।। জামালউদ্দিন বারী ।।
সমগ্র বিশ্ব যখন এক ভয়াবহ মহামারির তান্ডবে অস্থির, সন্ত্রস্ত, কোটি কোটি মানুষের একেকটি শহর জনপদ মৃত্যুপুরিতে পরিনত হচ্ছে, তখন বিশ্ব সম্প্রদায়ের নেতারা সব বিভেদ ভুলে মহামারি মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন। ঠিক সে সময়ে ইহুদি জায়নবাদি রাষ্ট্র ইসরাইল বিশ্বের সামনে যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে। জায়নবাদীদের প্ররোচণায় ইরানের সাথে একটি অনিবার্য যুদ্ধের ভয়াবহতা এড়াতে ২০১৫ সালে ৬ জাতির পরমাণু সমঝোতা হয়েছিল।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ইউরোপীয় মিত্রদের সাথে কোনো রকম বোঝাপড়া না করেই ইসরাইলের প্ররোচনায় ইরানের সাথে আন্তর্জাতিক পরমাণু সমঝোতা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো ভেবেছিলেন, তাকে অনুসরণ করে ইউরোপীয়রাও এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাবে এবং এভাবেই এই চুক্তি অকার্যকর ও বাতিল হয়ে যাবে। আদতে তা হয়নি, ইউরোপীয়রা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে ইরানও তার অবস্থান পরিবর্তন করবে বলে ঘোষণা দেয়।
চুক্তির শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে রাশিয়া ও জার্মানীর শক্ত ভূমিকার কারণে অনেক চেষ্টায় অর্জিত ৬ জাতি সমঝোতা চুক্তি টিকিয়ে রাখতে শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হয়। নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদায় এবং অপেক্ষাকৃত মডারেট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর সমঝোতা চুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসার পথ সুগম হয়। এ লক্ষ্যে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ৬ জাতির আলোচনা চলছে। এখনো সমাধানে পৌঁছানো না গেলেও আলোচনার ফলাফল নেতিবাচকও নয়। ইসরাইলের অসাধু ইচ্ছা ও অন্যায় আবদারের প্রতি ইঙ্গ-মার্কিনীদের শর্তহীন প্রতিশ্রæতি বিশ্ব শান্তির জন্য কত বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে তা বিশ্বের সামনে বার বার প্রমাণিত হলেও নীতিগত পরিবর্তনের কোনো চাপ এখনো দৃশ্যমান হয়নি।
সাম্প্রতিক বিশ্ব ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, গত ৭০ বছর ধরে বিশ্বশান্তির বিপরীতে অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তা ও অন্যায় যুদ্ধের নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছে ইসরাইল। এর নেপথ্যে সক্রিয় রয়েছে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। জাতিসমূহের মধ্যে ইরানের পরমাণু সমঝোতা টিকিয়ে রেখে শান্তির পথ অবারিত রাখতে যখন ভিয়েনায় আলোচনা চলছে, তখন যুদ্ধবাজ ইসরাইলের গোয়েন্দা মন্ত্রী এলি কোহেন এই চুক্তির বিরুদ্ধে হুমকি দিয়ে বলেছেন, বিশ্ব সমঝোতায় ফিরলে যুদ্ধ অনিবার্য। মধ্যপ্রাচ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এড়াতে বিশ্ব সম্প্রদায় যখন সমঝোতার পথ বেছে নিয়েছেন, তখন জায়নবাদি ইসরাইল আবারো ইরানসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে যুদ্ধের হুমকি ও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল।
গত কয়েক মাস ধরেই ইসরাইল ইরানের সাথে একটি অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। এ যুদ্ধে ইসরাইলকে একা ভাবলে বড় ধরণের ভুল হবে। গত বছর ইংরেজী নববর্ষের শুরুতেই ইরানের উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ আল কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সুলাইমানিকে বাগাদাদ বিমান বন্দরে ড্রোন হামলায় হত্যার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে ইসরাইলের হয়ে মার্কিন বাহিনী এই যুদ্ধের অন্যতম অংশিদার। এরপর বছরের শেষদিকে ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে ড্রোন থেকে রিমোট কন্ট্রোল মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করা হয়।
সর্বশেষ ইরানের নাতাঞ্জ নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর সাইটে স্যাবোটাজের ঘটনাসহ বেশকিছু ঘটনায় ইসরাইলের সংশ্লিষ্টতার প্রমান পাওয়া যায়। ভূমধ্যসাগরে ইরান ও ইসরাইলী ট্যাংকার ও জাহাজে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনাও ঘটেছে। গত সপ্তায় সিরিয়ার বানিয়াস রিফাইনারি টার্মিনালের উপকূলে নোঙ্গর করা একটি ইরানি তেলবাহী টেঙ্কার সন্ত্রাসী ড্রোন হামলার শিকার হয়। ইরানের পক্ষ থেকে অভিযোগের তীর ইসরাইলের দিকে।
