুসলমান হিসেবে পাঠিয়েছেন প্রিয় নবীজির উম্মত করে। আলহামদুলিল্লাহ।
কত্ত ভালোবাসেন! এগুলোতো আমরা না চাওয়া সত্ত্বেও পেয়েছি। তাহলে আমরা যা চাইবো তা রাব্বুল আলামীন আমাদের কিভাবে না দিয়ে পারবেন?
চলুন, চাইতে থাকি আমার রবের কাছে।
রেফারেন্স:
[১] সূরা আল মু’মিন/গাফির ৪০ : ৬০
[২] চার লাইনের কবিতা, যাইনাব বিনতে মুহাম্মাদ আলী
[৩] ইমাম ইবনে রজব রহি’মাহুল্লাহ বর্ণনা করেছেন, জামিউল উলূম ওয়াল হিকামঃ ২০৫
[৪] জালালউদ্দিন মোহাম্মদ রুমি
[৫] সূরা আল বাক্বারাহ -১৫৫
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