।। মুফতিয়ে আযম মুহাম্মদ আব্দুচ্ছালাম চাটগামী ।।
ইবাদত নিয়ে ঠাট্টা বা তাচ্ছিল্য জঘন্য অন্যায়। বরং এমন গুনাহের ফলে অনেক সময় হতে পারে বান্দার ঈমানই শঙ্কার মধ্যে পড়ে যায়। যেমন কেউ বলে ফেলল, ঈমান তো আছেই, তাহলে নামাযের কী প্রয়োজন? যাকাত দেওয়ার দরকার কী? রোযা না রাখলে কী হয়? অর্থাৎ এসব গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতকে সে আদায় তো করেই না, এমনকি আদায়ের কোনো প্রয়োজন আছে বলেও মনে করে না। ফলে অনেক সময় দেখা যায়, এই শ্রেণির মানুষ তার নিজের অজান্তেই ঈমানহারা হয়ে মারা যায়। কারণ, ইসলামের সমস্ত ফরয ও ওয়াজিব বিধান মুমিনদের জন্য আদায় করা আবশ্যক। কেউ যদি অস্বীকার করে, তাহলে সে ঈমানহারা কাফের হয়ে যায়।
আর যদি ফরযকে ফরয বলে, ওয়াজিবকে ওয়াজিব বলে মুখে স্বীকার করে, কিন্তু আমলের ক্ষেত্রে অলসতা করে, উদাসীন থাকে, সময়মতো আদায় করে না, তবে আকীদাগতভাবে সমস্ত বিধান যথাযথভাবে বিশ্বাস করে, তাহলে এর দ্বারা বান্দা কুফুরীতে প্রবেশ করে না। অবশ্য কবীরা গুনাহে লিপ্ত হয়। যদি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাওবা না করে, আল্লাহ যদি ক্ষমা না করেন, তাহলে জাহান্নামে যেতে হবে। যতদিন আল্লাহ চাইবেন, জাহান্নামে থাকতে হবে। তারপর একসময় ঈমানের বদৌলতে জান্নাতে যাওয়ার সৌভাগ্য হবে। কিন্তু কে আছে, যে জাহান্নামের আযাব সহ্য করার জন্য প্রস্তুত আছে! তাই সকল মুমিনের উচিত খাঁটি দিলে তাওবা করা, গুনাহ বর্জন করা এবং পূর্ণরূপে দীন ও ইসলাম মেনে চলা।
যাই হোক, বলছিলাম আল্লাহ তাআলা যেসব রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি করেছেন এবং মুমিনদেরকে আক্রান্ত করেছেন, তা সবই মুমিনদের জন্য অনেক বড় রহমত। এর দ্বারা গুনাহ মাফ হয়।
রোগ সেরে যাওয়ার পর যদি বেঁচে থাকে এবং আর কোনো গুনাহ না করে, তাহলে পবিত্র অবস্থায় আল্লাহর কাছে যাবে এবং সোজা জান্নাতে চলে যাবে। আর যদি আবারও গুনাহে লিপ্ত হয়, তাহলে আবারও তাওবা করতে হবে। নতুবা শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। আবারও রোগ হবে এবং গুনাহ মাফ হবে। আর যদি রোগ না হয়, গুনাহ সহকারেই মৃত্যু হয়, আল্লাহ যদি ক্ষমা করেন, তাহলে তো মুক্তি পেয়ে যাবে। নতুবা কবীরা গুনাহের কারণে জাহান্নামে যেতে হবে। শাস্তি ভোগ করার পর জান্নাতে যেতে পারবে।
মরণব্যাধি মুমিনদের জন্য রহমত হওয়া সম্পর্কে হাদীস
তাহাবী শরীফের একটি বর্ণনায় আছে-
হযরত আমর ইবনুল আস রাদি. থেকে বর্ণিত আছে, শামে যখন মহামারি দেখা দিল, তখন হযরত আমর ইবনুল আস রাদি. ঘোষণা করলেন, তোমরা বিক্ষিপ্ত হয়ে যাও। কেননা এটা একটা শাস্তি। এ খবর যখন হযরত শুরাহবিল বিন হাসানা রাদি.-এর নিকট পৌঁছল, তখন তিনি বললেন, আমি আল্লাহর নবীর সঙ্গে ছিলাম। আমি নবীজিকে বলতে শুনেছি, নিশ্চয় এ মহামারি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে রহমত এবং তোমাদের নবীর দোয়া ও তোমাদের পূর্ববর্তী সৎলোকদের মৃত্যুর কারণ। সুতরাং তোমরা এর জন্য সমবেত হও, বিক্ষিপ্ত হয়ো না। হযরত আমর ইবনুল আস রাদি. এ কথা শুনে বললেন, শুরাহবিল সত্য বলেছেন। (তাহাভী শরীফ, হাদীস- ৬৫৩৯)।