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে সিরিয়া ও ইরাকে আইএস সন্ত্রাসী হামলা মোকাবেলায় বিশ্বের পরাশক্তিগুলো যখন যখন ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে আইএস বিরোধী যুদ্ধে শামিল হয়েছে তখন কৌশলগতভাবে ইসরাইলের অবস্থান বরাবরই আইএস’র পক্ষে। সিরিয়ার বাশার আল আসাদের বাহিনী বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে পর্যুদস্তু করে একের পর এক অঞ্চল নিজেদের দখলে নিতে শুরু করলে ইসরাইলী বাহিনী সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা সিরিয়ার সরকারি বাহিনী, সিরিয়ায় সক্রিয় ইরানের আল কুদস ব্রিগেড, হামাস, হেজবুল্লাহর ঘাঁটিগুলোতে বিমান হামলা অব্যাহত রাখে। সেই সাথে কুর্দিস্তানের ফোর্সকে নানাভাবে সহায়তা করে মধ্যপ্রাচ্যে জাতিগত রাজনৈতিক সংকটকে আরো জটিল করে তুলতে ভূমিকা রাখছে ইসরাইল।
এখন তুরস্কের অভিযানের মধ্য দিয়ে সে স্বপ্নও অনেকটা ফিকে হয়ে যেতে বসেছে। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দিয়ে ৬ জাতির পরমাণু সমঝোতা চুক্তি ভেস্তে দিয়ে ইরানের উপর হামলার পটভূমি সৃষ্টির বদমতলবও এখন ভেস্তে যেতে বসেছে। জায়নবাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ঘোষিত অন্তহীন যুদ্ধের পটভূমি থেকে সরে আসার ঘোষণা ইসরাইলের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তির ভর কেন্দ্রগুলোতে যুদ্ধের আশঙ্কা জিইয়ে রাখার মধ্যে অস্ত্র ব্যবসায় এবং যুদ্ধবাদী অর্থনীতির অস্তিত্ব নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। শান্তিচুক্তি ও সমঝোতার পথ যুদ্ধবাদী অর্থনীতি ও ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডার জন্য প্রতিবন্ধক। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনে যুদ্ধ বন্ধের আশঙ্কার মধ্যে জায়নবাদিরা এখন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র সৃষ্টি করতে চায়।
এটা মে মাস এবং রমজান মাস। সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত জায়নবাদি আগ্রাসী বাহিনীর হাতে ফিলিস্তিনের ভূমিপুত্রদের হাজার বছরের বসতভিটা ও ঐতিহ্য বুলডোজারে গুড়িয়ে দিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিন ১৪ মে তারিখটি ফিলিস্তিনীরা গত ৭২ বছর ধরে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয় দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। অন্যদিকে, ইরানে বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনি জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের সংকল্প ঘোষণা করেন। তিনি রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে আল কুদস বা জেরুজালেম মুক্তির দিবস হিসেবে পালন করতে বিশ্ব মুসলিমের প্রতি আহবান জানান।
ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে পবিত্র জেরুজালেম ও বায়তুল মোকাদ্দাসের নিয়ন্ত্রণ জায়নবাদিদের হাতে চলে যাওয়ার পর থেকেই মুসলিম উম্মাহ দখলদারিত্ব থেকে আল আকসা মসজিদকে মুক্ত করার বাসনা পোষণ করলেও মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের দ্বিমুখী নীতির কারণে ইরান বিপ্লবের আগ পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান রাজনৈতিক কার্যক্রম ছিল না। ইমাম খোমেনিই প্রথম আল আকসা মুক্তির ডাক দেন। ইরানের আল কুদস বাহিনী গঠন ইসরাইলের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আল কুদসের কমান্ডার কাসেম সুলাইমানির যুদ্ধনীতি ও রাজনৈতিক স্ট্রাটেজি ইসরাইলের জন্য নতুন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইরান-ইরাক যুদ্ধে পশ্চিমাদের স্বপ্নভঙ্গের অন্যতম বীরযোদ্ধা তিনি।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
