Home ইতিহাস ও জীবনী যুগশ্রেষ্ঠ সংস্কারক ও আদর্শ দা’য়ী মুফতিয়ে আযম হযরত ফয়যুল্লাহ (রাহ.)

যুগশ্রেষ্ঠ সংস্কারক ও আদর্শ দা’য়ী মুফতিয়ে আযম হযরত ফয়যুল্লাহ (রাহ.)

।। আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী ।।

[গত ২৭ জুন ২০০৮ইং ‘মুফতি ফয়যুল্লাহ্ একাডেমী’র উদ্যোগে হাটহাজারী পার্বতী উচ্চ বিদ্যালয় মিলনায়তনে শতাব্দীর বিস্ময়কর কিংবদন্তী, বাংলার জমীনে দাওয়াত ও সংস্কারের সফল রূপকার ও অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মুফতিয়ে আযম আল্লাম ফয়যুল্লাহ (রাহ.)এর জীবন, কর্ম ও অবদানের উপর অনুষ্ঠিত হয় এক বর্ণাঢ্য আলোচনা সভা।

সভায় হযরত মুফতিয়ে আযম (রাহ.)এর সংস্কারমলক অবদানের উপর গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক, স্বনামধন্য হাদীস বিশারদ, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী’র বিশিষ্ট মুহাদ্দিস হযরত আল্লামা হাফিয মুহাম্মদ জুনায়েদ (দা.বা.)। তিনি তাঁর বক্তব্যে হযরত মুফতিয়ে আযম (রাহ্.)এর সংস্কারমলক অবদানের উপর আলোকপাত করতে গিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে ইসলামের চৌদ্দশত বছরের তাজদীদ ও সংষ্কারের দীর্ঘ ইতিহাসও তুলে ধরেন অত্যন্ত সাবলীল ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায়। বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে মূল্যবান ভাষণটির সারসংক্ষেপ পাঠক সমীপে পত্রস্থ করা হলো। – সম্পাদক]

ইসলামে দাওয়াত ও সংস্কারের ঐতিহাসিক ক্রমধারা

মহান রাব্বুল আলামীনের অসংখ্য অগণিত সৃষ্টিকুলের মধ্যে মানবজাতি নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। এই মহান জাতিটিকে সৎ ও সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে প্রেরণ করেছেন অসংখ্য নবী-রাসূল। সেই যে হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু, এরপর একে একে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, অসংখ্য চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর মাধ্যমে নবুওয়াতের এই বর্ণাঢ্য ধারাবাহিকতার সফল পরিসমাপ্তি ঘটে। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সা.)এর আনীত দ্বীনই মানবজাতির জন্য আল্লাহর মনোনীত সর্বশেষ  জীবন বিধান এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী- রাসূল কিংবা কোন ধর্মের আবির্ভাব হবে না, তাই সকল খোদাদ্রোহী ও শয়তানী চক্রান্তকে নস্যাৎ করে কিয়ামতব্দি ইসলামের এই শাশ্বত মশালটিকে টিকিয়ে রাখার  দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে মহানবী (সা.)এর খোলাফায়ে কেরাম, আলিম-ওলামা তথা তাঁর স্বার্থক উত্তরাধিকারীদের উপর। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন প্রতি এক শতক অন্তর এই উম্মতের জন্য এমন মহামানব প্রেরণ করবেন, যিনি তাদের দ্বীনকে সংস্কার করবেন। (মিশকাত শরীফ-১/৩৬ পৃষ্ঠা)।

