।। আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান কাসেমী ।।
[রাজধানীর অন্যতম বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা’র সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক, উত্তরা জামেয়াতুন নূর আল-কাসেমিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদের খতীব আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান কাসেমী শুক্রবার (৬ আগস্ট) জুমায় মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেছেন, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে বয়ানের হুবহু অনুলিপি উম্মাহ পাঠক সমীপে উপস্থাপন করা হল -সম্পাদক]
হামদ ও সালাতের পর…
আল্লাহ পাকের প্রতি লাখো কোটি শোকরিয়া যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর অসংখ্য অগণিত মাখলুকের মাঝে ‘ইনসান’ তথা মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে নির্বাচন করেছেন। এবং আমাদেরকে দয়া করে মনুষ্যজাতি হিসেবে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। আমাদেরকে আমাদের নিজস্ব কোন দাবী-দাওয়া ছাড়াই সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুকের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আরো কোটি গুণ শুকরিয়া যে, আমাদেরকে মুসলমানের ঘরে মুসলমান হিসেবে জন্মগ্রহণ করার তাওফিক দান করেছেন ।
আমরা তো এমন কোন দাবী ‘আলামে আরওয়াহ’ বা রুহের জগতে করিনি যে, “আমাদেরকে মানুষ না বানালে আমরা আমরণ অনশন করবো। আমাদেরকে মুসলিম পরিবারে ঈমানী পরিবেশে দুনিয়াতে প্রেরণ না করলে আমরা হরতাল দেবো। জন্ম গ্রহণ করবো না!”
আর এমন কোন দাবী যদি পাগলামি বশত করেও ফেলতাম, তা-ও আমাদের কিছুই করার ছিলো না। কারণ, জন্মের পূর্বে এবং মৃত্যুর পর কোন দোয়া আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা যে আমাদেরকে মুসলিম দেশে মুসলিম পরিবেশে মানুষ হওয়ার তাওফিক দিয়েছেন, তাই শুকরিয়াতান বলি- আলহামদুলিল্লাহ!
বিশ্বে লাখো মুসলিম পরিবার এমন রয়েছে, যারা মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও ইসলামি কোন কর্মকাণ্ডে শরীক হওয়ার অধিকার নেই। রোযা রাখা নিষেধ, মসজিদে যাওয়া নিষেধ, মাইকে আযান দেয়া নিষেধ, দাড়ি রাখা নিষেধ, বোরখা পরা নিষেধ! তারা প্রকাশ্যে নামায আদায় করতে পারে না, ধর্মীয় কোন উৎসব করার অধিকার নেই, স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করাও কঠিন।
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
সেখানে আমরা দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতে শরীক হতে পারছি, দিনে পাঁচবার মসজিদের মাইকের আজানের শব্দ আমার কানে আসছে। রোযার দিনে রোযা রাখতে পারছি। ঈদের দিনে আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে হুল্লোড় করছি। কুরবানির দিনে কুরবানি করছি। এটা কি শোকরিয়ার বিষয় নয়? হাজার বার শোকরিয়া করলেও এই নিয়ামতের যথাযোগ্য প্রতিদান দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
একজন স্বনামধন্য ডাক্তারের সাথে দেখা হয়েছিলো- বাংলাদেশের একমাত্র ডাক্তার; যিনি ‘ওপেন হার্ট সার্জারী’ (Open heart surgery) করেন। বাইরের দেশেও মাঝে মাঝে অপারেশন কেসে যান। ধর্মের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল।
তিনি বললেন, হুজুর! বিভিন্ন দেশে নওমুসলিম বড় বড় ডাক্তারদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়, তাদেরকে আমি যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি। কারণ তারা তো ‘বাই চয়েজ’ মুসলমান। তারা চাইলে ইসলাম গ্রহণ না-ও করতে পারতেন। এটা তাদের নিজস্ব ইচ্ছাধীন ছিলো। কিন্তু তারা নিজ থেকে ইসলাম সম্পর্কে স্ট্যাডি করে ইসলাম বুঝে অতঃপর ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। আর আমরা যারা মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি, তারা তো ‘বাই চান্স’ মুসলমান। আমাদের সামনে আর কোন রাস্তা নেই। আমরা বংশগত কিংবা জন্মগত ভাবেই মুসলমান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছি। সুতরাং তাদের তথা নওমুসলিমদের মর্যাদা আমাদের চেয়ে বেশি।
আমি বললাম- আচ্ছা শোনেন! আমরা দুনিয়াতে আগমনের পূর্ব পর্যন্ত ছিলাম ‘বাই চান্স’ মুসলমান। কারণ, তার আগ পর্যন্ত আমাদের কারোরই কোন ইখতিয়ার ছিলো না যে, আমরা কোন একটা চয়েজ করে নেবো। বরং আল্লাহ তায়ালা নিজ রহমতে নিজ দয়ায় আমাদেরকে মুসলিম পরিবারে ঈমানী পরিবেশে প্রেরণ করেছেন। সে হিসেবে আমরা ‘বাই চান্স’ মুসলমান।
