।। মুফতি আবদুল্লাহ নাজীব ।।
ইসলাম সদা জীবন্ত চির প্রাণবন্ত :
ইসলাম জীবন্ত ও প্রাণবন্ত একটি দ্বীন। যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তিনিই আমাদের জন্য এ দ্বীন মনোনীত করেছেন। তিনিই ভাল জানেন, কোন পথে আমাদের কল্যাণ; কোন কাজে আমাদের মঙ্গল। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি জানবেন না? অথচ তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক জ্ঞাত’। (সূরা মুলক: ১৪) তিনিই আমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করেছেন এবং তাঁরই ঘোষণা- কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে এ দ্বীন।
ইসলাম কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে; সেভাবেই সাজানো হয়েছে ইসলামকে। ইসলামের প্রতিটি মূলনীতি এক একটি সুদৃঢ় স্তম্ভ। যার শেকড় পৃথিবীতে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং অগ্রভাগ আকাশে উড্ডীন। যেকোনো সমাজ, যেকোনো যুগ, যেকোনো সভ্যতাকে আগলে নিয়ে প্রভাবিত করার ক্ষমতা ইসলামের রয়েছে। যুগ পরিবর্তন হোক; সময়ে বিবর্তন আসুক; প্রকৃতি রূপান্তরিত হোক; সর্বাবস্থায় ইসলাম প্রাণবন্ত ও জীবন্ত; ছিলো, আছে এবং থাকবে। এমন সামর্থ্য ও দৃঢ়তা দ্বারাই সৃজিত হয়েছে ইসলাম নামক বৃক্ষটি।
ইসলামের এই প্রাণবন্ততা নিছক কোনো দাবি নয়; বরং স্বীকৃত বাস্তবতা। ইতিহাস এর উত্তম সাক্ষী। ইসলামের দাওয়াতের সূচনা থেকে খেলাফতের শেষ কাল পর্যন্ত ইতিহাস এ দাবির উজ্জ্বল সাক্ষ্য হয়েছে। এই সুদীর্ঘ পরিক্রমায় ইসলাম প্রভাবিত করেছে অজস্র সভ্যতাকে; সমাজ ও সমাজ ব্যবস্থাকে; পাল্টে দিয়েছে হাজারো প্রাচীন রীতিনীতি; এমনকি মুখের ভাষাও। এমন দাস্তান সুপ্ত রয়েছে ইসলামী ইতিহাসের পরতে পরতে। আজকের আধুনিক সভ্যতার চেয়ে শক্তিশালী সভ্যতাকে পরাস্ত করে নিজেকে প্রতিস্থাপন করেছে এই ইসলাম। বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে, ইসলাম চির আধুনিক; বরং অত্যাধুনিক।
ইসলামের আওয়াজ গুঞ্জরিত হয় মক্কাভূমিতে। যেখানে পূর্ব থেকেই একটি সভ্যতা দাঁড়িয়ে ছিলো। আপন বৈশিষ্ট্য ও ঔজ্জল্য নিয়েই তা প্রতিষ্ঠিত ছিলো। ছিলো নিজস্ব ধ্যান-ধারণা; রসম-রেওয়াজ। ছিলো বিপুল অর্থ ও ক্ষমতা। আল্লাহর ঘরের পড়শি হিসেবে ছিলো তাদের আলাদা মান-মর্যাদা, প্রভাব ও প্রতাপ। তারা নিজেদের সভ্যতার প্রতি পূর্ণ একনিষ্ঠ ছিলো। পূর্ণ নিষ্ঠা ও ভালবাসা দিয়েই লালন করতো নিজেদের সভ্যতাকে। সেখানেই গুঞ্জরিত হলো ইসলামের তাওহীদী কালিমা। ইসলাম এক দিকে তাদের অন্তরে লালিত বিশ্বাসকে আঘাত করলো; অন্যদিকে বাহ্যিক জীবন ও সমাজ ব্যবস্থার সংশোধন করতে চাইলো। আরম্ভ হলো ইসলাম ও নগর সভ্যতার সংঘাত। দ্বন্দ্ব আর বিরোধ তুঙ্গে উঠলো। নানাবিধ সংকট, আঘাত ও নির্যাতনে জর্জরিত হলো ইসলাম। এ ছিলো অস্তিত্বের লড়াই। ধীরে ধীরে ইসলাম জেগে উঠলো। প্রস্ফুটিত হতে থাকলো অহীর পুষ্পগুলো। সুরভিত হলো মক্কানগরী আর আরবভূমি। নত হলো সেই বর্বর সভ্যতা। প্রতিস্থাপিত হলো ইসলাম। মানুষ ভুলে গেলো নিজের প্রাচীন বিশ্বাস, মর্যাদা, জীবন ও সমাজ ব্যবস্থা। ইসলাম তাদেরকে বর্বরতা থেকে মুক্তি দিলো। তাদের আলোর পথে নিয়ে এলো। তাদেরকে সভ্য ও আদর্শ করে তুললো। আরবদের পূর্বের ও পরের অবস্থা সুন্দররূপে তুলে ধরেছেন বিশিষ্ট তাবেঈ কাতাদা রহ.। তিনি বলেন-
“আরবের এ জাতিটি ছিলো তৎকালীন সবচেয়ে দুর্ভাগা, নীচ, ভ্রষ্ট ও অভাবী জাতিগোষ্ঠীগুলোর একটি। পারস্য ও রোম নামক দুটি সিংহের থাবায় তারা ছিলো বন্দী। ঈর্ষণীয় ছিলো না তাদের কোনো কিছু। জীবন ছিলো কষ্টের আর মৃত্যু ছিলো কুফরের। এককথায় তাদের চেয়ে অসভ্য ও দুর্ভাগা জাতি আর তখন ছিলো না। অতঃপর আল্লাহ তাদের মাঝে ইসলাম প্রেরণ করলেন। তারা আল্লাহর কিতাবের উত্তরাধিকার হলো। বিজিত অঞ্চলসমূহ তাদের হাতে এলো। তারা লাভ করলো অনেক নেয়ামত ও রাজত্ব।