মিল্লাতে ইসলামিয়ার এসব দায়ী ও মহান সংস্কারকগণ এবং তাঁদের অবদানের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ। এক্ষেত্রে সাহাবা পরর্বতী যুগের সর্বপ্রথম মুহাদ্দিস হচ্ছেন খলীফায়ে রাশেদা হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজীজ (রাহ.) (৬১হি:-১০১হি:)। তিনি তাঁর মাত্র দুই বছর পাঁচ মাসের স্বল্পকালীন খেলাফতকালে ইলম, আমল, আখলাক ও সিয়াসতসহ ইসলামের সকল গুরুত্বপূর্ণ শাখায় যে বিপ্লবী সংস্কার সাধন করেছিলেন, তা ইসলামের  ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকবে। এর পর বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী (২১-১১০হি:)এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। তিনি তাঁর অসামান্য দুরদর্শীতা এবং যাদুকরী ওয়াজ-নসীহত দ্বারা উম্মাহর দিকে ধেয়ে আসা চারিত্রিক অধঃপতনের বিশাল সয়লাবকে রুখে দেন। যখন হাদীসে রাসূলের সংকলন এবং সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সামনে এসে দাঁড়ায় তখন তা ইবনে শিহাব যুহরী (৫১-১২৪হিঃ) এবং ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬হিঃ) প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ ইমামে হাদীসগণের হাতে পূর্ণতা লাভ করে। যখন ফিক্হে ইসলামির সংকলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়, তখন তাও ইমাম চতুষ্টয়, বিশেষতঃ ইমাম আজম আবু হানীফা (৮০-১৫০হিঃ) এবং তার সুযোগ্য শিষ্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমের বদৌলতে পূর্ণতায় পৌঁছে। আব্বাসীয়দের শাসনামলে যখন ভ্রান্ত মু’তাযিলা স¤ž্রদায় ‘খালকে কুরআন’ (অর্থাৎ- কুরআনকে আল্লাহর সৃষ্টি মনে করে। এটি ছিল উম্মাহর মারাÍক ফিত্না গুলোর মধ্যে একটি)কে নিজেদের নিদর্শন এবং কুফর ও ঈমানের মাপকাঠি বানিয়ে জোর প্রচারণায় নামে, তখন ইমামে রাব্বানী ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (১৬৪হি:-২৪১) একাই ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা ও পাহাড়সম মনোবল বুকে নিয়ে শাসকযন্ত্রের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে এই ঈমান বিধ্বংসী ঝড়ের মুকাবেলায় বুক টান করে দাঁড়িয়ে যান। তিনি তাঁর অসামান্য ত্যাগ ও কোরবানীর নজরানা দিয়ে শেষ পর্যন্ত এই ধ্বংসাÍক ফিতনাকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে সক্ষম হন।

খালকে কুরআনের আক্বীদা তো শেষ পর্যন্ত নিজের গতি হারিয়ে ফেলেছিল; কিন্তু মু’তাযিলারা এতে একদম দমে যায়নি। হিজরী তৃতীয় শতাব্দির মধ্যবর্তী সময়ে তারা আবারো পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে ফিতনায়ে ই’তিযালের ঝান্ডা নিয়ে সদর্পে আবির্ভুত হয়। যখন নব্য যুক্তিবাদি এবং দর্শনকে হাতিয়ার বানিয়ে তারা ওলামায়ে আহলে সুন্নাহর উপর একের পর এক সাঁড়াশী আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন ইমাম আবুল হাসান আশআরী (ইন্তিকাল ৩২৪হিঃ) এবং ইমাম আবুল মানসূর মাতুরীদী (ইন্তিকাল ৩৩২হিঃ) প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ সংস্কারকগণ তাদের অসামান্য প্রতিভা এবং অকল্পনীয় যোগ্যতা বলে এই ফিতনারও মূলোৎপাটন করে সুন্নাহর ঝান্ডাকে সমুন্নত রাখেন। ইমাম মাতুরীদী রাফেযী এবং কারামিতা সম্প্রদায়েরও জোরদার মুকাবেলা করেন।

যখন খাল কেটে কুমির আনার মত নব্য আমদানীকৃত গ্রীক দর্শন ইসলাম ও নবুওয়াতের ভিত্তিমূলেই কাঁপন ধরিয়ে দেয় এবং বাতেনী ফিত্না ইসলামের যাবতীয় রীতি-নীতি এবং আক্বিদা বিশ্বাসকে সন্দেহ ও সংশয়ের সাগরে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য আদাজল খেয়ে নামে, তখন পঞ্চম শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে আল্লাহর আদেশ ও মেহেরবাণীতে উম্মাহর ভাগ্যাকাশে উদিত হয় ইমাম গাজালী (৪৫০-৫০৫হি:) নামক এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, ইসলামী এবং সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানে যাঁর অনন্য সাধারণ পারদর্শিতা ছিল সর্বজন বিধিত।

তিনি ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’ নামে এক বিস্ময়কর গ্রন্থ রচনা করে ভ্রান্ত দর্শনের এবং আল-মুস্তাজহিরী নামে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করে বাতেনীদের সকল তেলেসমাতির মুখোশ উন্মোচন করে দেন। উম্মাহর প্রাণে সঞ্চার করেন এক নতুন উদ্যম, সাহস এবং নবজীবনের প্রেরণা।

