[রাজধানীর অন্যতম বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা’র সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক, উত্তরা জামেয়াতুন নূর আল-কাসেমিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদের খতীব আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান কাসেমী শুক্রবার (৩০ জুলাই) জুমায় মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেছেন, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে বয়ানের হুবহু অনুলিপি উম্মাহ পাঠক সমীপে উপস্থাপন করা হল -সম্পাদক]
হামদ ও সালাতের পর-
আল্লাহ তায়ালা এই পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। এই পৃথিবীর পাখ-পাখালী, নর-নারী, পশু-প্রাণী, জড়-পদার্থ যা কিছু আছে সবকিছুই একমাত্র আল্লাহর সৃষ্টি। সবকিছুর স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা। এসবকিছু তিনি পরিচালনা করেন, তিনি পরিব্যাপ্ত করেন, তিনি ছড়িয়ে দেন, আবার তিনিই গুটিয়ে নেন।
আল্লাহ তায়ালা তার লাখো-কোটি মাখলুক সৃষ্টি করেছেন ভিন্ন ভিন্ন রূপে, ভিন্ন ভিন্ন গুণে, ভিন্ন ভিন্ন কাজে। একেক মাখলুকের একেক কাজ। তার বিন্যাস তিনি এতটাই সুচারুভাবে বিন্যাস্ত করেছেন যে, কারো সাথে কারো কোনরূপ সংঘর্ষ নেই, কারো কাজের ধারাবাহিকতায় কোন অসংগতি নেই। সকলেই তার নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে।
আগুনের কাজ আগুন করছে, পানির কাজ পানি করছে, বাতাসের উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে সে তার নির্ধারিত দায়িত্বে নিয়োজিত।
আল্লাহা তায়ালা এসবই সৃষ্টি করেছেন তার সেরা মাখলুক মানুষের সেবা করার জন্যে। আল্লাহ তায়ালার সকল সৃষ্টি তার সর্বোত্তম সৃষ্টি মানুষের খেদমতে নিয়োজিত।
মাছ সমুদ্রের তলদেশ থেকে মানুষের জন্য দোয়া করতে থাকে, পাখি ডানা মেলে দিগন্তে হারিয়ে যায় মানুষের জন্য দোয়া করতে করতে। এমনকি ছোট্ট একটা পিঁপড়াও এই মানুষের কল্যাণ কামনাই করতে থাকে।
এভাবে আল্লাহ তায়ালা তার সকল সৃষ্টিকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করে রেখেছেন।
সেই মানুষ যখন নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহকে খুশি করে, তখন তিনি কষ্টদায়ক মাখলুকের মাধ্যমে মানুষের আরামের ব্যবস্থা করে দেন। আর মানুষের মাঝে যখন পাপাচার ছড়িয়ে যায়, তখন তিনি আযাবের মাধ্যমে তাদের কষ্টে নিপতিত করেন।
আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট মাখলুকের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি সামর্থ্য কোনটাই আমাদের নেই। আমাদের যেটা আছে সেটা হলো তার প্রতিকার চেয়ে আল্লাহর নিকট মোনাজাতে রোনাজারি করা, আল্লাহর কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করা।
নমরূদ! সমগ্র বিশ্বের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলো। সমগ্র বিশ্বে সে তার আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিলো। এবং দাম্ভিকতার এক পর্যায়ে সে নিজেকে খোদা দাবী করে বসলো। তার অধিনস্ত সকলকে নিজের দাস মনে করতো। যারাই এক আল্লাহর উপর বিশ্বাস করে তার মিথ্যা খোদায়ী দাবীকে অস্বীকার করছিলো, তাদের স্থান হচ্ছিলো কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ অথবা মৃত্যু। সে সমগ্র বিশ্বে একক আধিপত্য বিস্তার করেছিলো। তখন মুর্তি পূজারী পিতা আযরের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন শিশুপুত্র ইবরাহীম। ছোটবেলা থেকেই প্রকৃত মালিকের খোঁজে যিনি অস্থির, জগৎ-সংসারের আসল স্রষ্টার প্রতি যার অগাধ বিশ্বাস! যাকে আল্লাহ তায়ালা তার খলীল রূপে প্রেরণ করেছেন।
বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন ঘোর মুর্তি বিরোধী! পিতাকে ক্ষণে ক্ষণে এটাই বোঝাতে চাইলেন যে, মনুষ্য সৃষ্ট এসব মুর্তির আসলে কোন ক্ষমতাই নেই, সকল ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার। এভাবেই পিতাকে দিয়ে শুরু হলো ইবরাহীম আ. এর দাওয়াতী কার্যক্রম। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো দিগ্বিদিক। ক্রমেই ঘনিয়ে এলো তাদের বাৎসরিক পুজো উৎসব। ইবরাহীম আ. কে পিতা আযর বললেন, ইবরাহীম! চলো, আজ আমাদের উৎসবের দিন। ইবরাহীম আ. বললেন, বাবাজী! আপনি যান, আমি অসুস্থ! কোরআনে কারীমের সূরা সাফফাতের ৮৯ নং আয়াতে এটা এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে {إني سقيم}। অত:পর সবাই যখন চলে গেলো, তখন তিনি তাদের উপাসনার ঘরে গেলেন এবং বললেন-
“তোমাদের কি হলো? তোমাদের সামনে এতো খাবার, খাচ্ছো না কেনো? কিছু বলছো না কেনো?”
