।। আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ আব্দুচ্ছালাম চাটগামী ।।
করোনা ভাইরাস সম্পর্কে কয়েকটি কথা আমাদের ভালোভাবে মনে রাখতে হবে। যথা-
এক. প্রথম কথা, সুস্থতা যেমন মানুষের জন্য আল্লাহর নেয়ামত, তেমনই অসুস্থতাও নেয়ামত। তবে অসুস্থতা আসে মানুষের অবস্থা সংশোধন এবং গুনাহ মাফ করানোর জন্য। দুই. দ্বিতীয় কথা, দুনিয়াতে যত রোগ-ব্যাধি আছে, সব আল্লাহর সৃষ্টি। সব রোগ আল্লাহর নির্দেশেই আসে এবং তার আদেশ মেনে চলে।
তিন. আর তৃতীয় কথা এই যে, আল্লাহ তাআলা যত রোগ সৃষ্টি করেছেন, তার প্রতিটির প্রতিষেধকও সৃষ্টি করেছেন। একদিকে তিনি রোগের মধ্যে রেখেছেন মন্দ প্রভাব ও অসুস্থ করার শক্তি, অন্যদিকে ঔষধ ও চিকিৎসার মধ্যে রেখেছেন ভালো প্রভাব এবং সুস্থ করার শক্তি। সুতরাং রোগ ও ঔষধ উভয়টিই সর্বাবস্থায় আল্লাহর আদেশে নিজ নিজ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। তাঁর আদেশ না হলে কোনোটিরই কোনো প্রভাব-প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায় না।
পবিত্র কুরআন ও আল্লাহর নবীর হাদীস সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করলে এ তিনটি কথাই স্পষ্টভাবে জানা যায়। যেমন-
সহীহ বুখারীতে আছে, হযরত আবু হুরাইরা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
আল্লাহ যত রোগ সৃষ্টি করেছেন, প্রতিটির জন্য প্রতিষেধকও সৃষ্টি করেছেন।
মুওয়াত্তা ইমাম মালেকে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
অর্থ- “যিনি রোগ সৃষ্টি করেছেন, তিনিই ঔষধ সৃষ্টি করেছেন”। এক হাদীসে আরও আছে-
সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা কি চিকিৎসা করাব? নবীজি বললেন, হ্যাঁ, তোমরা চিকিৎসা করাও। কেননা আল্লাহ তাআলা যত রোগ সৃষ্টি করেছেন, প্রতিটির জন্য ঔষধও সৃষ্টি করেছেন।
অপর হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, যে জাতির মধ্যে ধোঁকা ও প্রতারণা দেখা দেবে, আল্লাহ তাদের অন্তরে শত্রুর ভয় ঢেলে দেবেন। যে জাতির মধ্যে ব্যভিচার ব্যাপক হয়ে যাবে, তাদের মধ্যে মৃত্যুও ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়বে। আর যে জাতি ওজনে বেশকম করবে, আল্লাহ তাদের রিযিক সংকীর্ণ করে দেবেন। যে জাতি অন্যায় বিচার করবে, (আল্লাহ ও তার রাসূলের বিধানের বিপরীতে জুলুম ও অন্যায় বিচারের অভ্যাস করবে) তাদের মধ্যে খুনখারাবি ও রক্তপাত বেশি ঘটবে। যে জাতি ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে, আল্লাহ তাআলা তাদের উপর শত্রুকে চাপিয়ে দেবেন।
এ হাদীস থেকে জানা গেল, কিছু গুনাহের কারণে আল্লাহ তাআলা মানুষের উপর কিছু আযাব চাপিয়ে দেন, যাতে মানুষ গুনাহ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর কাছে ফিরে আসে। সুতরাং যদি মানুষ তাওবা করে, তাহলে আল্লাহ চাপিয়ে দেওয়া আযাব দূর করে দেন। অপরপক্ষে যদি মানুষের অবাধ্যতা আরও বেড়ে যায়, তাহলে আল্লাহ আরও নতুন আযাব পাঠিয়ে দেন।
ইসলামের পূর্বে দুনিয়াতে বহু জাতিগোষ্ঠী অতিবাহিত হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, একেক জাতির অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তাআলা একেক ধরনের আযাব ও শাস্তি পাঠিয়েছিলেন এবং অবাধ্য জাতিকে শাস্তি ও আযাবে নিপতিত করেছিলেন। আযাব আসার পরও যদি তারা ফিরে না আসত, তাহলে আরও বড় আযাব দিয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দিতেন।
সহীহ বুখারীর এক বর্ণনায় আছে-
হযরত আমের ইবনে সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস তার পিতা (হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদি.) থেকে বর্ণনা করেন, হযরত আমের শুনেছেন, তার পিতা হযরত সা’দ হযরত উসামা বিন যায়েদ রাদি.-এর কাছে জানতে চাইলেন, আপনি (হযরত উসামা বিন যায়েদ) মহামারি সম্পর্কে আল্লাহর নবী থেকে কী শুনেছেন?