আল্লাহ ইসলামের মাধ্যমেই তোমাদের এতো কিছু দান করেছেন। সুতরাং তোমরা তার শুকরিয়া জ্ঞাপন করো। আল্লাহ শোকরগুযারদের পছন্দ করেন এবং আরো বাড়িয়ে দেন।”
মক্কা বিজয় নিছক একটি ভূখ-ের বিজয় ছিলো না; বরং তা ছিলো একটি দ্বীনের বিজয়। একটি সভ্যতার বিজয়। অন্য একটি সভ্যতার পরাজয়। ইসলাম আরবের বর্বর সভ্যতাকে পরাজিত করেছে। আরবকে দান করেছে একটি নির্মল দ্বীন ও অনন্য সভ্যতা।
ইসলাম থেমে থাকেনি। পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতার দিকে অগ্রসর হয়েছে। ছোট-বড় বিভিন্ন সমাজ ও মানবগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করেছে। এটি একটি স্বীকৃত বাস্তবতা যে, প্রতিটি মানব গোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ধর্ম ও সভ্যতা। পৃথিবীতে ধর্মহীন কোনো সমাজ নেই। বিশিষ্ট পশ্চিমা গবেষক ঐবহৎর ইধৎমংড়হ বলেন, ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিবর্জিত অনেক সমাজ আছে এবং ভবিষ্যতে থাকবে; তবে ধর্মহীন কোনো সমাজ পাওয়া যায়নি; যাবেও না’। (Henri Bargson les dexu Sources de la Morale et de la Religion. p.105 দ্র. আদ-দ্বীন পৃ.৮৪)।
ইসলাম প্রতিটি সমাজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। প্রতিটি সভ্যতা আর সমাজব্যবস্থার গোড়ায় হাত রেখেছে। প্রভাবিত করেছে মানবতাকে। আলোকিত করেছে মানবহৃদয়কে। গোটা সমাজকে নিজের মতো নতুনরূপে সাজিয়েছে। প্রাচীন ও প্রচলিত রীতিনীতিতে কোনো কল্যাণকর কিছু পেলে প্রথমে তা ইসলামীকরণ করেছে এরপর তার অনুমোদন দিয়েছে। এ হলো ইসলামের সোনালি ইতিহাস। পূর্বেই বলেছি ইসলামের বিজয় নিছক ভূখ-ের বিজয় ছিলো না; বরং তা ছিলো একটি দ্বীন ও সভ্যতার বিজয়। ইতিহাসে এমন ঘটনাও কম নয় যে, একজাতি অন্য জাতির উপর আক্রমণ করেছে। নির্মম পাশবিকতা চালিয়েছে। জয় করেছে ভূখ-কে; তবে সেই ভূখ-ের সভ্যতার সামনে পরাজিত হয়েছে। উভয় সভ্যতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে এক মিশ্র সভ্যতা। রোমীয়রা গ্রিস আক্রমণ করে জয়লাভ করে। সেখানে নির্মম পাশবিকতা এবং পৈশাচিক শোষণ কায়েম করে। কিন্তু রোম গ্রিকদেরকে নিজেদের সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত করতে পারেনি; বরং তারা নিজেরাই প্রভাবিত হয়েছে। গ্রিস ভূখ- জয় করে গ্রিক সভ্যতার কাছে পরাজিত হয়েছে।
বিশিষ্ট ধর্মতত্ত্ববিদ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ দারায রহ. (১৩৭৭হি.) বলেন, গ্রিক ও রোম একে অপরকে আক্রমণ করেছে। সময় পরিক্রমায় উভয়ই জয় লাভও করেছে কিন্তু কেউ কাউকে পূর্ণরূপে প্রভাবিত করতে পারেনি। গ্রিক কিছুটা প্রভাবক থাকলে রোম ছিলো সর্বাবস্থায় প্রভাবিত জাতি। তিনি এ প্রসঙ্গে সুন্দরই বলেছেন-
“খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে রোমীয়রা গ্রিকদের রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করে।…
কিন্তু অতীব আশ্চর্যের বিষয় হলো, দুটি জাতির এ দীর্ঘকালের সংমিশ্রণ ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি বা আইন-এককথায় সামাজিক কোনোক্ষেত্রে তাদেরকে এক জাতিতে পরিণত করতে পারেনি, যেমনটি ইসলামের বিজিত অঞ্চলসমূহে ঘটেছিলো!!
এক জাতি তো পরের বিষয়, কমপক্ষে রোমীয়রা গ্রিক রাজধানীতে জ্ঞান ও সাহিত্যের যে সম্ভার ছিলো, তা থেকে উপকৃত হতে পারতো না?!
