ইলুমুল কিরাআহ বা কোরআন তেলাওয়াতের বিধি-বিধান আয়ত্ত করে কারি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে অনেক পরিশ্রম ও অনুশীলনের প্রয়োজন। পবিত্র কোরআন সুন্দরভাবে পাঠের অনুশীলনে অনেক সময় কয়েক বছর এমনকি এক যুগও অতিবাহিত হয়।
আলজেরিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বসোনিয়া-হার্জেগোভেনিয়া ও অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সম্মেলনের নারী-পুরুষ উভয়ে কোরআন তেলাওয়াত করে থাকেন।
তবে অনেক দেশে মুসলিমরা মনে করেন, শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে নারীরা কোরআন তেলাওয়াত করতে পারেন না। কারণ তাদের মতে নারীদের কণ্ঠস্বর ‘সতর’ হিসেবে গণ্য হয়, যা আবৃত রাখা জরুরি।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
এদিকে অনলাইনে সুন্দর কোরআন তেলাওয়াতের অনেক অডিও-ভিডিও পাওয়া যায়। তবে নারী কারিদের কোরআন তেলাওয়াত তেমন পাওয়া যায় না। মুসলিম তরুণীদের কোরআন তেলাওয়াত অনলাইনে ছড়িয়ে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ দিয়ে একটি ক্যাম্পেইন শুরু হয়।
মূলত স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোর নারী অধিকারকর্মী মাদিনাহ জাভেদ (২৫) মুসলিম নারীদের কেরাত বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে এ উদ্যোগ নেন। তিনি নিজেও একজন কারিয়াহ। ‘হ্যাশট্যাগ ফিমেল রিসাইটার’ লিখে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারে ক্যাম্পইন শুরু করেন।
মাদিনার ক্যাম্পেইনটি শুরুর পর অনলাইনে আগের চেয়ে অনেক বেশি মুসলিম নারী ও তরুণীদের কেরাত পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোরআন তেলাওয়াতে তাঁদের অংশগ্রহণও অনেক বেড়েছে। নারীদের কোরআন তেলাওয়াতের ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠায় সমাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
মাদিনাহ গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক পড়েন। শৈশবে মায়ের সঙ্গে মাদিনাহ কেরাতের ক্লাস করতে যেতেন। তখন পরিবার সঙ্গে কাতারে বসবাস করত। মায়ের ক্লাসে উপস্থিত হয়ে সবকিছু আয়ত্ব করতেন। এরপর ধীরে ধীরে তিনি কারিয়াহ-এ পরিণত হন।
দীর্ঘ দুই যুগ তেলাওয়াতের অনুশীলনের পর ২০১৭ সালে মাদিনাহকে সেন্ট মেরির ক্যাথেড্রাল-এ কোরআন তেলাওয়াতের আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানকার খ্রিস্টান ও ইহুদিদের একটি অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নেন। তাঁর সুরলিত কণ্ঠের তেলাওয়াত শুনে উপস্থিত অতিথিরা মুগ্ধ হয়ে পড়েন। সবার প্রশংসা শুনে মাদিনাহ নিজেও আপ্লুত হন।
কিন্তু অনুষ্ঠানে তেলাওয়াতের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের পর অনেকে বিরূপ মন্তব্য করেন। যা মাদিনাহকে মানসিকভাবে অত্যন্ত কষ্ট দেয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের এমন বিরূপ মন্তব্য তাঁর কাছে আশাতীত মনে হয়।
শুধু তাই নয়, কয়েক মাস তাঁকে উদ্দেশ্যমূলক অনেক ঘৃণ্য বার্তা পাঠানো হয়। ফলে তিনি তাঁর নাম পরিবর্তন করে আত্মগোপন হওয়ার ইচ্ছা করেন। পুলিশ তাঁর ফোন নাম্বার রেজিস্টার করে রাখেন, যেন ফোন দেওয়া মাত্রই পৌঁছতে পারেন। এদিকে পুরো অগ্নিপরীক্ষার সময় মুসলিম সমাজ নীরব ছিলেন। তাছাড়া যুক্তরাজ্যের অনুষ্ঠানগুলোতে সাধারণত নারীদেরকে কোরআন তেলাওয়াতে সুযোগ দেওয়া হয় না।
মূলত মাদিনার ভাবনা ছিল, কোরআনের অর্থের প্রতি সবার মনোযোগ থাকবে। তেলাওয়াতকারীর লিঙ্গ, বর্ণ বা পোশাকের এক্ষেত্রে কোনো বাধা হতে পারে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি উপলব্ধি করেন যে অনেক স্বর্ণ টুকরো ঢাকা পড়ে আছে।
অনলাইনে ভিডিও প্রকাশের তীর্যক মন্তব্যের পাশাপাশি অনেক মুসলিম নারী নিজেদের অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা জানান। প্রথম বারের মতো তাঁরা অনুষ্ঠানে একজন নারীকে কোরআন তেলাওয়াত করতে দেখছেন বলে জানান।
সম্প্রতি আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে মাদিনাহ বলেন, ‘আমি নিজের মেধা ও শ্রম ব্যয় করে সুন্দর কিছু করার চেষ্টা করছি। আমার মনে হয়েছে যে নারী কারিয়াহ বা তেলাওয়াতকারীর সংখ্যা নাই বললেই চলে। আমি এ শূণ্যতা পূরণের চেষ্টা করেছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘নারীদের কোরআন তেলাওয়াতের সংস্কৃতি পুনরায় চালু করতে নারী কারিয়াহদের সঙ্গে আমার কার্যক্রম শুরু করি। অতঃপর অনলাইনে নারী কারিয়াদের একটি সুন্দর দল তৈরি হয়। আমার প্রধান লক্ষ্য ছিল, নারীরা যেন অনলাইনে নিজেদের তেলাওয়াত শেয়ার করতে পারে এবং নিজেদের ঐতিহ্যে স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন।’
২০১৫ সালে নিউইয়র্ক ভিত্তিক ইউনিয়ন থিওলজি সেমিনারি-এর সহযোগী অধ্যাপক জেরুশা ট্যানার রোডস অনলাইনের একট ক্যাম্পেইন শুরু করেছিলেন। পবিত্র কোরআনের তেলাওয়াত বিষয়ক অ্যাপ ও ওয়েবসাইটে নারী কারিয়াদের যুক্ত করতে ‘হ্যাশট্যাগ এড এ ফিম্যাল রিসাইটার’ নামে একটি ক্যাম্পেইন করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ ছয় বছর পরও কিউএটি নামের অ্যাপে শুধুমাত্র মালয়েশিয়ার বিখ্যাত নারী কারিয়াহ মারিয়া উলফার কেরাত পাওয়া যায়।
ট্যানার রোডস বলেন, ‘কারি না হলেও একজন মুসলিম হিসেবে পবিত্র কোরআন পাঠ করা ওয়াজিব তথা আবশ্যক। তেমনি কোরআন কীভাবে পড়তে হয় তা জানাও এই আবশ্যকিতার মধ্যে পড়ে। তাছাড়া কণ্ঠের বৈচিত্রতা এই আবশ্যকতার অংশ।’ সূত্র : আল জাজিরা।
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