হাদীসের ব্যাখ্যা
সাহাবীদের যুগে হযরত উমর রাদি.-এর খেলাফতকালে একবার শামে মহামারি দেখা দিয়েছিল। অসংখ্য মানুষ এবং বহু সাহাবী তাতে শহীদ হয়েছিলেন। সেসময় হযরত আমর ইবনুল আস রাদি. ছিলেন মিসরের গভর্নর। তিনি তখন কোনো কোনো সাহাবীর অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং কোনো কোনো সাহাবীর জানাযায়ও অংশগ্রহণ করেছিলেন। এমনই এক জানাযার সময় তিনি বলেছিলেন, ভাই, এ মহামারি বড় নিকৃষ্ট রোগ। সুতরাং তোমরা বড় সমাগম থেকে বিরত থাকো। একে অপর থেকে পৃথক থাকো।
এ সময় হযরত শুরাহবিল বিন হাসানা রাদি.-ও উপস্থিত ছিলেন। হযরত আমর ইবনুল আস রাদি.-এর বক্তব্য শুনে তিনি অস্বীকার করলেন। তিনি বললেন, আমি নবীজিকে দেখেছি এবং তার সোহবত লাভ করেছি। আমি নবীজিকে বলতে শুনেছি, এ রোগ কাফেরদের জন্য আযাব হলেও মুমিনদের জন্য পরিপূর্ণ রহমত। এতে তোমাদের নবীদের দোয়াও আছে। তোমাদের পূর্ববর্তী উত্তম ও সৎলোকদের মৃত্যু এই রোগেই হতো। সুতরাং তোমরা এ রোগের কারণে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেয়ো না। বরং যৌথ ইবাদতসমূহ পালন করতে থাকো। আল্লাহর যিকির করো এবং একসাথে সবাই দোয়া করো।
হযরত আমর ইবনুল আস রাদি. এ কথা সমর্থন করলেন এবং বললেন, তিনি সত্য বলেছেন।
এই ঐতিহাসিক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী থেকে এটাই জানা গেল যে, মরণব্যাধি কাফের ও মুশরিকদের জন্য আযাব, কিন্তু মুমিনদের জন্য পুরোটাই রহমত। এ কারণেই যেখানে হাজার হাজার সাহাবীর মৃত্যু হয়েছে, সেখানে অন্যান্য সাহাবী তাদের গোসল দিয়েছেন, কাফন পরিয়েছেন।
উক্ত মহামারিতে আক্রান্ত সাহাবীদের মধ্যে হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রাদি.-ও ছিলেন। নবীজি যাকে ‘আমীনু হাযিহিল উম্মাহ’ উপাধি প্রদান করেছিলেন। হযরত উমর রাদি. তাকে শামের গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন। গভর্নর থাকাকালেই তিনি অসুস্থ হন এবং শামেই মৃত্যুবরণ করেন। হযরত মুআয বিন জাবাল রাদি. তার জানাযা পড়ান। জানাযায় বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটে।
এভাবে সেই মহামারিতে আরও যেসব সাহাবীর ইনতেকাল হয়েছিল, তাদের তালিকা ইতিহাসের কিতাবাদিতে সংরক্ষিত আছে। এরা সকলেই ছিলেন কুরুনে উলা তথা ইসলামের প্রথম যুগের মানুষ, যারা সরাসরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে দীন ও শরীয়ত শিখেছিলেন। মহামারির সময় তারা তাদের আকীদা সঠিক রেখেছেন। যারা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, তারা সবাই শহীদ হয়েছেন আর যারা জীবিত ছিলেন, তারাও দীন ও শরীয়তের শিক্ষার উপর অটল ছিলেন। কিন্তু কোনো সাহাবী এ রোগকে সংক্রামক মনে করতেন না। অর্থাৎ এ কথা বিশ্বাস করতেন না যে, একজনের রোগ অন্যজনের দেহে ছড়াবে। সবাই এটাই বিশ্বাস করতেন যে, সমস্ত রোগ আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। আর মুমিনদের জন্য সব রোগ নেয়ামত ও রহমত। কেননা এর দ্বারা মুমিনদের গুনাহ মাফ হয়, মর্যাদা উঁচু হয় এবং শাহাদাতের মর্যাদা লাভ হয়।