কিন্তু অপর পাশ থেকে কোন প্রতুত্তর আসলো না। তিনি এক কুঠার হাতে নিলেন, একে একে সবগুলো মুর্তির গর্দান উড়িয়ে দিলেন। কিন্তু বড়টাকে অক্ষত অবস্থায় রেখে দিলেন। এবং কুঠারটা তার কাঁধে ঝুলিয়ে দিলেন।
এদিকে আযর সম্প্রদায় তাদের উৎসব শেষে যখন পুজার জন্যে উপাসনালয়ে প্রবেশ করলো, তখন তো তাদের মাথায় হাত! কে করলো এই কাজ তাদের উপাস্যদের সাথে? কার এতো বড় স্পর্ধা! কুরআন কারীমের সূরা আম্বিয়া’র ৬০ নং আয়াতে এসেছে-
قالوا سمعنا فتى يذكرهم يقال له ابراهيم.“আমরা ইবরাহীম নামক এক যুবককে তাদের সমালোচনা করতে শুনেছি”।
সকলের দৃষ্টি গেলো ইবরাহীম আ. এর প্রতি। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি খুবই বুদ্ধিমত্তার সাথে এমন একটি উত্তর প্রদান করলেন, যাতে সমস্ত মূর্তিপূজক ‘থ’ হয়ে গেলো!
কুরআন কারীমের সূরা আম্বিয়া’র ৬০-৬৫ নং আয়াতে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে-
أانت فعلت هذا بآلهتنا يا إبراهيم؟“আমাদের উপাস্যদের সাথে এই এহেন কার্য কী তুমি করেছো?” তিনি প্রতুত্তরে বললেন-
“এদের মধ্যে বড় যেটা এখনো অক্ষত রয়েছে, বরং সে-ই এই কাজ করেছে। তোমরা তাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, যদি সে কথা বলতে সক্ষম হয়”।
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
তাদের মাথা নিচু হয়ে গেলো। কারণ তারা-ও জানতো যে তাদের এই সৃষ্ট উপাস্যদের সামান্য কথা বলার পর্যন্ত সক্ষমতা নেই। ইবরাহীম আ. তাদের প্রশ্ন করে বসলেন-
“তোমরা আল্লাহ ব্যতীত কাদের পূজা করো, যারা তোমাদের কোন উপকার কিংবা ক্ষতি করতে সক্ষম নয়”।
“আফসোস তোমাদের প্রতি, এবং তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদাত করো তাদের প্রতি!”