কিন্তু এসব কিছুই হয়নি। রোমীয়রা এথেন্স থেকে সামান্য কিছু পাবলিক ধ্যান-ধারণা ছাড়া আর কিছু গ্রহণ করেনি, যেমন সাধারণত প্রতিবেশীরা একে অপরের কিছু রীতি-রেওয়াজ অনুসরণ করে” (আদ-দ্বীন ১৫-১৬)।
ইসলামের ইতিহাস মেলে ধরুন। ইসলামের প্রচার আর প্রসারের ঘটনাগুলো লক্ষ করুন। সেখানে পাবেন এর উল্টোটা। ইসলাম সর্বদা প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট করার লক্ষ্যে প্রাচীন কয়েকটি সভ্যতার কথা তুলে ধরছি এবং ইসলাম সেখানে কী ধরনের পরিবর্তন এনেছে সংক্ষেপে তার প্রতি ইঙ্গিত করছি।
প্রাচীন একটি সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে। প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘মেসোপটেমিয়া’ অর্থ দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূমি। এই উর্বর অঞ্চলটি ফোরাত এবং দজলা নদীর মধ্যবর্তী ভূমি, যা বর্তমানে ইরাক, সিরিয়া, কুয়েত এবং তুরস্ক-সিরিয়া ও ইরাক-ইরানের সীমান্ত অঞ্চল নিয়ে গঠিত। (বিশ্বের ইতিহাস ও সভ্যতা খ. ১ পৃ. ৪৬৮, প্রাচীন সভ্যতা সিরিজ: মেসোপটেমিয়া) মেসোপটেমিয়াকে ঘিরে আরও অনেক সভ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। উপর্যুক্ত ভূখ-গুলোতে প্রাচীনকালেও চর্চা হয়েছে অনেক জ্ঞান বিজ্ঞান। তারা আপন আপন সময়ে বেশ উন্নতই ছিলো। কিন্তু তাদের সেই উন্নত সভ্যতা ইসলামের জন্য প্রতিবন্ধক হতে পারেনি। কারণ ইসলাম উপস্থিত হয়েছিলো উন্নততর ও চির প্রাণবন্ত এক দ্বীন ও সভ্যতা নিয়ে। তাই প্রাচীন সভ্যতাগুলো ইসলামের কাছে পরাজিত হয়। ইসলাম সমুদয় সভ্যতাকে জয় করে নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে সিঞ্চন করেছে নতুন প্রাণ ও নব জীবন। অন্ধকার সমাজ বিবর্তন করে আলোকিত পরিবেশ তৈরি করেছে। তাই ইসলামের এ বিজয় নিছক সভ্যতার মুকাবেলায় আর একটি সভ্যতার বিজয় নয়; বরং সভ্যতার মুকাবেলায় উন্নত ও ক্রম উন্নয়নশীল দ্বীন ও সভ্যতার বিজয় ছিলো।
আরও একটি প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো মিসরকে ঘিরে। মিসরের সভ্যতা ছিলো সর্বদিক থেকেই সমৃদ্ধ এবং বৈশিষ্ট্যম-িত। ফেরাউন আর কিবতীরা এখানেই তাদের সভ্যতা গড়ে তুলেছিলো। তারা ছিলো জ্ঞান-বিজ্ঞানে টইটুম্বুর। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাতেই তাদের সগৌরব পদচারণা রয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাদের অবদান আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। তাদের আবিষ্কৃত ও সৃষ্ট অনেককিছুর জট এখনো অজানা রয়ে গেছে। তাদের প্রচলিত সভ্যতা ইসলামের জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ইসলাম মিসরে প্রবেশ করেছে। বিজয় করেছে ভূখ-; জয় করেছে প্রাচীন সভ্যতাকে। প্রবর্তিত হয়েছে নতুন সমাজ ব্যবস্থা। নতুন জীবন। নতুন পরিবেশ। ইসলামের আকীদা বিশ্বাস ও সভ্যতা ক্রমান্বয়ে বিস্তার লাভ করা আরম্ভ হয়েছে। একপর্যায়ে সব কিছু ছাপিয়ে ইসলামেরই জয় হয়েছে। ইসলাম মিসরকে আরও উন্নত করেছে। সমৃদ্ধি আরও ত্বরান্বিত করেছে।
প্রাচীন সভ্যতার কাতারে আরও একটি বৈশিষ্ট্যম-িত সভ্যতা হলো, পারস্য সভ্যতা। বর্তমানের ইরান ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ঘিরে এই সভ্যতাটি গড়ে ওঠে। গ্রিস থেকে ভারত পর্যন্ত নানা অঞ্চলে এই সভ্যতার প্রভাব ছিলো। পারস্য সভ্যতায় নানাবিধ জ্ঞান ও বিজ্ঞানের চর্চা হয়েছে। তাদের ছিলো নিজস্ব ধর্ম। জরাথ্রুস্ট ছিলেন তাদের রাহবার। সর্বদিক থেকেই তারা সমৃদ্ধশালী একটি জাতি ছিলো তারা। নিজেদের বংশ আর রাজত্ব নিয়ে গৌরব ও আত্মগরিমার শেষ ছিলো না। সেখানেও ইসলাম উপস্থিত হয়েছে এক শক্তিশালী দ্বীন ও সভ্যতা নিয়ে। ইসলাম পারস্য ভূখ-কে জয় করে। পারস্য সভ্যতাকেও প্রভাবিত করে। পরিবর্তন হতে থাকে পুরনো সব ধ্যান-ধারণা, প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা, প্রচলিত রীতিনীতি। এভাবেই জয় হয় ইসলাম ও ইসলামী সভ্যতার।