বহু বছর ধরে কাসেম সুলাইমানিকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছিল ইসরাইল। সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় হত্যা ও নাশকতায় দুঃসহ উত্তাপ ও ধুম্রজাল ছড়াচ্ছে ইসরাইল। তবে ইসরাইলী বাহিনীর অজেয় ভাবমর্যাদা এখন আর ধোপে টিকছে না। ইঙ্গ-মার্কিন সমর্থন ও বেপরোয়া পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল না। মূলত কোনো যুদ্ধেই টিকতে পারতো না ইসরাইল। পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে খোদ মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো সামরিক জোটই যখন পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করতে শুরু করেছে তখন সেটেলাইট স্টেট ইসরাইল বাহিনী অজেয় থাকার আর কোনো কারণ নেই।
সম্প্রতি কাতারের মধ্যস্থতায় হামাসের সাথে একটি সমঝোতা চুক্তিতে উপনীত হয়েছে ইসরাইল। ইসরাইলের অভ্যন্তরে রকেট হামলা বন্ধের শর্তে গাজা উপকূলে ১৫ নটিক্যাল মাইল এলাকায় ফিলিস্তিনী জেলেদের মাছ ধরতে বাঁধা না দেয়া এবং আক্রমণ না করার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে ইসরাইল। এতে প্রমাণিত হচ্ছে, ইসরাইলে হামাসের আক্রমণের সক্ষমতা ফিলিস্তিনের অধিকার আদায়ের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। আর মুসলমানরা সত্যিকার অর্থে ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে ফিলিস্তিন ও আল আকসার মুক্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র।
মধ্যপ্রাচ্যে জাতিগত বিভক্তি, গোষ্ঠিগত স্বার্থপরতার দ্বন্দ্বের পেছনে জায়নবাদি এজেন্ডায় পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ইন্ধন মূল ভূমিকা পালন করেছে। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমারা নিজেদের মধ্যকার সব মতভেদ ভুলে এক হতে পারলেও মুসলমানরা কখনো এক হতে পারেনি। অথচ রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকাই ছিল খুব সহজ ও স্বাভাবিক ব্যাপার। যুদ্ধের শুরুতেই প্রথম মহাযুদ্ধের ফলাফল অনেকটাই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।
বিশেষত সেই বিশেষ সময়ে উসমানীয় খেলাফতের পতন নিশ্চিত মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতালোভী গোষ্ঠিগুলোই মূল ভূমিকা পালন করেছিল। আর সেই ফলাফল সামনে রেখে বৃটিশ-ফরাসি ও ইতালীয় শাসকরা যুদ্ধোত্তর সময়ে বিভক্ত মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণে নিজেদের মধ্যকার ভাগাভাগি লিখিতভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছিল ১৯১৫ সালে সাইক্স-পাইকট চুক্তির মাধ্যমে। আজকের সিরিয়া এবং লিবিয়ার বাস্তবতা থেকে বুঝে নেয়া যায়, শত বছর পেরিয়ে এসেও সাইক্স-পাইকটের চুক্তি অনুসারেই মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। তবে ইতিমধ্যে বিশ্বের এক নম্বর রাজনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অনেক আগেই নিশ্চিত হওয়ায় জায়নবাদীরা নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এখন মার্কিনীদের কাঁধে সওয়ার হয়েছে। সাইক্স-পাইকট চুক্তির মেয়াদ শত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে জেরুজালেম কেন্দ্রিক ফিলিস্তিন ও মুসলিম বিরোধী আরেকটি ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়ায় তথাকথিত ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।
মূলত ফিলিস্তিন ও জেরুজালেমের মুক্তির প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান শাসকদের বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করাই এ চুক্তির মূল লক্ষ্য। এই ডিল হঠাৎ করেই জরুরি হয়ে পড়েনি। এর নীলনকশাও হঠাৎ করে হয়নি। মূলত: সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক বলয়ের পতনের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বকে জায়নবাদি সাম্রাজ্যবাদের মূল টার্গেটে পরিনত করা হয়। ইরাক, আফগানিস্তান, মিশর, সিরিয়া, লিবিয়া, ইরানসহ মুসলিম বিশ্বে নানা রকম সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি আইএস, বিদ্রোহী গ্রুপ ও মার্সেনারি বাহিনীর তৎপরতা সেই পরিকল্পনারই অংশ। ইরাকযুদ্ধসহ মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রতিটি যুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর পেছনে শত শত কোটি ডলার খরচ করে আসছে। সম্প্রতি বৃটিশ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম প্রতিষ্ঠানের এক অনুসন্ধানে ইরাক যুদ্ধে আল কায়েদার কর্মকান্ড সম্পর্কে মিথ্যা ভিডিও বানিয়ে প্রচারের তথ্য উঠে আসে। এ কাজে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা এবং বৃটিশ পাবলিক রিলেশন প্রতিষ্ঠান বেল পটিঙ্গার নাম উঠে এসেছে।