তাদের মাথা নিচু হয়ে গেলো। তারা সেখান থেকে চলে গিয়ে পরামর্শে বসলো এখন কি করা যায়। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বললেন- حرقوه “তাকে আগুনে জ্বালিয়ে দাও”।
অত:পর নমরূদের নির্দেশে এক বিশাল গর্ত খোড়া হলো। ৬ মাস পর্যন্ত তাতে আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হলো। আগুনের লেলিহান শিখা যখন ৬মাসের মাথায় চরম আকার ধারণ করেলো তখন তার পাশে স্টেজ বানানো হলো। সেখানে নমরূদ এবং তার সভাসদগণ আসন গ্রহণ করলো। এক বিশেষ পদ্ধতিতে হযরত ইবরাহিম খলীলুল্লাহ আ. কে আগুনে নিক্ষেপ করা হলো।
এবার এলো আল্লাহ তায়ালার কুদরত দেখানোর পালা। তিনি বললেন-
“হে আগুন! আমার ইবরাহিমের উপর তুমি শীতল, আরামদায়ক হয়ে যাও”।
আগুন তো আল্লাহরই সৃষ্টি। সৃষ্টি কি স্রষ্টার হুকুমের অন্যথা করতে পারে? আগুন সেদিন ইবিরাহিমের (আ.) জন্য আরামদায়ক হয়ে গেলো।
এভাবেই আল্লাহ তায়ালা যখন যেটা চান, যখন যেটা যেভাবে বলেন সেটা সেভাবেই সম্পন্ন হয়। আগুনের কাজ পোড়ানো হলেও সেদিন সে আল্লাহর নির্দেশে শীতল হয়ে গিয়েছিলো। পানির কাজ ডুবিয়ে ফেলা, অদৃশ্য করে ফেলা। সেই পানিও কখনো কখনও রাস্তা দেখিয়ে দেয়, যদি আল্লাহ তায়ালা হুকুম করেন।
আরেক সম্রাট ছিলো ফেরাউন, যে নিজেকে খোদা দাবী করতো। হযরত মুসা আ. তাকে অস্বীকার করলে তখন ফেরাউন ও তার বাহিনী মুসা আ: ও তার অনুসারীদেরকে ধাওয়া করে। মুসা আ: ও তার অনুসারীগণ নীল নদের কিনারায় পৌঁছে গেলে যখন সামনে আর রাস্তা ছিলো না তখন আল্লাহর নির্দেশে তিনি তার লাঠি দ্বারা সাগরে আঘাত করলে তাদের জন্য পানি সরে গিয়ে রাস্তা তৈরী হয়ে যায়।
এ ব্যপারে সূরা ত্বহা এর ৭৭ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন- طريقا في البحر يبسا “সাগরের মাঝে তাদের জন্য শুকনো রাস্তা হয়ে গেলো”।
এমনিভাবে হযরত নূহ আ: এর সময়কালে যখন মহাপ্লাবন হয়েছিলো এবং নূহ আ: তার অনুসারীদের নিয়ে নৌকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন এক বৃদ্ধা যিনি ঈমান এনেছিলেন তিনি যথাসময়ে নৌকায় উঠতে পারেননি। প্লাবন শেষে যখন নূহ আ: ফিরে এলেন, তখন বৃদ্ধাকে স্বাভাবিক দেখতে পেলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, ‘এই প্লাবন আপনি কীভাবে প্রতিরোধ করলেন? বৃদ্ধা অবাক হয়ে বললেন, কিসের প্লাবন? কই?’
আল্লাহ তায়ালা সারা বিশ্বকে প্লাবিত করলেও এই বৃদ্ধাকে তিনি অক্ষত রেখে প্রমাণ করলেন যে, পানি তারই একটি সৃষ্টি, তার উপরে তিনি ক্ষমতাবান, তাকে যখন যেটা করতে বলবেন তখন সে সেটাই করবে।
এভাবেই আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে প্রমাণ করে এসেছেন যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা-কিছু আছে সব তারই সৃষ্টি, সবকিছুর উপরই তিনি ক্ষমতাবান, যাকে যে কাজে সৃষ্টি করেছেন সে সেটাতেই ব্যস্ত থাকবে, আবার তিনি আদেশ দিলে সে তার উল্টো টাও করতে পারবে।
বর্তমানে আমাদের সামনে যে পরিস্থিতি, করোনাভাইরাস! এটাও আল্লাহর এক সৃষ্টি। এক অতি ক্ষুদ্র মাখলুক! আল্লাহর নির্দেশেই এর বিচরণ! একে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই, এর মোকাবিলা করার শক্তিও নেই আমাদের।
তো আমাদের করণীয় কি?
আমাদের করণীয় হলো- এই প্রতিকার আল্লাহর কাছে তালাশ করা, আল্লাহর কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করা, আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
এটা আল্লাহরই এক ক্ষুদ্রতম সৃষ্টি, আল্লাহ চাইলেই পারেন আমাদের কে এই মহামারি থেকে মুক্ত করতে।
আসুন! আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি, ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা পরিহার করি।
আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন, আমিন!
অনুলিখনে- মাহমূদ হাসান নাহিয়ান
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