প্রাচীন ভারতের সিন্ধু সভ্যতা ও আর্য সভ্যতাও উল্লেখযোগ্য সভ্যতা। উভয় সভ্যতার রয়েছে নিজস্ব পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য, নিজস্ব বাদ-মতবাদ। বিশেষ করে আর্য সভ্যতা যা বৈদিক সভ্যতা নামেও পরিচিত, তাদের তো সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম ও রসম-রেওয়াজ রয়েছে এবং শতবর্ষ ধরে তারা প্রতিষ্ঠিত। তাদের রয়েছে নিজস্ব বিজ্ঞান ও সমাজ ব্যবস্থা। বৈদিক সভ্যতা সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন নেই।
ইসলাম সিন্ধে প্রবেশ করে উমাইয়া যুগে। সেখানে গড়ে ওঠে সুবিশাল ইসলামী রিয়াসত। ইসলাম ও ইসলামী সভ্যতাই প্রভাবক হিসেবে অন্যদেরকে গাইড করতে থাকে। তৎকালীন হিন্দুরাও স্বস্তিবোধ করতো ইসলামী রিয়াসতের ছায়াতলে। ইসলাম সিন্ধুকে নতুনরূপে সাজিয়েছে। ইলম ও জ্ঞান চর্চায় উন্নীত করেছে। সিন্ধে ইসলাম কীরূপ উন্নতি সাধন করেছে তার বিবরণ দিতে এক বৃহৎ পুস্তিকার প্রয়োজন।
ইসলাম সিন্ধু থেকে অন্যান্য অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছে। গোটা হিন্দুস্তানকেই প্রভাবিত করেছে ইসলাম ও ইসলামী সভ্যতা। মুসলিমরা হিন্দুস্তান শাসন করেছেন। জ্ঞান বিজ্ঞান অর্থনীতি ও সমাজনীতি সর্ব ক্ষেত্রেই উন্নতি করেছে। মুসলিম কর্তৃক হিন্দুস্তানকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করার স্বীকৃতি খোদ হিন্দুরাই দিয়েছে। ইতিহাসে তা আজও সংরক্ষিত রয়েছে।
হিন্দুস্তানের একটি সমৃদ্ধ ভূখ- হলো বর্তমানের বাংলাদেশ। এ ভূখন্ড শাসিত হয়েছে বিভিন্ন জাতি দ্বারা। কখনো পাল বংশ আবার কখনো সেন বংশ দ্বারা শাসিত হয়েছে। কিন্তু ইসলাম যেভাবে এ ভূখ-কে এক আদর্শ ও উন্নত অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলেছে, তা অন্য কেউ করতে সক্ষম হয়নি। বাংলাদেশে ইসলাম ছিলো এক বিস্ফোরণের ন্যায়। এতো ছোট ভূখ- এতো পরিমাণ মানুষের ইসলাম গ্রহণ করার ইতিহাস বিরল। অনেক আরব ভূখ-েও এতো পরিমাণ মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হয়নি। আদমশুমারি প্রচলনের পূর্বে বিষয়টি এতটা ফুটে উঠেনি। কিন্তু ১৯শতকে আদমশুমারি আরম্ভ হলে এই অবাক করা বাস্তবতা সামনে আসে। ইতিহাসবিদগণ উৎসুক হয়ে ওঠেন এর কারণ আবিষ্কারের জন্য।
বাংলার যমীনে বিভিন্ন সময় ধর্মভিত্তিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো। তা আপন অঞ্চলে প্রচলিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিতও ছিলো। তা সত্ত্বেও কেনো এতো মানুষ ইসলামের ছায়াতলে- এ প্রশ্ন ব্যস্ত রেখেছে অনেক গবেষককে। আজ অনেকে এর সঠিক কারণ খুঁজে ফিরছেন। প্রকৃত অর্থে এর কারণ একটিই। ইসলাম আগমন করেছিলো এক জীবন্ত ও উন্নত দ্বীন ও জীবনব্যবস্থা নিয়ে। মানুষ ইসলামের মাঝে নিজেদের উন্নতি ও সমৃদ্ধি দেখতে পেয়েছে। প্রচলিত সভ্যতার চেয়ে ইসলামী সভ্যতাকে অনুপম ও শ্রেষ্ঠ হিসেবে পেয়েই তারা নিজেদের প্রাচীন সভ্যতা পরিত্যাগ করে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে।
প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসে চীন, গ্রিস, রোম এবং প্রাচীন ইউরোপের সভ্যতাও বড় স্থান দখল করে নিয়ে আছে। এ অঞ্চলগুলোতেও গড়ে উঠেছিলো বেশ প্রভাবশালী সভ্যতা। ইসলাম প্রতিটি সভ্যতার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। প্রভাবিত করেছে অজস্র সমাজ ও সমাজপতিকে।
এভাবেই ইসলাম প্রাচীন সভ্যতাগুলো প্রভাবিত করেছে। পাল্টে দিয়েছে প্রাচীন সমাজ ও সমাজ ব্যবস্থাকে। কোথাও ইসলাম ও ইসলামী সভ্যতা ম্লান হয়ে পড়েনি, নিষ্ক্রিয় বা নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েনি। প্রচলিত হাজারো আইন, সমাজব্যবস্থা ও রীতিনীতি ইসলামকে ব্যাহত করতে পারেনি; রোধ করতে পারেনি ইসলামের অগ্রযাত্রাকে। ইসলাম প্রতাপ ও প্রভাবে জয় করে অর্ধ পৃথিবীকে। আর প্রভাবিত করে গোটা মানবজাতিকে। ইসলামের বিস্তৃতি এতটাই ছিলো যে, একদিন খলীফা হারুনুর রশীদ মেঘকে সম্বোধন করে বলেছিলেন-
‘হে মেঘ! তুমি যেখানে ইচ্ছে বর্ষণ করো; তবে তোমার খারাজের মালিক তো আমিই।’