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
হযরত উসামা রাদি. বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মহামারি একটি নিকৃষ্ট ব্যাধি। বনি ইসরাইলের কোনো জাতির উপর কিংবা তোমাদের পূর্ববর্তী কোনো জাতির উপর আল্লাহ এ রোগ পাঠিয়েছিলেন (অর্থাৎ অবাধ্য জাতিকে আযাব ও শাস্তি দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন)। সুতরাং তোমরা যখন কোনো এলাকা সম্পর্কে শুনবে যে, সেখানে এই রোগ দেখা দিয়েছে, তোমরা সেখানে যাবে না (কেননা, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আযাব, আর আযাবের এলাকা থেকে দূরে থাকা উচিত)। আর যদি তোমাদের কোনো এলাকায় থাকাকালে এ রোগ এসে পড়ে, তাহলে এর থেকে পলায়নের জন্য তোমরা সেখান থেকে বের হবে না।
হাদীসের ব্যাখ্যা : নিষেধাজ্ঞার কারণ
সহীহ বুখারীর টীকায় মাওলানা খলিল আহমাদ সাহারানপুরী রহ. মহামারি আক্রান্ত-এলাকায় প্রবেশ করতে এবং আক্রান্ত-এলাকা থেকে বের হতে নিষেধ করার কারণ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এই নিষেধ তানযিহী বা তাশফিফী। অর্থাৎ উত্তম হিসেবে বা সুস্থ থাকার উপায় হিসেবে বলেছেন। সুতরাং যদি কোনো প্রয়োজনে যেতে হয় বা বের হতে হয়, তবে তা জায়েয হবে। এতে বড় কোনো গুনাহ হবে না। কিন্তু যদি মহামারি থেকে পলায়নের উদ্দেশ্যে অন্যত্র যায়, তাহলে গুনাহ হবে। এজন্য শাস্তি হতে পারে। এই নিষেধাজ্ঞার অনেক কারণ রয়েছে। যেমন-
১. আক্রান্ত-এলাকা থেকে অন্য কোথাও গেলে সেখানকার দুর্বল ঈমানের লোকেরা মনে করবে, মহামারি আক্রান্ত-এলাকা থেকে আগত লোকজনের দ্বারা আমাদের এলাকায় মহামারি ছড়িয়ে পড়বে। সুতরাং তাদেরকে আমাদের এলাকা থেকে বের করে দেওয়া হোক; এই ভুল ধারণায় যাতে কেউ না পড়ে, এজন্য হাদীসে আক্রান্ত-এলাকা থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে।
২. মহামারি আক্রান্ত-এলাকা থেকে আগত ব্যক্তির মৃত্যু যদি মহামারিতে অবধারিত থাকে, তাহলে অন্য কোথাও গেলেও তার মৃত্যু আসবে। সুতরাং অন্য কোথাও গিয়ে তো কোনো লাভ হল না। বরং অন্য এলাকার লোকদেরকেও বিভ্রান্ত করা হল, সে নিজেও মরে গেল।
৩. মহামারি আক্রান্ত-এলাকা থেকে আগত ব্যক্তির মৃত্যু যদি লিখিত না থাকে, তাহলে হয়তো সে মহামারিতে আক্রান্তই হবে না, অথবা হলেও সুস্থ হয়ে উঠবে, মারা যাবে না। কেননা প্রত্যেকের মৃত্যুর দিন, সময় ও স্থান নির্ধারিত আছে। সেদিন, সে সময় এবং সেই স্থানেই তার মৃত্যু হবে; সামান্য আগেও না, পরেও না।
৪. মহামারি আক্রান্ত-এলাকা থেকে বেরিয়ে গেলে মৃত্যু আসবে না, অথবা আক্রান্ত-এলাকায় গেলেই মরণ হবে, এ কথা বিশ্বাস করা কুফুরী। প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জরুরী হল, এমন আকীদা-বিশ্বাস বর্জন করা। নতুবা ঈমানী মৃত্যু হবে না, কুফুরী মৃত্যু হবে।
সারকথা, হাদীসে আক্রান্ত-এলাকা থেকে পলায়নের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপের একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে ইসলামবিরোধী আকীদা-বিশ্বাস থেকে রক্ষা করা।
অবশ্য যদি কারও আকীদা আগে থেকে সঠিক থাকে, তাহলে প্রয়োজন-সাপেক্ষে আক্রান্ত-এলাকা থেকে অন্যত্র যেতে পারবে। একইভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখার জন্য যদি আক্রান্ত-এলাকায় প্রবেশ করে, সেখানে গিয়ে অসুস্থ ব্যক্তির সেবা-যতœ করে, তাহলে তাও পারবে, কোনো অসুবিধা নেই। তবে শর্ত হল আকীদা ঠিক থাকতে হবে। অসুস্থ ব্যক্তির দেখাশোনা ও সেবা-যতেœর বিনিময়ে হাদীসে অনেক সাওয়াবের কথা বর্ণিত আছে। সেই সাথে ফেরেশতাদের দোয়াও পাওয়া যাবে এবং এর দ্বারা মুসলমান ভাইয়ের হকও আদায় হবে।