কিন্তু একটা বাচ্চা যখন শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে উপনীত হয়, এটা সেটা বুঝতে শুরু করে, বিভিন্ন বিষয়ে সে কৌতুহলী হয়। এবং এক সময় কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে। সে সবকিছু বুঝতে শিখে। ইসলামকে পারঙ্গমতার সাথে বুঝতে শুরু করে। তখন কিন্তু তার সামনে রাস্তা খুলে যায়। সে তখন চাইলেই যে-কোন ধর্ম নিয়ে স্ট্যাডি করতে পারে এবং সেই ধর্মের দীক্ষায় দীক্ষিত হতে পারে। এব্যাপারে তার কোন বাধানিষেধ নেই। কিন্তু সে সেসব বাদ দিয়ে ইসলাম ধর্মকেই ‘চয়েজ’ করে নেয়। ইসলামকেই একমাত্র সত্যধর্ম জ্ঞান করে ইসলামী দীক্ষায় দীক্ষিত হয়, এটা কিন্তু তার নিজস্ব চয়েজে। সুতরাং এই হিসেবে আমরা ‘বাই চয়েজ’ মুসলমান।
সমস্ত মুসলিম নর-নারী, নবী-রাসূল, ওলী-আউলিয়া, পীর-মুরশিদ সকলেই জন্ম থেকে যৌবন পর্যন্ত ছিলেন ‘বাই চান্স’ মুসলমান, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর পূনরায় সকলেই ‘বাই চয়েজ’ মুসলমানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন।
আজ থেকে সহস্রাব্দ বছর আগে যখন এই পৃথিবীর কিছুই সৃষ্টি হয়নি, তখনই আল্লাহ পাক লওহে মাহফুজে সকল রূহকে একত্র করেছেন। সেখানে পৃথিবীর সর্বপ্রথম মানব নাবিয়্যিনা হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে পৃথিবীর সর্বশেষ মানবের রূহ উপস্থিত ছিলো। আল্লাহ তায়ালা সে-সকল রূহকে সম্বোধন করে বলেন- ألست بربكم؟
“আমি কি তোমাদের পালনকর্তা (রব) নই?”
প্রতুত্তরে রূহ গুলো বলেছিলো- بلى. شهدنا. “অবশ্যই। আমরা স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আমাদের একমাত্র পালনকর্তা (রব)।” সেই “আলামে আরওয়াহ” থেকেই আমরা ‘বাই চান্স’ মুসলমান।
অতঃপর আল্লাহ তায়ালা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন, একে অপরূপ সাজে সজ্জিত করেছেন। একে পরীক্ষাগার রূপে প্রস্তুত করেছেন এবং মানব জাতিকে পরীক্ষার্থী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। যার পরীক্ষক একমাত্র আল্লাহ। যিনি আহকামুল হাকিমীন। সমস্ত বিচারকদের যিনি বিচারক। যার দরবারে এক নাম্বার কমবেশি হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে আমাদের সর্বপ্রথম ‘বাই চয়েজ’ মুসলমান হতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর যে ফরজ ইবাদাতগুলো আমাদের উপর আবশ্যক করা হয়েছে, সেগুলো যথাযথ আদায় করা/না-করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের রয়েছে। পূর্ণ এক্বীনের সাথে এই মর্মে স্বাক্ষ্য প্রদান করা যে- আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সাথে আদায় করা, বছরে একমাস সিয়াম-সাধনা করা, সামর্থ্যবান হলে জীবনে একবার হজ্জব্রত পালন করা এবং ‘সাহেবে নিসাব’ তথা নিসাব পরিমাণ মাল-সম্পদ থাকলে হিসাব করে যাকাত-সদকা আদায় করা।
আক্বায়েদের কিতাবে আমরা পড়েছি এবং এখন পড়াচ্ছি যে, পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়ার জন্য তিনটি বিষয় জরুরী-
১) যবানে স্বীকারোক্তি প্রদান করা।
২) অন্তুরে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা।
৩) এবং সে অনুযায়ী আমল করা।
সুতরাং ঈমানের এই তিনটি শর্ত বা মূলনীতি প্রয়োজন হয়- যখন একজন মুসলমান পরিণত বয়সে উপনীত হয়। অতএব, প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষ যখন সজ্ঞানে থাকে তখন তার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে যে- “সে কোন ধর্ম গ্রহণ করবে, কোনটা বর্জন করবে”।
এবং এব্যাপারে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, পারিবারিক দৃষ্টিকোণ কিংবা সামাজিক দৃষ্টিকোণ কোনদিক থেকেই তার উপর কোন বাধানিষেধ নেই। সে চাইলে যেকোন একটা গ্রহণ করতে পারে।
সুতরাং তখন যে সে জেনে-বুঝে ইসলাম ধর্মকেই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং একমাত্র সত্য ধর্ম জ্ঞান করে এর সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে, তখন সে আর ‘বাই চান্স’ মুসলমান থাকেনি, বরং তখন সে ‘বাই চয়েজ’ মুসলমান এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে।
মুসল্লিয়ানে কেরাম! আল্লাহ তায়ালা যেহেতু আমাদের দয়া করে ‘বাই চান্স’ মুসলমান বানিয়েছেন, আসুন! আমরা পরিপূর্ণ ‘বাই চয়েজ’ মুসলমান হয়ে জীবন সার্থক করি। ইসলামের প্রত্যেকটি আরকান, প্রত্যেকটি আমাল ‘চয়েজ’ করে করে পূর্ণ করি এবং তার বিনিময়ে পরকালে জান্নাতের সুশীতল ছায়ায় নিজেদের আশ্রয় নিশ্চিত করি।
আল্লাহ আমাদের বুঝার আমল করার তাওফিক দান করুন, আমিন।
অনুলিখনে- মাহমূদ হাসান নাহিয়ান
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