দ্বীনের দাওয়াত এবং মুসলমানদের মধ্যে ঈমানী চেতনা সৃষ্টির নতুন মিশন নিয়ে আবির্ভুত হন হযরত আব্দুল কাদের জীলানী (ইন্তিকাল- ৫৬১হিঃ), যিনি তাঁর জাগরণী দাওয়াত ও ইসলাহের মাধ্যমে নিজের মিশনকে সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে দেন।

সপ্তম শতাব্দিতে যখন ইসলামী দুনিয়ার আকাশে যুক্তিকেন্দ্রিক বস্তুবাদের ঘনঘটা দেখা দেয়, উম্মাহর রূহানী ও আমলী শক্তি, ঈমানী জোশ ও জযবা এবং ইশক ও মা’রিফাতে ইলাহীর উত্তাপ; যা এই উম্মাহর সবচেয়ে বড় পুঁজি; ক্রমেই নিস্তেজ হতে থাকে। এমনি এক হতাশাজনক মুহর্তে ইশকে ইলাহীর মোহনীয় সূর লহরী নিয়ে ধরীত্রীর বুকে আবির্ভুত হন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংস্কারক ও সাধক মহাকবি মাওলানা জালালউদ্দীন রুমী (৬০৪-৬৭২হি:)। তিনি তাঁর অনবদ্য অনন্য অবিস্মরণীয় গ্রন্থ মসনবীর মাধ্যমে উম্মাহর কর্ণকুহরে পুণরায় পৌঁছে দেন ইশকে ইলাহীর জাগরণী গান।

অষ্টম শতাব্দিতে যখন নানারকম শিরকী ধ্যান ধারণা ও রুসূম রেওয়াজ, ব্যক্তি পূজা ও মাজার পূজাসহ যাবতীয় কুসংস্কার এবং খ্রীস্টানী ক্রুসেডারদের আগ্রাসনে গোটা উম্মাহ্ দিশেহারা- তখন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সংস্কারক হাফিজ ইবনে তাইমিয়া (ইন্তিকাল- ৭২৮হি:) তাঁর সুগভীর জ্ঞান এবং অসামান্য পান্ডিত্য ও প্রজ্ঞা দ্বারা এসব ফিত্নার মুকাবেলা করেন অত্যন্ত বলীষ্ঠ ও সার্থক ভাবে, শীয়া ফিত্না এবং গ্রীক দর্শনের ভিত্তিমূলে তিনি যেভাবে কার্যকরী আঘাত হানেন, তা ইসলামের ইতিহাসে  চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকবে।

ভারত বর্ষে ইসলামের ঈমানী রুহানী এবং আখলাকী বিজয় তখনো বাকি ছিল। কিন্তু শায়খুল ইসলাম খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (ইন্তিকাল- ৬২৭হিঃ) আগমন করে এক্ষেত্রেও ইসলামকে বিজয়ের শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছে দেন।

দশম শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে এবং একাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে যখন শিরক, বিদআত, রুসূম-রেওয়াজ এবং যাবতীয় পাপাচারের ভারে ইসলামের মহীরূহটি কুঁজো হয়ে পড়ে।

এর সাথে আবার আকবরের স্বপ্রণীত ভ্রান্ত ধর্ম দীনে ইলাহী, মরার উপর খাড়ার ঘা-এর মত উম্মাহর ঘাড়ে কোপ বসায়। এমনি এক যুগসন্ধিক্ষণে দ্বীনের পতিত প্রায় ঝান্ডাকে আরেকবার বজ্রমুষ্টিতে তুলে ধরেন হযরত শায়খ  আহমদ সেরহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রাহ.) (ইন্তিকাল- ১০৩৪হিঃ)।

এরপর উপমহাদেশের মাটিতে ব্যাপকারে ইলমে হাদীস এবং ইলমে তাফসীরের চর্চা ও গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন ইমামুল হিন্দ আল্লামা শাহ ওলীউল্লাহ দেহলভী (ইন্তিকাল- ১১৭৬হিঃ) এবং তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী ও শিষ্যগণ।

