মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ: ইসলামের ইতিহাসে খুবাইব বিন আদি (রা.)-এর আত্মেৎসর্গের ইতিহাস অবিস্মরণীয়। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশনায় ইসলামের শিক্ষা প্রসারে জীবন বিলিয়ে তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বিশ্বাঘাতকদের হাতে বন্দী হয়ে মৃত্যুর আগে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। নিম্নে তাঁর পুরো ঘটনা উল্লেখ করা হলো।
মহানবীর কাছে শিক্ষকের আবেদন : চতুর্থ হিজরিতে মহানবী (সা.)-এর কাছে আদল ও কাররাহ গোত্রের কিছু লোক এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের মধ্যে অনেক মুসলিম আছেন। আপনি আমাদের কাছে সাহাবিদের একটি দল পাঠান যারা আমাদের কোরআন ও ইসলামী শরিয়ত সম্পর্কে শেখাবে।
আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘মহানবী (সা.) তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ১০ জন সাহাবিকে পাঠান। তাদের মধ্যে ছিলেন, খুবাইব বিন আদি, মুরসিদ বিন আবু মুরসিদ, খালিদ বিন আবু বুকাইর, জায়েদ বিন দাসিনাহ (রা.) ও আবদুল্লাহ বিন তারিক (রা.)। তাদের মধ্যে নেতা ছিলেন আসিম বিন সাবিত আল আনসারি (রা.)।
সাহাবিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা : সাহাবিদের ক্ষুদ্র দলটি মক্কা ও উসফানের মধ্যবর্তী রাজি নামক স্থানে পৌঁছলে লিহয়ান গোত্র তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। তারা সাহাবিদের পদরেখা অনুসরণ করে কাছে চলে আসে। এদিকে মদিনা থেকে নিয়ে আসা খেজুর ও খাবার রসদের সন্ধান পেয়ে লিহয়ান গোত্রের লোকেরা বুঝতে পারে যে দলটি মদিনা থেকে এসেছে। এদিকে দলনেতা আসিম বিন সাবিত (রা.) কাফিরদের উপস্থিতি টের পেয়ে একটি টিলায় আশ্রয় নেন। এদিকে গোত্রের লোকেরা তাদের ঘেরাও করে বলে, তোমরা নেমে আসো। তোমরা নিরাপদ থাকবে। আমরা তোমাদের কাউকে হত্যা করব না। আসিম বিন সাবিত বলেন, ‘একজন কাফিরের দায়িত্বে আমি অবতরণ করব না। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের পক্ষ থেকে মহানবী (সা.)-কে খবর দিন।’
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
খুবাইবকে যেভাবে বিক্রয় করা হয় : অতঃপর তীরন্দাজ দলটি তীর নিক্ষেপ করে আসিম (রা.)-সহ সাতজনকে হত্যা করে। এরপর খুবাইব (রা.)-সহ তিনজন সাহাবি তাদের কথা মতো নেমে আসে। তখন তাদের বন্দী করা হয়। সাহাবিদের একজন বলল, এটা প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা। আল্লাহর শপথ, আমি তোমাদের সঙ্গে যাব না। আমিও সঙ্গীদের মতো লড়াই করব। কাফিররা তাকেও হত্যা করে এবং খুবাইব ও ইবনে দাসিনাহকে নিয়ে যায়। মক্কায় গিয়ে উভয়কে বিক্রয় করে দেয়। খুবাইব (রা.)-কে বনু হারেস বিন আমের ক্রয় করে। কারণ খুবাইব (রা.) বদরের যুদ্ধে হারেস বিন আমেরকে হত্যা করেছিল।
হারিসের মেয়ে বর্ণনা করেন, খুবাইব বন্দী অবস্থায় কয়েক দিন আমাদের কাছে ছিল। মৃত্যুর আগে একদিন সে আমার কাছে ক্ষৌরকর্ম করে পবিত্রতা অর্জনে একটি ক্ষুর ধার নেয়। সেই সময় আমার অজান্তে আমার ছেলে গিয়ে তার উরুতে বসে। এদিকে খুবাইবের হাতে ক্ষুর দেখে আমার ভয় হয়। আমাকে ভীত দেখে খুবাইব বলল, আপনি ভয় করছেন যে আমি তাকে হত্যা করব। আমি এমনটি করব না।