মহামারি বা কোনো রোগের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই
মহামারি আক্রান্ত-এলাকায় গেলেই মরণ এসে পড়বে অথবা অসুস্থ হয়ে যাবে এটা ইসলামের আকীদা নয়। বরং কুফুরী আকীদা এবং মুশরিকদের বিশ্বাস। এ-জাতীয় আকীদা-বিশ্বাস থেকে মুসলমানদের তাওবা করা উচিত। নয়তো কুফুরীর আশঙ্কা আছে। উদাহরণত আক্রান্ত-এলাকা থেকে যদি অন্যত্র না যায় এবং সেখানে কারও মৃত্যু হয়ে যায়, তাহলে এতে খারাপ ধারণা করা উচিত নয়। বরং এ আকীদা রাখা জরুরী যে, মৃত্যুর সময় তো নির্ধারিতই ছিল। সুতরাং আল্লাহর হুকুমেই সেই মৃত্যু এসেছে। আল্লাহর হুকুম ছাড়া মৃত্যু আসতে পারে না। আর আল্লাহর হুকুম থেকে কেউ বাঁচতেও পারে না।
সঠিক আকীদা নিয়ে রোগে মারা গেলেও শহীদ
এমন আকীদা নিয়ে যদি কোনো বান্দা মারাও যায়, তাহলে হাদীসের ভাষা অনুযায়ী সে শহীদের মর্যাদা লাভ করবে এবং শহীদদের মতো সাওয়াব ও নেয়ামত লাভ করবে।
এ মর্মে হাদীস শরীফে এসেছে-
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে মহামারি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। নবীজি তাকে বললেন, মহামারি হল একটা আযাব। আল্লাহ তাআলা যার উপর ইচ্ছা করেন, এ আযাব পাঠান। তবে মুমিনদের জন্য তিনি এটাকে রহমত বানিয়েছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি ধৈর্য সহকারে মহামারি আক্রান্ত-এলাকায় থাকবে, আর বিশ্বাস করবে যে, যা হবে আল্লাহর হুকুমেই হবে, তাহলে (মহামারিতে মারা গেলে) সে শহীদের ন্যায় সাওয়াব লাভ করবে।
এমনিভাবে নাসায়ি শরীফে এসেছে-
মহামারিতে নিহত ব্যক্তি শহীদ, ডায়রিয়ায় নিহত ব্যক্তি শহীদ, পানিতে ডুবে নিহত ব্যক্তি শহীদ এবং আগুনে পুড়ে নিহত ব্যক্তিও শহীদ।
মোটকথা, আকীদা সঠিক রেখে মারা গেলে উক্ত ফযীলত পাওয়া যাবে। অর্থাৎ বিশ্বাস করতে হবে যে, মহামারিতে মারা যাওয়া, পেটের কোনো রোগে মারা যাওয়া, এমনিভাবে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া এবং আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া, সব আল্লাহর হুকুমেই হয়েছে। কারণ, আল্লাহর হুকুম ছাড়া মহামারির মধ্যে কাউকে মেরে ফেলার কোনো ক্ষমতা নেই। এমনিভাবে পেটের রোগের মধ্যে কাউকে মেরে ফেলার, পানির মধ্যে কাউকে ডুবিয়ে মারার এবং আগুনের মধ্যে কাউকে পুড়িয়ে মারার ক্ষমতা নেই। সুতরাং এসবে যারা মারা গেছে, তারা আল্লাহর হুকুমেই মারা গেছে। তাকদীরে এমনই লেখা ছিল। এরূপ সঠিক আকীদা পোষণের কারণে এসব ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তিকে শাহাদাতের প্রতিদান দেওয়া হবে।
আর যদি তার আকীদা এমন না থাকে, বরং মনে করে যে, অমুক জায়গায় যাওয়ার কারণে মহামারি হয়েছে, অমুক বস্তু খাওয়ার কারণে বা ব্যবহারের কারণে পেটে অসুখ হয়েছে, আল্লাহর হুকুমে হয়নি। এমনিভাবে মনে করে যে, অমুক স্থানে যাওয়ার কারণে পানিতে ডুবে মারা গেছে। যদি সেখানে না যেত তাহলে মারা যেত না। অথবা মনে করে যে, অমুক স্থানে যাওয়ার কারণে আগুনে পুড়ে মারা গেছে এবং সে নিজেই মৃত্যুকে ডেকে এনেছে। আল্লাহর হুকুমে মারা যায়নি। তাহলে এগুলো হবে শিরকী আকীদা। এমন আকীদা নিয়ে কেউ মারা গেলে শহীদের মর্যাদা পাবে না।
– আল্লামা মুফতি আব্দুচ্ছালাম চাটগামী, মুফতিয়ে আযম বাংলাদেশ এবং পরিচালনা পরিষদের প্রধান, জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