দারুল উলূম দেওবন্দের অভ্যুদয়

১৮৫৭ সালের অকল্পনীয় ও ধ্বংসাÍক বিপযর্য়ের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ, ইউরোপ থেকে আগত বস্তুবাদ ও খৃষ্টবাদের তীব্র সয়লাবকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য এবং শয়তানের দোসর নব্য ফেরাউন ইংরেজ শক্তির বর্বর জুলুম নির্যাতন ও বিজাতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির করাল গ্রাস থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষা করার মহান মিশন নিয়ে ১২৮৩ হিঃ মুতাবেক ১৮৬৬ ইং সনে হযরত আল্লামা কাসেম নানুতবী (রাহ.) (ইন্তিকাল- ১২৯৭হিঃ) তাঁর একদল বিশ্বস্ত সহযোগী নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন উপমহাদেশের ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’ তথা দেওবন্দ আন্দোলন।

দারুল উলূম দেওবন্দ তার দেড় শতাব্দীর দীর্ঘ গৌরবময় ইতিহাসে এমন হাজারো সুদক্ষ আলিম, বিজ্ঞ ফকীহ্, প্রতিথযশা মুহাদ্দিসের জন্ম দিয়েছে, যাঁরা ছিলেন জাহেরী ও বাতেনী উভয় ময়দানের যুগপৎ সিপাহসালার, যুগের অতন্দ্র নকীব এবং উম্মাহর বলিষ্ঠ নেতা ও ইমাম। যাঁরা কেবল ভারত বর্ষেরই নয়, বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আশা আকাংখাকার পাদপ্রদীপ হয়ে উম্মাহর নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন।

দারুল উলূম হাটহাজারী প্রতিষ্ঠা

চতুদর্শ হিজরী শতাব্দীতে যখন বাংলাদেশে (তদানীন্তন বাংলায়) ইসলামের মশালটি মিটিমিট করে জ্বলছিল। নানা রকম শিরক-বিদআত, হিন্দুত্ববাদী রসম-রেওয়াজ ও ধ্যান-ধারণা এবং অজ্ঞতা গোমরাহী ও যাবতীয় পাপাচারের নিকষ কালো অন্ধাকারে ছেয়ে গিয়েছিল বাংলার বিস্তির্ণ ভূমি। এমনি এক নিদারুন মুহূর্তে দেওবন্দী মতবাদের ভিত্তিতে আহলে সুন্নাহ্ ওয়াল জামাতের সঠিক মতাদর্শের প্রচার-প্রসার ও ব্যাপক চর্চার মহান লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাংলার গৌরব, যুগের শ্রেষ্ঠ চার সংস্কারক শায়খুল কুল হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ (ইন্তিকাল- ১৩২৩হিঃ), শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ (ইন্তিকাল- ১৩৬০হিঃ), মুহাক্কিকুল আসর মাওলানা সূফী আজীজুর রহমান (রাহ.) (ইন্তঃ ১৩৩৯হিঃ) এবং মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা আব্দুল হামীদ (রাহ্.) (ইন্তিকাল- ১৩৩৮হি/)  ১৩২০ হিজরী মুতাবেক ১৯০১ খ্রীস্টাব্দে দারুল উলূম হাটহাজারী নামক জগদ্বিখ্যাত এক ঐতিহাসিক ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপন করেন।

আরও পড়তে পারেন-

আল্-হামদুলিল্লাহ! এই বিশাল দ্বীনী প্রতিষ্ঠান, ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই মহান ঝর্ণাধারা, যা বাংলার যমীনে দেওন্দী মতাদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সর্বপ্রথম দ্বীনী প্রতিষ্ঠান; বাংলার যমীনে মুসলমানদের হৃত গৌরব পূণরায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার, তাহ্যীব ও তামাদ্দুন এবং দাওয়াত ও তাবলীগের ক্ষেত্রে এমন যুগান্তকারী সংস্কারমূলক অবদান রেখে চলেছে, যা ইসলামের ইতিহাসে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।

দারুল উলূম দেওবন্দ এবং দারুল উলূম হাটহাজারীর গৌরবময় সন্তান ও মুখপাত্র, সালফে সালেহীন এবং উম্মাহর দায়ীগণের সার্থক উত্তরসূরী, যুগশ্রেষ্ঠ সংষ্কারক, ইসলামী রেনেসাঁর অগ্রপথিক, শিরক-বিদআত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে চিরসংগ্রামী এক অকুতোভয় মর্দে মুজাহিদ মুফতিয়ে আযম হযরত আল্লামা ফয়যুল্লাহ্ (রাহ্.)।

