Home সাক্ষাৎকার টিকাগ্রহণ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় ইসলামের কোন বাধা নেই: সাক্ষাৎকারে মাও. নিজামপুরী

টিকাগ্রহণ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় ইসলামের কোন বাধা নেই: সাক্ষাৎকারে মাও. নিজামপুরী

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার প্রায় দেড় বছর সময় পার হতে চলেছে। এতে দেশে এ পর্যন্ত ১২ লাখ ৩০ হাজার নাগরিক আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ২০ হাজার ২৫৫ জন। আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার চলতি মাসে বহু গুণে বেড়ে গেছে। গ্রামে-গঞ্জ থেকেও বহু আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর আসছে।

করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় এবং ছড়িয়ে পড়া রোধের লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি জারি করেছে সরকার। বর্তমানে সারাদেশে কঠোরতম লকডাউন চলছে। এতে খাাদ্য ও ঔষধ উৎপাদন কারখানা ছাড়া অন্যান্য কল-কারখানা এবং গার্মেন্টসহ সকল অফিস ও বাণিজ্যকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। জনচলাচল কঠোরভাবে সীমিত করা হয়েছে। করোনা মহামারির ক্রমবর্ধমান এই পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।

করোনা পরিস্থিতিতে দেশের আলেম সমাজ কী ভাবছেন এবং পরিস্থিতি উত্তরণে কি উপদেশন দিচ্ছেন জানার জন্য উম্মাহ’র পক্ষ থেকে আমরা কথা বলেছি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বিখ্যাত ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী’র অন্যতম মুহাদ্দিস ও যুক্তি-তর্ক বিভাগের অধ্যাপক জনপ্রিয় বক্তা মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরীর সাথে।

উম্মাহ’কে দেওয়া মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরীর সাক্ষাৎকার পর্বের পুনর্বিবরণী উম্মাহ পাঠন সমীপে নিম্নে উপস্থাপন করা হল-

উম্মাহ: প্রায় দেড় বছর যাবত বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব চলছে। এতে বহু মানুষ আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছেন। এই মহামারি কত দিন চলবে, কেউ অনুমান করতে পারছেন না। মহামারি কেন আবির্ভুত হয়, ইসলামের আলোকে এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন।

মাও. আশরাফ আলী নিজামপুরী: মহামারীকে আরবী ভাষায় ‘তা’ঊন’ বলা হয়। সময় ও ইসলামের ইতিহাসে  বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই মহামারী মহান আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে এক প্রকারের আযাব। ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেক বড়-বড় ডাক্তার ও চিকিৎসকদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেছি। তারাও আমার সাথে একমত পোষণ করে স্বীকার করে নিয়েছেন যে- করোনা মহামারীসহ যাবতীয় মহামারী ও দুর্যোগ মহান আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে এক ধরনের আযাব ছাড়া কিছু নয়।

এই মুহূর্তে একটি হাদীস আমার মনে পড়েছে- নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন,
যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগরোগের প্রাদুর্ভাব হয়। এছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং- ৪০১৯)।

উম্মাহ: মহামারির বিপর্যয় চলাকলীন করণীয় প্রসঙ্গে ইসলামের কি নির্দেশনা রয়েছে?

মাও. আশরাফ আলী নিজামপুরী: আগেই বলা হয়েছে, মহামারীর দুর্যোগ মহান আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে এক প্রকারের আযাব ও ঈমানদারদের জন্য পরিক্ষা। এই মহামারী চলাকালীন বেশি-বেশি করে রুজূ’ ইলাল্লাহ তথা আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া, তাওবা এবং ইস্তিগফারের আমল করতে হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মাস্ক ব্যবহারসহ স্বস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং সাথে সাথে আক্রান্ত এলাকায় আসা-যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবীজী (সা.)এর একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস রয়েছে।  হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- “যখন তোমরা কোথাও মহামারির সংবাদ পাবে তখন সেদিকে যেও না। আর যদি তোমরা মহামারীতে আক্রান্ত ভূমিতে পূর্ব থেকেই অবস্থান করো, তাহলে সেখান থেকে পালিয়ো না।”  (বুখারী শরীফ, হাদীস নং- ৫৭৩৯, মুসলিম শরীফ, হাদীস নং- ২২১৯)।  

আরও পড়তে পারেন-

উম্মাহ: করোনা মহামারি থেকে রক্ষা পেতে ও ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে জনস্বার্থে দেশের স্বাস্থ্যবিভাগ বেশকিছু স্বাস্থ্যবিধি জারি করেছে। একজন সচেতন আলেম হিসেবে এসব বিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে আপনার অভিমত যদি জানাতেন?