এবার এমন এক সময়ে আল কুদস ও নাকবা দিবস পালিত হচ্ছে, যখন বিশ্বব্যবস্থা এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখী। করোনাভাইরাস অতিমারিতে বিশ্বের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। পরাক্রমশালী রাষ্ট্রগুলো প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারছে না। এহেন বাস্তবতায়ও ইঙ্গ-মার্কিন জায়নবাদি চক্র বিশ্বের মুসলমানদের শোষণের নতুন মহাপরিকল্পনা নিয়ে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সাইক্স-পাইকটের গোপণ চুক্তির একশ’ বছর পেরিয়ে এসে মার্কিন নেতৃত্বে যে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির কথা বলা হচ্ছে, সেখানে মূল কুশীলব হিসেবে আবির্র্ভূত হয়েছে জিসিসিভুক্ত আরব দেশগুলো। পেট্টোডলারে সমৃদ্ধ আরব দেশগুলোর রাজারা এতদিন গোপণে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখলেও এখন ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে ফিলিস্তিনের মুক্তি যখন একটি অনিবার্য পরিনতি লাভ করতে চলেছে ঠিক তখন তারা মার্কিনীদের মধ্যস্থতায় প্রকাশ্যে ইসরাইলের সাথে সর্ম্পকোন্নয়নে অগ্রসর হচ্ছে। ফিলিস্তিনের ভূমিতে দখলবাজি ও আগ্রাসন, বিমান হামলার ধ্বংসযজ্ঞ- গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেক যখন সোচ্চার, তখন জায়নবাদিদের কাছে আরবদের শর্তহীন আত্মসমর্পণ বিশ্বের সামনে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। মার্কিন নেতৃত্বে যে দল বা ব্যক্তিই থাকুন সেখানে আরব-ইসরাইল প্রশ্নে বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
এ সপ্তাহে জো বাইডেনের সাথে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ প্রধানের একটি গোপন বৈঠকের সংবাদ গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। ইসরাইল ইরানের সাথে পরমাণু সমঝোতায় না পৌঁছতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিচ্ছে। ইতিমধ্যে যুদ্ধের হুমকিও দিয়েছে। ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ইসরাইল পশ্চিমাদের সমর্থন নিয়ে সত্তুর বছর ধরে আরব দেশগুলোর উপর ঔদ্ধ্যত্বপূর্ণ আগ্রাসন চালিয়ে আসছে। তাদের ভান্ডারে শত শত পরমাণু বোমা থাকলেও ইসরাইলকে তার কোনো জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে না। অন্যদিকে নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারি ইরান আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার তীক্ষ্ন নজরদারির মধ্যে থেকেও ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত হুমকি, নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের শিকার হচ্ছে। যদিও তাদের এসব নির্বতনমূলক তৎপরতা ইরানের অগ্রযাত্রা বা ফিলিস্তিনের মুক্তির সংগ্রামকে দমাতে পারেনি।
বিশ্বের একনম্বর অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ইতিমধ্যেই নড়বড়ে হয়ে গেছে। ইউরোপ-আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডার অন্যতম কেন্দ্রিয় বিষয় হচ্ছে, ইসরাইল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, ফিলিস্তিনীদের দমন এবং মুসলমানদের বিভাজন। ইতিমধ্যে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক মেরুকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ এবং চীন, রাশিয়া, তুরষ্ক, ইরান ও পাকিস্তানের অংশগ্রহণে এই জোটকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা এখন কারো নেই। সাংহাই কো-অপারেশনসহ নতুন এই বিশ্ব শক্তিকে এখন ফিলিস্তিনের মুক্তির স্বপক্ষে শক্ত ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। এবারের আল কুদস ও নাকবা দিবসে বিশ্বের কাছে এমন একটি নতুন বার্তা প্রত্যাশা করছে শান্তিকামী বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষ।
লেখক: আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক। bari_zamal@yahoo.com
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