ইসলামের এ জয়ের ইতিহাস পৃথিবীর সমৃদ্ধির ইতিহাস। ইসলামের ছায়াতলে পৃথিবী উন্নত হয়েছে; লাভবান হয়েছে আপামর জনগণ। ইসলামের এ জয় ও উন্নতির স্বীকৃতি অমুসলিমরাই দিয়েছে। কট্টরপন্থি প্রাচ্যবিদ উইলিয়াম ড্যুরান্ট (William James Durant) এ সত্য স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন (আরবী অনুবাদ)-
“এই রক্ষণশীলতা সত্ত্বেও স্বীকার না করে উপায় নেই যে, আবু বকর থেকে নিয়ে আল-মামুন পর্যন্ত ইসলামের প্রথম দিকের খলিফাগণ বিশে^র বিস্তৃত ভূখ-জুড়ে মানবপ্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কল্যাণমূলক এক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। তারা ছিলেন মানব-ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিমান শাসকদের অন্যতম। তারা মোগল, হাঙ্গেরিয় বা ইউরোপের বামপন্থিদের মতো একনায়কে পরিণত হতে পারতেন, পারতেন সব ধ্বংস করে দিতে, কিন্তু তারা তা করেননি। তারা কেবল কর আরোপ করেছিলেন। আমর ইবনুল আস মিসর জয় করার পর যুবাইর বিজয়ী আরবদের মধ্যে ভূমি বণ্টন করে দেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু আমর তার পরামর্শ শোনেননি। খলিফাও তার সিদ্ধান্ত সমর্থন করে জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন, যাতে তারা সেসবের দেখাশোনা করে চাষাবাদ করে। খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে ভূমির সীমানা মুছে দেওয়া হয়, সরকার রেজিস্ট্রিতে হিসাব সংরক্ষণ করে রাখে। বিপুল সংখ্যক রাস্তা তৈরি করা হয় এবং সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ভাঙন ঠেকানোর জন্য নদ-নদীর আশেপাশে বাঁধ তৈরি করা হয়। ইরাক ছিলো শুস্ক মরুভূমি, ইসলামের বিজয়ের পর তা হয়ে ওঠে প্রশস্ত উদ্যান। ফিলিস্তিনের অধিকাংশ অঞ্চল ছিলো বালু ও পাথরময়, বিজয়ের পর তা সবুজ-শ্যামল ও বসতিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
সন্দেহ নেই যে, ইসলামী সরকারের আমলেও অন্য সব সরকারের মতোই দুর্বল ও সাধারণের ওপর বিশিষ্ট ও শক্তিশালীদের শোষণ অব্যাহত ছিলো। কিন্তু খলিফাগণ বৃহত্তর পরিসরে মানুষের জীবন ও কষ্টার্জিত সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করেছিলেন। তারা সুযোগ করে দিয়েছিলেন দাতাদের সম্পদে। দীর্ঘ ছয় শতাব্দী ধরে তারা সমৃদ্ধি ছড়িয়েছেন এমন বিশাল অঞ্চলজুড়ে যার নযীর তার পরে আর দেখা যায়নি। তাদের উৎসাহ ও সাহায্যে শিক্ষার প্রসার ঘটে আর বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন ও শিল্প-শাস্ত্রের এত উন্নতি হয় যে, পাঁচ শতাব্দী জুড়ে মরু অঞ্চল সভ্যতায় সবচেয়ে এগিয়ে ছিলো।”
আরও অনেক উদ্ধৃতিই দেওয়া যেতো। প্রাচ্যবিদরা ইসলামের দুশমন হলেও মাঝে কিছু সত্য না বলে থাকতে পারেনি। তাদের সত্য কথন যা ইসলামের প্রাণবন্ততার সাক্ষ্য হয়ে আছে সব একত্র করলে একটি কিতাবে রূপ নিবে।
ইসলামের এই দীর্ঘ পরিক্রমায় কখনো কি ইসলাম দুর্বল ছিলো? এমন কোনো সভ্যতা কি সামনে এসেছে যার চেয়ে সুন্দর কিছু ইসলাম দিতে পারেনি। ইসলামের নীতি কোথাও থেমে গেছে? নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে কোথাও? এমন কোনো সমাজব্যবস্থা ছিলো, যার চেয়ে সুন্দর ব্যবস্থা ইসলাম দিতে পারেনি? এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হাজার প্রশ্ন করলেও ইসলামে কোনো দুর্বলতা আবিষ্কার করা যাবে না। এটি তো আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু যখন খোদ শত্রুরাও এর স্বীকৃতি দেয় তখন তো আর অবিশ্বাস করার কোনো পথ থাকে না।
তাই ইসলাম হাজার বছর ধরে প্রাণবন্ত। ইসলামের বিধান যেমন সেদিন সজীব ছিলো তা আজও সজীব। যদি বর্তমানের চেয়ে হাজারগুণ গতিশীল কোনো সভ্যতার জন্ম হয়, ইসলাম তাকেও সুন্দররূপে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।। যুগ যত উন্নত হোক, যামানা যত অগ্রসর হোক- ইসলাম প্রাণবন্তই থাকবে। ইসলামী আইন, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা কার্যকরই থাকবে। খরনুধহ অৎধন জবঢ়ঁনষরপ এর আইন প্রণয়ন বিষয়ক এক সিদ্ধান্তের টীকায় উল্লেখ হয়েছে-