যে-সকল সাহাবী আক্রান্ত হয়েও সুস্থতা লাভ করেছেন, তাদেরও সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। তাদের মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। যতদিন বেঁচে ছিলেন, হায়াতে তাইয়েবা তথা উত্তম জীবনযাপন করে গেছেন। যখন বিদায় নিয়েছেন, ঈমান ও আমলের সাথে বিদায় নিয়েছেন।
আমাদেরও উচিত, সাহাবায়ে কেরামের মতো আকীদা পোষণ করা। কাফের-মুশরিকদের মতো আকীদা রাখা কিংবা তাদের আকীদা গ্রহণ করা ঠিক নয়। নতুবা আমরাও কফের ও মুশরিকদের সাথে যুক্ত হয়ে যাবো। অথচ ঈমানের পর আবার কুফুরীতে লিপ্ত হওয়া কোনো মুমিনের কাম্য হতে পারে না।
উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হল যে, এসব মহামারি কাফের-মুশরিকদের জন্য আযাব এবং মুমিনদের জন্য রহমত। সুতরাং মুমিনরা যদি তাদের আকীদা ও আমলের উপর অটল থাকে, রোগে আক্রান্ত হয়ে সবর করে, আল্লাহর পবিত্র সত্তার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখে, তারপর যদি এ রোগে মৃত্যু না হয়, তাহলে তো ইনশাআল্লাহ জীবন ফিরে পাবে। মৃত্যু নির্ধারিত সময়েই আসবে। আগেও নয়, পরেও নয়। সুস্থ হলে গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। আর যদি মৃত্যু এসেই যায়, তাহলে শহীদের মর্যাদা লাভ করবে।
এই ছিল মহামারিতে আক্রান্ত রোগীদের বিস্তারিত বিধান। এবার আক্রান্তদের যারা সেবা করবে, তাদের ফযীলত নি¤েœ উল্লেখ করা হল।
রোগীর সেবাকারীর ফযীলত
বিভিন্ন হাদীসে অসুস্থ ব্যক্তির সেবাপ্রদানকারীদের জন্য বহু ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লাহর রহমত লাভ করা, ফেরেশতাদের দোয়া পাওয়া ইত্যাদি। এগুলো পড়া উচিত এবং গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা উচিত যে, রোগ-ব্যাধিকে আল্লাহ তাআলা কীভাবে এবং কতটা রহমত ও গুনাহ মাফের কারণ বানিয়েছেন। নিম্নে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হল :
হযরত ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত আছে, অসুস্থ ব্যক্তি যতদিন অসুস্থ থাকে, ততদিন তার দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না। (ইবনে আবিদ্দুনইয়া)।
হযরত উমর রাদি. থেকে বর্ণিত আছে, তোমরা যখন অসুস্থ ব্যক্তির কাছে যাবে, তার কাছে দোয়ার আবেদন করবে। কেননা তার দোয়া ফেরেশতাদের দোয়ার মতো হবে। (তাবারানী)।
– মুফতি মুহাম্মদ আব্দুচ্ছালাম চাটগামী, মুফতীয়ে আযম বাংলাদেশ এবং মজলিসে এদারির প্রধান- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