উত্তম বন্দীর নমুনা ছিলেন যিনি : হারিসে মেয়ে বলেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমি খুবাইবের চেয়ে উত্তম কোনো বন্দী দেখিনি। আল্লাহর শপথ, একদিন আমি তাকে আঙ্গুরের থোকা থেকে খেতে দেখেছি। অথচ লোহার শিকলে তিনি বন্দী। এদিকে মক্কায় কোনো ফল-ফলাদি নেই। নিশ্চয়ই তা আল্লাহর পক্ষ থেকে খুবাইবের রিজিক হিসেবে পাঠানো হয়। এদিকে কাফিররা খুবাইবকে হত্যার জন্য হারাম শরিফ থেকে বের করে নিয়ে যায়। তখন খুবাইব বলেন, আমাকে দুই রাকাত নামাজ আদায়ের সুযোগ দাও। সুযোগ পেয়ে তিনি দুই রাকাত নামাজ পড়েন। এরপর তিনি বলেন, ‘তোমরা আমাকে ভীত মনে না করলে আমি আরো দীর্ঘ নামাজ পড়তাম।’
মৃত্যুকালে কবিতা পাঠ : এরপর খুবাইব (রা.) একটি বিখ্যাত কবিতা পাঠ করেন, ‘আমার কোনো পরোয়ান নেই, যখন আমি মুসলিম হয়ে মারা যাই, আমার হত্যাকাণ্ড কীভাবে হচ্ছে। তা মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জনে হচ্ছে, তিনি চাইলে আমার দেহের ছিন্নভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বরকত দেবেন।’ এরপর তাকে ইবনুল হারিস হত্যা করে।
শেষ মুহূর্তে নামাজ আদায় : বন্দী অবস্থায় কোনো মুসলিম নিহত হলে খুবাইব (রা.) তাদের জন্য দুই রাকাত নামাজের রীতি চালু করেন। এদিকে মহান আল্লাহ আসিম বিন সাবিত (রা.)-এর অন্তিম আবেদন পূরণ করেন। মহানবী (সা.) সাবাহিদের তাঁদের মৃত্যুর ঘটনা শোনান। এদিকে কুরাইশের একটি দল আসিমের মৃত্যুর খবর শুনে তার মরদেহের খোঁজে বের হয়। মূলত আসিমের দেহের অংশ কেটে নেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। কারণ বদর যুদ্ধে কুরাইশের অনেক নেতাকে আসিম হত্যা করে। কিন্তু কুরাইশের দলটি তার মরদেহের নিরাপত্তায় আসমানে একটি মেঘখণ্ড দেখতে পায়। ফলে তারা আসিমের দেহের কোনো অংশ কাটতে পারেনি। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং : ৩০৪৫)
মহানবীর ভালোবাসায় দৃঢ়তা : সাইদ বিন আমির আল জুমাহি (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমি খুবাইবের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উপস্থিত ছিলাম। কুরাইশের লোকেরা তাকে শূলে চড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি ভালো মনে করো যে মুহাম্মদ তোমর স্থানে থাকবে। তিনি বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমি ভালো মনে করি না যে মুহাম্মদ (সা.)-এর গায়ে কোনো কাঁটা বিদ্ধ হোক।’
খুবাইবের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর রাসুল (সা.) সাহাবিদের তা শোনান। তখন আমর বিন উমাইয়া আল জমিরি (রা.) খুবাইবের মরদেহ দাফনের জন্য আসেন। মক্কায় এসে তিনি সবার অগোচরে রাতের আধারে কাঠের শূল থেকে মরদেহ জমিনে নামিয়ে রাখেন। কিন্তু এরপর আর তাকে দেখা যায়নি। আমর বিন উমাইয়া বলেন, মনে হলো, জমিন তার মরদেহ গিলে ফেলেছে। এরপর কখনো তার মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি।’
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