মুফতিয়ে আযম হযরত আল্লামা ফয়যুল্লাহ (রাহ্.) এবং তাঁর সংস্কার আন্দেলন

মুফতিয়ে আযম হযরত আল্লামা ফয়যুল্লাহ (রাহ.) ১৩১০ হিজরী সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানাধীন মেখল নামক এক সবুজ ঘেরা পাখি ডাকা সুন্দর মনোরম গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা দারুল উলূম হাটহাজারীতে সমাপন করার পর সিহাহ্ সিত্তাসহ হাদীসশাস্ত্রের বিভিন্ন কিতাবাদির অধ্যায়ন এবং অন্যান্য শাস্ত্রের ব্যুৎপত্তি লাভ করার জন্য উপমহাদেশের সুবিখ্যাত ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলূম দেওবন্দ গমন করেন। ইমামুল আসর আল্লামা  আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রাহ.)এর অত্যন্ত আস্থাভাজন এবং মেধাবী ছাত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন।

১৩৩৩ হিজরী সালে শিক্ষা সমাপন করে দেওবন্দ থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে  প্রথমেই দারুল উলূম হাটহাজারীর একজন সিনিয়র উস্তাদ  এবং এর প্রধান মুফতি হিসেবে দীর্ঘকাল ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচার-প্রসার এবং উৎকর্ষ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যান। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের  সকল শাখায় তাঁর গভীর পান্ডিত্য ও পরিপক্কতা ছিল প্রবাদতুল্য। বিশেষতঃ ফিক্বাহ ও উসুলে ফিক্বাহ এবং ইসলামী আইনের রকমারী সমস্যার সমাধান প্রদানে তাঁর অবদান ছিল একক ও অদ্বিতীয়। তাঁর অসাধারণ মেধা ও মননশীলতা এবং অতি উচ্চমার্গের তাহকীক ও গবেষণা ছিল সর্বজন স্বীকৃত।

লেখালেখি ও রচনার ময়দানে ছিল তাঁর স্বভাবজাত যোগ্যতা। বাল্যকাল থেকেই আরবী, উর্দু ও ফর্সি সাহিত্যের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল ঝোক। একেবারে ছাত্র জীবনেই বেশ কটি মল্যবান গ্রন্থ রচনা করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। এরপর এক মুহর্তের জন্যও তাঁর হাত থেকে কলম খসে পড়েনি। আজীবন তিনি লিখে চলেছেন বিরামহীন ভাবে। একথা বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলার ওলামায়ে কেরামের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বেশী গ্রন্থের রচয়িতা। তার মত এমন বিশাল রচনা ভান্ডার আর কেউ রেখে যেতে সক্ষম হননি। তার ক্ষুরধার লেখনি ছিল উম্মাহর পথহারা মুসাফিরদের জন্য অমানিষার ঘোর তমসায় সুবহে সাদিকের জাগানিয়া পয়গাম। যুগ জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে রচিত তার অনবদ্য গ্রন্থগুলো ইসলামী সাহিত্য ও রচনার ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধশালী।

তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের আল্লাহ প্রেমিক এবং সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণে ইস্পাত কঠিন ব্যক্তিত্ব। ইত্তিবায়ে সুন্নাহ্ পরিণত হয়েছিল তাঁর চরিত্রের ভূষণে। তিনি ছিলেন একাধারে একজন যশস্বী আলেমে দ্বীন, আদর্শ লিখক এবং উম্মাহর কল্যাণ কামনায় সবর্দা এক অস্থির হৃদয়ের অধিকারী একজন নিষ্ঠাবান দায়ী ইলাল্লাহ। তাঁর দাওয়াত ও তাবলীগ, দরস ও তাদরীস এবং লিখনি ও সাহিত্যের অভিষ্ঠ লক্ষ্যই ছিল দেশ ও জাতিকে কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করা এবং শয়তানী শক্তির সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়ে ইসলামের সুমহান বাণী ও অনুপম আদর্শকে জনসম্মুখে তুলে ধরা। বিশেষতঃ মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাওহীদ এবং সুন্নাহ্কে প্রতিষ্ঠা করা এবং শিরক, বিদআত, রসম-রেওয়াজ; যেমন- কবর পুজা, মাজার ব্যাবসা, ওরশ, মীলাদ-কিয়াম, কুলখানী, চেহলাম ইত্যকার যাবতীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি আমরণ সংগ্রাম করে গেছেন অত্যন্ত নির্ভিক চিত্তে, আপোষহীন ও বলিষ্ঠ ভাবে। বলতে গেলে পুরা জীবনটাই তিনি ব্যায় করেছিলেন তার এই বিপ্লবী সংস্কারমূলক কর্মকান্ডে। দাওয়াত ও ইসলাহের ক্ষেত্রে তিনি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং বিশেষ চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন। শরীয়তের এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা সাধারণ মুসলমানগণ তো বটেই, আলেম সমাজেরও ছিল দৃষ্টি বহির্ভুত, সেগুলোও তার চুলছেরা বিশ্লেষন ও গবেষণার দর্পনে সূর্যালোকের মত উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। তার দাওয়া ও ইসলাহের বিশেষ একটি দিক হচ্ছে, তিনি দ্বীনি মাদ্রাসাসমহ এবং ওলামায়ে কেরামের ইসলাহ নিয়ে বেশী ফিকির করতেন।