“ইসলামী ফিকহ তার যাবতীয় বিধানসহ দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী জীবন্ত ছিলো। এটা এমন বিষয় যা বিশ্বের অন্য কোনো সংবিধান লাভ করা তো দূরে থাক, কাছাকাছিও যেতে পারেনি। জানা কথা যে, ইউরোপ-আমেরিকার পশ্চিমা আইনশাস্ত্রের জন্ম হয়েছে এক শতাব্দী বা তারচেয়েও কম হয়েছে। অর্থাৎ যখন থেকে তারা বৈষয়িক বিষয়াদি থেকে দ্বীনকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলেছে। আর রাশিয়ান আইনশাস্ত্রের জন্ম তো এই গত শতাব্দীর শেষার্ধে। কারণ রাশিয়ায় কমিউনিজম চর্চা শুরু হয়েছে ১৯১৭ সালের পরে।
পক্ষান্তরে ইসলামী আইনশাস্ত্রের বয়স ১৪শ’ বছর। এটা পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ সমগ্র বিশ্বে বিচরণ করেছে; উঁচু-নিচু, পাহাড় ও মরুভূমি সবখানে অবতরণ করেছে; বিভিন্ন আচার-প্রথা ও ঐতিহ্যের মুখোমুখি হয়েছে এবং সকল পরিবেশে সমুন্নত থেকেছে। প্রাচুর্য ও দারিদ্র্য, নেতৃত্ব ও দাসত্ব এবং সভ্যতা ও পশ্চাদপদতা সব যুগই পেয়েছে এবং এই সকল ধাপে নিত্যনতুন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। ফলে এর বিশাল ফিকহী ভা-ার জমা হয়েছে, যার কোনো নযীর নেই। এতে প্রত্যেক রাষ্ট্র তার সমস্যার সবচেয়ে সহজ সমাধান পেতে পারে।
ইসলামী আইনশাস্ত্র সর্বোন্নত যুগে শাসন করেছে, কিন্তু প্রয়োজনের ক্ষেত্রে অক্ষম হয়নি এবং কোনো উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়নি এবং কখনও তার অনুসারীদের নিয়ে পিছনে পড়ে যায়নি।”
প্রিয় পাঠক! দীর্ঘ এ ইতিহাস এক পাশে রেখে তার সাথে বর্তমানের শ্লোগানগুলো মেলাতে থাকুন। মেলাতে থাকুন ইসলামের নামে প্রচারিত গুজবকে। খুব সুপরিকল্পিতভাবে প্রচার করা হচ্ছে যে, ইসলাম বর্তমানের জন্য অকেজো। এক সময় ইসলাম প্রাণবন্ত থাকলেও আজ তা ম্লান হয়ে গেছে। আধুনিক যুগে ইসলাম ও ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রয়োগযোগ্য নয়। আরও কতো কিছু! আমাদের খুঁজতে হবে কেনো এই গুজব? কারাইবা তা প্রচার করছে? কী আছে এর নেপথ্যে?
আমাদের অসচেতনতা ও ইসলাম নিয়ে গুজব
উসমানী খেলাফতের শেষকাল। ইসলাম তখনো প্রাণবন্ত। তবে মুসলিমরা ঝিমিয়ে পড়লো। যুগের পরিবর্তনের সাথে ইসলামের জীবন্ত উপস্থাপনার দায়িত্ববোধ শিথিল হলো। নবউদ্ভাবিত বাদ মতবাদ আর আইন ও সমাজব্যবস্থার উত্তম বিকল্প ইসলামে কী আছে তা যথাযথরূপে চিহ্নিতকরণ এবং তুলনামূূলক বিশ্লেষণ ও সঠিক উপস্থাপনের অভাব দেখা দিলো। আমাদের এ অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে মাথা উঁচু করে নতুন রূপে দাঁড়াতে থাকলো এক নতুন সভ্যতা; যা আজ আমরা পশ্চিমা সভ্যতা নামে চিনি। জীবন, সমাজ, অর্থনীতি, আইন এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তারা নতুন আকারে সাজাতে থাকে। তৈরি করে অজ¯্র বাদ মতবাদ। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ভারে তাদের পাল্লাই ভারি হয়ে ওঠে। আমাদের অসচেতনতা আর তাদের যুগের সঠিক বোধই তাদের এগিয়ে নিয়ে যায়। তাদের প্রভুত্বের আসনে সমাসীন করে। প্রতিষ্ঠিত হয় তাদের ক্ষমতা। তারা পরাশক্তি হয়ে ওঠে। নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতাপকে স্থায়ী করার লক্ষ্যে ইসলামকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা চালাতে থাকে। আরম্ভ হয় ইসলামের নামে নানা অপপ্রচার ও গুজব। ইসলামের তত্ত্ব বিকৃিত, মুসলিমদের মাঝে ইসলামের প্রতি অনাগ্রহ, ইসলামের বিধানের প্রতি সংশয়, ইসলামকে বর্তমানে অকার্যকর প্রমাণসহ নানাবিধ ষড়যন্ত্র করা হয়। এ কাজে তারা হাজার হাজার বিশেষজ্ঞকে নিয়োজিত রাখে। যাদেরকে আমরা প্রাচ্যবিদ নামে চিনি। তারা আজও কাজে নিয়োজিত রয়েছে। অজ¯্র গবেষণা ও পুস্তিকা তারা রচনা করে যাচ্ছে। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ইসলামকে ঘায়েল করা। মুসলিমদেরকে ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলা।