মাও. আশরাফ আলী নিজামপুরী: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্যবিভাগ কর্তৃক যে সকল স্বাস্থ্যবিধি জনগণকে মানতে বলা হয়েছে, তাতে শরীয়তবিরোধী কিছু না থাকলে মেনে চলতে তো কোন বাধা নেই। মাস্ক ব্যবহার এবং হাত ধোয়া, হাঁচি ও কাশির সময় চোখ-মুখ ঢেকে রাখা ইত্যাদি পালন করতে কোন অসুবিধা নেই। বরং হাত-মুখ ধোয়া এবং হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখার ব্যপারে বিশেষভাবে ইসলামে দিকনির্দেশনা রয়েছে। তবে যেহেতু মহামারী আল্লাহর পক্ষ থেকে একধরনের গজব, সুতরাং রহমতের জায়গা মসজিদকে স্বাস্থ্য বিধির আওতামুক্ত রাখা উচিত, এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত।

উম্মাহ: বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বর্তমানে বাংলাদেশেও করোনা মহামারির তৃতীয় ঢেউ চলছে। এতে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার আশংকাজনক বেড়েছে। প্রতিদিন রেকর্ডসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করছেন। এ পর্যায়ে সরকারের তরফ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি করোনার টিকাদান কর্মসূচী চলছে। করোনার টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে ইসলামের আলোকে কোন বিধি-নিষেধ আছে কিনা?

মাও. আশরাফ আলী নিজামপুরী: করোনার টিকা বা ভ্যাকসিন গ্ৰহণ করা মানে ঔষধ সেবন করা। আর ঔষধ সেবন করা আমাদের নবীজী (সা.)-এর সুন্নাত। সুতরাং করোনায় মৃত্যুর প্রবল আশংকা থাকার প্রেক্ষিতে ইসলামের আলোকে করোনার টিকা গ্রহণে কোন নিষেধ থাকার কথা নয়।

তবে টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে অবশ্যই এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, মনে এমন ভাবনা আনা যাবে না যে, এই টিকা গ্ৰহণ করলেই আমি বেঁচে থাকব, আর গ্ৰহণ না করলেই আমি মৃত্যু বরণ করব। কারণ, মুসলমানদেরকে সবসময় দৃঢ়ভাবে এমন বিশ্বাস পোষণ করে চলতে হবে যে, জীবন-মৃত্যুসহ সকল কিছুর চূড়ান্ত ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। তাঁর ইচ্ছা ছাড়া এক ধুলিকণাও এদিক-ওদিক হওয়ার ক্ষমতা রাখে না।

উম্মাহ: করোনা মহামারির এই লম্বা সময়ে গভীর স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের পাশাপাশি বহুমুখী সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটও তৈরি হয়েছে। এসব সঙ্কট উত্তরণে দেশের আলেম সমাজ কী কী ভূমিকা রাখছেন, যদি একটু বলতেন।

মাও. আশরাফ আলী নিজামপুরী: কওমী অঙ্গনের ওলামায়ে কেরাম ঈমান-আক্বিদা ও একান্ত ধর্মীয় বিষয়বালীর পাশাপাশি দেশের আর্থসামাজিক ও মানবিক পরিস্থিতিতেও সবসময় সরব ভূমিকা পালন করে থাকেন। করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই দেশবাসী দেখে আসছেন যে, যখন করোনায় মৃত্যুবরণকারীর লাশ গ্রহণে পরিবারের স্বজনরাও এগিয়ে আসছিল না, অনেক স্বজন করোনার মৃত ব্যক্তির লাশ রেখে পালিয়ে গেছেন, তখনও উলামায়ে কেরামের বিভিন্ন টিম এগিয়ে এসে এসব লাশ গোসল, কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করেছেন। শুরু থেকেই এখনো পর্যন্ত করোনা মৃত্যুবরণকারীদের লাশ দাফনের ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামই মুখ্য ভূমিকা রেখে আসছেন। যা সারা দেশে এখনো চলমান আছে।

এছাড়াও গরীব, ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে ত্রাণ হিসেবে খাদ্যসামগ্রী ও নগদ অর্থবিতরণ, চিকিৎসা ও ঔষধ সংগ্রহে সহযোগিতাদানসহ আরো বিভিন্ন মানবিক কর্মকাণ্ডে সমগ্র দেশেই উলামায়ে কেরামের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ আছে। উলামায়ে কেরামের পরিচালিত বিভিন্ন মানবিক সংগঠন এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। এ পর্যায়ে আল-মারকাজুল ইসলামী, অঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম, আল-মানাহিল ফাউন্ডেশন, তাক্বওয়া ফাউন্ডেশন, মাদানী ফাউন্ডেশন-এর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। করোনা রোগীদের জন্য চট্টগ্রামে আল-মানাহিল ফাউন্ডেশনের স্বতন্ত্র হাসপাতাল স্থাপন, এম্বুলেন্স সেবাদান এবং দাফন কাজ পরিচালনা সারাদেশে সাড়া জাগিয়েছে।

এই সংগঠনসমূহ এম্বুলেন্সের মাধ্যমে করোনা রোগীদের হাসপাতালে আনা-নেওয়া ও দাফন কাজে এম্বুলেন্স সেবাদান, রক্তদান কার্যক্রম খুবই প্রশংসিত হয়েছে। এসব মানবিক কাজে অংশ নিতে উলামায়ে কেরাম দেশের সম্পদশালী ধনীদেরকে ধর্মের আলোকে উদ্বুদ্ধ করেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

 মহান আল্লাহ তা’আলা সারা পৃথিবীতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যে সকল  ঈমানদার মৃত্যু বরণ করেছেন তাদেরকে শহীদের মর্যাদা দান করুন এবং আক্রান্তদেরকে সুস্থতার নেয়ামত দান করুন। আমীন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।