তাঁর রচনা এবং ওয়াজ নসীহতের বিরাট একটি অংশ জুড়েই থাকত আলিম সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন মূলক দিকনির্দেশনা। তিনি বিদআত ও কুসংস্কারমুক্ত তাসাউফ ও তরীকতে বিশ্বাসী ছিলেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন তাসাউফকে তিনি উম্মাহর জন্য মারাÍক আফিম মনে করতেন। উম্মাহর সংশোধনের ক্ষেত্রে তিনি  ‘রাহে নবুওয়াত’ এবং “রাহে বেলায়াত” উভয়টিকেই সঠিক এবং সফল মনে করতেন। তবে তিনি সাধারণ মানুষদের জন্য রাহে বেলায়াতের তুলনায় রাহে নবুওয়াতকে অধিক নিরাপদ মনে করতেন। তার ওয়াজ-নসীহত, কিতাবাদী ও গবেষণা কর্মগুলো বিশ্লেষণ করলে একথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া এবং মুজাদ্দিদে আলফেসানী দ্বারা  বিশেষ ভাবে প্রভাবিত ছিলেন। অনেকটা তাদের স্টাইলেই তিনি তাঁর সংস্কার কার্যগুলো আঞ্জাম  দিয়েছিলেন। বোখারী শরীফ এবং মুজাদ্দিদে আলফেসানীর মাকতূবাত তিনি সবচেয়ে বেশী অধ্যয়ন করতেন। কথিত আছে যে, পাঁচবার তিনি গভীর অভিনিবেশ সহকারে বোখারী শরীফ আদ্যোপান্ত অধ্যায়ন করেন।

সালফে সালেহীন এবং আকাবিরগণের প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা। তবে আল্লাহর বাণী এবং রাসূলের পয়গামকে তিনি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতেন এবং সবকিছুর  ঊর্ধ্বে মনে করতেন। সত্যের প্রকাশে তিনি ছিলেন দূরন্ত দুঃসাহসী। এতে তিনি কে কী বলল! কে কী করল! কিংবা পরিণতি কী হবে? তার কোন পরোয়াই করতেন না। এগুলো তাঁর বিশাল কর্মময় জীবনের কয়েকটি শিরোনাম মাত্র। এর প্রত্যেকটির বিশদ বর্ণনার জন্য হাজার পৃষ্ঠার ভলিয়মও যথেষ্ট নয়। তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকেন এবং শেষ জীবনে নিজ বাড়ীতে অবস্থান করে রিয়াজত-মুজাহাদায় আত্মনিয়োগ করেন।

নিজ গ্রামে সম্পূর্ণ সালফে সালেহীনের মতাদর্শের ভিত্তিতে ‘মাদ্রাসায়ে হামিউসুসন্নাহ’ নামে প্রতিষ্ঠা করেন একটি বিরল ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্টময় দ্বীনী মাদ্রাসা।

ইখলাস, তাওয়াকুলের মর্ত প্রতীক, ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহাসাগর তুল্য এই মহামনীষী অসংখ্য শিষ্য-শাগরিদ ও অনুরক্তদের ছেড়ে অবশেষে ১৩৯৬হিঃ সালে তাঁর কর্মময় বহুমুখী: সংগ্রামী ও বর্ণাঢ্য জীবনের ইতি টেনে নস্বর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।

লেখকঃ শায়খুল হাদীস ও শিক্ষাসচিব- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম এবং আমীর- হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।