তারা নিজেদের চিন্তা চেতনা প্রচার করার লক্ষ্যে শিক্ষাকে প্রধান বাহন বানায়। মুসলিমদেশগুলোতে পশ্চিমা কারিকুলামে হাজারো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। মেধাবী মুসলিমদেরকে বিনা খরচে নিজ দেশে নিয়ে ব্রেইন ওয়াশের কাজ করে নিজেদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করায়। মুসলিমদেরকে দিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে বই পুস্তক ও গবেষণাপত্র লেখায়। এভাবেই ফাঁদে ফেলে মুসলিম জাতিকে।
তারা বিভিন্নভাবে সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিমদের বোঝাতে সক্ষম হয় যে, বর্তমান আধুনিক যুগে চলতে হলে আধুনিক পশ্চিমা আইন, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্্রব্যবস্থা নিজেদের গ্রহণ করতে হবে। পশ্চিমা সভ্যতা ছাড়া আজ উন্নতির কোনো পথ খোলা নেই। ইসলাম এক সময় অনেক কার্যকর থাকলেও এখন তা নিষ্ক্রিয়, অকার্যকর। ব্যক্তি জীবনে ইসলাম ফিট হলেও সমাজে, রাষ্ট্রে ইসলাম আনফিট… ইত্যাদি।
এ কথাগুলো আর পশ্চিমাদের নতুন করে বলতে হয় না। মুসলিমদেশেই তাদের লোক তৈরি হয়ে গেছে। এই নামধারী মুসলিমরাই তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। আজকে এই কথাগুলো আমাদের দেশের মুসলিম শাসক ও সমাজপতিদের মুখ থেকেই বের হচ্ছে। তারা পশ্চিমাদের প্রতি আগ্রহী হলেও ইসলামের আইন ও আদর্শে তাদের আপত্তি। তাদের প্রশ্ন আর সংশয়ের স্রোতেই যেনো তারা ইসলামকে নির্বাসন দিতে চায়।
আজ মুসলিম নামধারী বুদ্ধিজীবীরা টকশোতে বসে ইসলামের বিরুদ্ধে নির্দ্বিধায় কথা বলে যাচ্ছে। প্রমাণ করছে যে, পশ্চিমারা যা বলছে সেটাই ঠিক আর ইসলাম বেঠিক। ইসলাম শুধু ব্যক্তি জীবনের জন্য সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য নয়। ব্যক্তি জীবনে ইসলাম মানতে কোনো অসুবিধা নেই তবে সমাজে তা আনবেন না। মানবরচিত আইনকেই তারা নিজেদের উন্নতির চাবিকাঠি মনে করছে। তার পক্ষেই শ্লোগান দিচ্ছে। আরও কতো কিছু। এসব করছে পূর্ণ আত্মবিশ্বাস থেকে। এই হলো আমাদের সমাজ আর দেশের অবস্থা।
তাদের এই ভ্রষ্ট ধারণার মূল কারণ হলো ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা। পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি দুর্বলতা বরং আসক্তি। তারা ইসলামকে না বুঝেই এসব গুজব ছড়াচ্ছে। বিশিষ্ট আইনবিদ আব্দুল কাদির আওদাহ রহ. বলেন-
“শরীয়া অধ্যয়নের মাধ্যমে আমার সামনে স্পষ্ট হয়েছে, অনুরূপ পাঠকের সামনেও স্পষ্ট হবে যে, যারা একথা বলেন, শরীয়া আধুনিক যুগের উপযোগী নয়, তাদের এই মতের ভিত্তি কোনো ইলমী গবেষণা বা যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ নয়। কারণ ইলমী গবেষণা এবং যুক্তি একথা দাবি করে যে, ইসলামী শরীয়া মানবরচিত আইনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং এই যুগ ও পরবর্তী সকল যুগের জন্য উপযুক্ত।
তাছাড়া, যারা বলে যে, বর্তমান যুগে শরীয়া চলনসই নয়, তাদের দুই দল। এক দল তো শরীয়াও পড়েনি, আইনশাস্ত্রও পড়েনি। আরেক দল আইনশাস্ত্র পড়লেও শরীয়া পড়েনি। ফলে কোনো দলই শরীয়ার ব্যাপারে রায় দেওয়ার যোগ্য নয়। কেননা তারা শরীয়া-বিধি সম্পর্কে পূর্ণ অজ্ঞ। আর কোনো বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তি সে বিষয়ে মতামত দেয়ার যোগ্যতা রাখে না।”
নতুন এ যুগের নতুন এ ফেতনা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে আরও মযবুত হয়ে আরও শক্তি অর্জন করে। কথায় কথায় ইসলামকে, ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে। তারা ইসলামকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রতিবন্ধক ভাবছে। আধুনিক বিকৃত ইসলামকেই তারা প্রকৃত ইসলাম ধরে বসে আছে আর যারা ইসলামের প্রকৃত ধারক বাহক তাদের ধর্মান্ধ বলে নির্বাসন দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতির কিঞ্চিত ও খন্ডিত চিত্র আমরা দেখলাম। এটাও দেখলাম যে, আমরা এখনো অসচেতন। আমরা আন্দোলন করছি । প্রতিবাদ করছি। তবে সবই শাখা প্রশাখায়। যখন তাদের পশ্চিমা মগজ থেকে কোনো মুনকার প্রকাশিত হয় তখন সেই মুনকারের প্রতিবাদ করি। কিন্তু মগজ পরিষ্কার ও সংশোধনের প্রকৃত ও যথাযথ চেষ্টা আমরা করি না। তাই আন্দোলন এক সময় থেমে যায় কিন্তু সেই পশ্চিমা মগজ সক্রিয়ই থেকে যায়। পথ খোঁজে বিকল্প ধারায় নিজেকে প্রকাশ ও বিকাশ ঘটানোর।
আমাদেরকে আরও সচেতন হতে হবে। সজাগ ও দূরদর্শী দৃষ্টি রাখতে হবে। যুগ ও যামানার মূল সমস্যা অনুধাবন করে তা সংশোধন করার যথাযথ পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। আমাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে, ইসলাম আজও প্রাণবন্ত ও জীবন্ত একটি দ্বীন। বর্তমানের উন্নতি ও সমৃদ্ধি এবং সামাজিক সুখ-শান্তি বাস্তবায়নে ইসলামই একমাত্র উপায়। ইসলাম বর্তমানে প্রয়োগযোগ্য একটি দ্বীন এতটুকু বললেই হবে না। বরং প্রমাণ করতে হবে যে, ইসলামই শুধু ইসলামই একমাত্র দ্বীন যা বর্তমানকে যে কোনো সংকট থেকে মুক্ত করতে পারে।
ইসলামের এই যথাযোগ্যতা প্রমাণ না করে যদি শুধু আন্দোলন করে যাই, হয়ত সাময়িকভাবে রাজপথ উত্তাল থাকবে, তবে প্রকৃত সমাধান আমরা পাবো না। বর্তমানের শিক্ষিত সমাজ আমাদের কথা শুনবে না। হয়তো আমাদের পক্ষে কথা বলবে; আমাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবে; ইসলামকে বর্তমানের দ্বীন ও জীবনব্যবস্থারূপে বিশ্বাস করে নয় বরং একধরনের করুণা থেকে, যা আজ আমরা লক্ষ করছি। আলিমদের পক্ষে কথা বলছে ঠিক; কিন্তু তিনিও মনে করেন যে, ইসলাম বর্তমানে নিছক ব্যক্তিগত ধর্ম। সমাজ ও রাষ্ট্রে এর কোনো দখল নেই। তাই আমাদেরকে মূল গোড়ায় হাত দিতে হবে। চিকিৎসা শিকড় থেকে করতে হবে। কারও করুণার প্রাত্র হয়ে নয়; বরং আপন শক্তিতে দাড়াতে হবে। প্রমাণ করতে হবে ইসলাম বর্তমানের একমাত্র ধর্ম।
বিশিষ্ট আলিম ও ইতিহাসবিদ আল্লামা আবুল হাসান নাদাবী রহ. সুন্দরই বলেছেন-
‘সময় বড় নির্দয়। যামানা বড় বে-রহম। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব যত বিশাল হোক, প্রতিভার প্রভা যত সমুজ্জ্বল হোক এবং জামাত ও সম্প্রদায় যত ঐতিহ্যবাহী হোক সময় কারো সামনেই মাথা নোয়াতে রাজি নয়। যুগের স্বভাবধর্ম এই যে, যোগ্যতার দাবিতে স্বীকৃতি আদায় না করলে আগে বেড়ে সে কাউকে স্বীকার করে না। কোনো কিছুর ধারাবাহিকতা বা প্রাচীনতা সময়ের শ্রদ্ধা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। সময় এমনি বাস্তববাদী, এমনই শীতল ও নিরপেক্ষ যে, তার হাতে নতুন কিছু তুলে না দিলে এবং তার ঘাড়ে ভারী কোনো বোঝা চাপিয়ে না দিলে সে মাথা নোয়াতে চায় না।’
‘শোনো ভাই! মুসলিম সমাজের চিন্তা-জগতে আজ এক ব্যাপক নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য ছড়িয়ে পড়ছে। এই উম্মাহ এবং এই দীনের মাঝে যে চিরন্তন যোগ্যতা গচ্ছিত রাখা হয়েছে সেই যোগ্যতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে যুবসমাজ এবং আধুনিক শিক্ষিত মহলে ভয়ানক অনাস্থা-অনিশ্চয়তা দানা বেঁধে উঠছে; সর্বোপরি দীনের ধারক-বাহক আলিমদের নতুন প্রজন্মে মারাত্মক হতাশা ও হীনমন্যতা শিকড় গেড়ে বসছে। এগুলো দূর করে যুগ ও সমাজের লাগাম টেনে ধরার জন্য এবং দ্বীন ও শরীয়াতকে নয়া যামানার নয়া তুফান থেকে রক্ষা করার জন্য এখন অনেক বেশি প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজন। অনেক বড় ইলমী জিহাদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিজয় অর্জনের প্রয়োজন। এখন প্রয়োজন আরো বেশি আত্মনিবেদনের, আত্মবিসর্জনের এবং আরও ঊর্ধ্বাকাশে উড্ডয়নের।’ (জীবন পথের পাথেয়)
যে কোনো কাজের পূর্বে প্রয়োজন সঠিক নির্ণয় ও যথাযথ প্রস্তুতি। কাজ যত নাযুক হবে তার প্রস্তুতিও তত সতর্কতাপূর্ণ হবে। এটাই স্বাভাবিক। চলমান সংকট ও ক্রান্তির প্রকৃতি ও হাকীকত সঠিকরূপে আবিষ্কার করতে হবে। যথাযথ পথ ও পদ্ধতি নির্ণয় করতে হবে। কাজ করতে হবে পূর্ণ প্রেরণা ও ঈমানের সাথে। তবেই সফলতা বয়ে আনা সম্ভব। (চলবে)
- মুফতী আবদুল্লাহ নাজীব, যিম্মাদার- দাওয়াহ ও ইরশাদ বিভাগ, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম এবং বিভাগী সম্পাদক- মাসিক মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