।। মুনির আহমদ ।।
মহান রাব্বুল আলামীন যাঁকে কেন্দ্র করে এ বিশ্ব জাহান সৃজন করেছেন, তিনি হলেন আমাদের সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)। ‘আ-মুল ফীল’ অর্থাৎ- হস্তি বাহিনী নিয়ে আবরাহা কর্তৃক কা’বা অভিযানের ঘটনা যে বছর ঘটে, সেই বছর (৫৭০ খ্রীস্টাব্দ) রবীউল আউয়াল মাসের বহুল প্রচলিত মতানুযায়ী দ্বাদশ রজনী (নির্ভরযোগ্য ও সঠিক তথ্যমতে ৯ম রজনী) অতিক্রান্ত হবার শুভমুহর্তে সোমবার আরবের মক্কা নগরীতে কুরাইশ বংশে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ্, মাতার নাম আমিনা।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রতিশ্রুত নবীঃ মুহাম্মদ (সা.) কোন আকস্মিক বা গতানুগতিক নবী ছিলেন না, বরং তিনি একজন পূর্বপ্রসিদ্ধ নবী। তাঁর শুভাগমনের শত শত বৎসর পূর্বে হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.) তাওহীদের প্রতীক ও প্রাণকেন্দ্র কা’বাগৃহ পুনঃনির্মাণ কালে এই দোয়া করেছিলেন- “হে আমার পালনকর্তা! তাদের মধ্য থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গাম্বর প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াতসমহ তিলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় আপনিই পরাক্রমশালী হিকমত ওয়ালা”। (সূরা বাক্বারা- ১২৯)।
আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন, “স্মরণ কর, যখন মরিয়ম তনয় ঈসা (আ.) বলল- হে বনী ইসরাঈল। আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, আমার পূর্ববর্তী তাওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন। তাঁর নাম আহমদ”। (বিশ্বনবীর একটি প্রসিদ্ধ নাম)। (সূরা সাফ- ৬)।
তাঁর জন্মের পূর্বাভাষঃ রাসূল (সা.)এর মাতা আমিনা বিনতে ওয়াহ্হাব বলতেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) গর্ভে আসার পর তাঁর কাছে কোন এক অপরিচিত আগন্তুক আসেন এবং তাঁকে বলেন তুমি যাঁকে গর্ভে ধারণ করেছ, তিনি এ যুগের মানব জাতির মহানায়ক। তিনি যখন ভূমিষ্ঠ হবেন, তখন তুমি বলবে সকল হিংসুকের অনিষ্ট থেকে এ শিশুকে এক ও অদ্বিতীয় প্রভুর আশ্রয়ে সমর্পন করছি। অতঃপর তাঁর নাম রাখবে মুহাম্মদ। তিনি গর্ভে থাকা কালে আমিনা স্বপ্নে দেখেন তার ভিতর থেকে এমন এটা আলোক রশ্মি বেরুলো যদ্বারা তিনি সিরিয়া ভূখণ্ডের বসরার প্রাসাদসমহ দেখতে পেলেন। (ইব্নে হিশাম-৩৯)।
দুধ পানঃ জন্মের পর আরবের তৎকালীন প্রথানুযায়ী শিশু মুহাম্মদকে লালন-পালনের নিমিত্তে ধাত্রী হালীমার গৃহে প্রেরণ করা হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর্যন্তধাত্রী হালিমা তাঁকে পরম স্নেহে প্রতিপালন করেন।
বাল্যকালঃ ছয় বছর বয়সে মহানবী (সা.) মা-আমিনার কাছে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রতিবেশী বালকেরা তাঁকে জোর করে খেলার মাঠে নিয়ে যায় খেলতে। তিনি মাঠের এক কোণে বসে বসে শুধু ভাবেন, এ পৃথিবী কে সৃষ্টি করলেন, কেন সৃষ্টি করলেন। আমরা কোথা হতে এসেছি, কোথায় যাব। এ পৃথিবীটা খেলার জায়গা নয়। যখন বিকেল হয় সূর্য পশ্চিমাকাশে অস্ত যায় তখন অন্যান্য সব ছেলেদের পিতারা এসে তাদেরকে কোলে তুলে বাড়ী নিয়ে যায়। কিন্তু বালক মুহাম্মদ (সা.) একা একা ঘরে ফেরেন।
এভাবে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হল। একদিন হঠাৎ বালক মুহাম্মদ মায়ের আঁচল ধরে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগলেন, মাগো! খেলা শেষে সব ছেলেদের পিতারা এসে তাদেরকে কোলে তুলে নিয়ে যায়, আমি একা পড়ে থাকি, আমাকে নিতে কেউ আসেনা। বলো মা, আমার বাবা কোথায়? মা-আমিনা চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারছেন না। স্বামী বিয়োগের পুরোনো শোকে জর্জরিত। এদিকে বালক মুহাম্মদকে কি বলে সান্ত¡না দিবেন তিনি। কিছু দিন পর মা-আমিনা দাসী উম্মে আইমান ও বালক মুহাম্মদকে নিয়ে তাঁর মাতুলালয় মদীনা গমন করেন। সেখানে মহানবী (সা.)এর পিতা আব্দুল্লাহ্ সিরিয়া থেকে ফেরার পথে যে বাড়ীতে এসে আশ্রয় নিয়ে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন এবং যেখানে তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিল সে বাড়ী ও কবর তাঁকে দেখানো হয়। তা দেখে মা ও ছেলে উভয়েই অভিভূত হন এবং গভীর শোক ও ব্যাকুল কান্নায় ভেংগে পড়েন।
এরপর মদীনা থেকে মক্কায় ফেরার পথে আল্ আবরা নামক স্থানে পৌঁছে শোকাভিভূতা মা-আমিনা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বালক মুহাম্মদকে চিরতরে এতীম বানিয়ে সেখানেই তিনি ইন্তিকাল করেন। মা-আমিনাকে কবরস্থ করে দাসী উম্মে আইমান বালক মুহাম্মদকে নিয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর দাদা আব্দুল মুত্তালিব বালক মুহাম্মদের লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দু’বছর পর দাদা আব্দুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর চাচা আবু তালিব তাঁর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বার বছর বয়সে তিনি চাচা আবু তালিবের সাথে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়ায় গমন করেন।
হিলফুল ফুযুল সংগঠনঃ রাসূলুল্লাহ (সা.)এর বয়স মাত্র পনের বছর। এদিকে গোটা আরব দেশ ছিল জাহিলিয়্যাতের ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত, মানবতা ছিল সেখানে ভূলুণ্ঠিত, নানারূপ অন্যায় যুলুম-নির্যাতন, পাপ-পঙ্কিলতা, অনাচার-কুসংস্কারে সমাজ ছিল দুর্দশাগ্রস্ত। যুদ্ধ একবার লেগে গেলে বংশ পরম্পরায় তা অব্যাহত থাকত বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। এ অবস্থা দেখে কিশোর মুহাম্মদ (সা.) চাচা আবু তালিবের সাথে পরামর্শ করে কতিপয় সাহসী যুবককে সংগে নিয়ে “হিলফুল ফুযুল” নামে একটি সংগঠন কায়েম করে এর মাধ্যমে তিনি ধীরে ধীরে আরবের যুদ্ধরত বিভিন্ন গোত্রকে একত্র করে তাদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করেন। এভাবে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান করে সমাজে শান্তি শৃংখলা ফিরিয়ে আনেন। উক্ত সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল নিুরূপ-
১। দেশ থেকে যাবতীয় অশান্তি দূরীভূত করা, ২। পথিকের জান-মালের হিফাযত করা, ৩। গরীব-অসহায় ও দুঃস্থদের সাহায্য করা, ৪। বিধবা ও এতীমদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করে দেওয়া, ৫। কোন যালিমকে মক্কায় আশ্রয় না দেওয়া প্রভৃতি।
এভাবে তিনি সমাজে অন্যায়, অশান্তি, অবিচার ও যুলুম-নির্যাতন দূর করার জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করেন এবং সকল কাজে বিশ্বস্ততার পরিচয় দান করেন। যার ফলে আরবের লোকেরা তাঁকে ‘আল্ আমীন’ উপাধিতে ভূষিত করে।
হযরত খাদিজাতুল কুবরার সঙ্গে বিবাহঃ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর অনেক অলৌকিক ঘটনা এবং অসাধারণ প্রতিভা ও গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়ে হযরত খাদিজা লোক পাঠিয়ে তাঁকে জানালেন- স্বগোত্রে তাঁর যে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান, বিশ্বস্ততা, চরিত্র মাধুর্যতা ও সত্যবাদিতার সুনাম তাতে তিনি মুগ্ধ ও অভিভূত। এবং তিনি বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। কুরাইশদের মধ্যে হযরত খাদিজা ছিলেন চল্লিশ বছর বয়স্কা সর্বাপেক্ষা অভিজাত বংশীয়া সর্বোচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সম্ভ্রান্ত এবং অতিশয় ধনাঢ্য বিধবা মহিলা। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) খাদিজার এ প্রস্তাব চাচাদেরকে অবহিত করেন। অতঃপর সবার সম্মতিক্রমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ সম্পন্ন হল। এসময় মুহাম্মদ (সা.)এর বয়স ছিল পঁচিশ বছর। হযরত খাদিজাতুল কুবরাই তাঁর প্রথম স্ত্রী এবং তাঁর জীবদ্দশায় তিনি আর কোন বিয়ে করেননি।
নবুওয়্যাত লাভঃ মুহাম্মদ (সা.)এর বয়স যখন চল্লিশ বছর, পবিত্র রমযান মাসের এক শুভ রাত্রে মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত হেরা গুহায় মানব জাতির একমাত্র মুক্তির সনদ আসমানী বাণী কুরআনুল কারীম নাযিলের সূত্রপাত হয়- “ইক্বরা’ বিসমি রাব্বিকাল্লাযী খালাক্ব” (অর্থাৎ পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন) আয়াত নাযিলের মাধ্যমে। এ জন্যই ইসলাম ধর্মে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। হুযূর (সা.) বলেছেন- ইসলামী জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরয।
দাওয়াতী তৎপরতা ও তায়েফ গমনঃ
মহানবী (সা.) এমন এক সময় পৃথিবীর এমন একটি স্থানে তাশরীফ আনলেন যেখানকার লোকেরা সর্বদা হানাহানি, লুণ্ঠন, ব্যভিচার, মূর্তিপূজা, মদ্যপান এমনকি নিজ কন্যা সন্তানকে পর্যন্ত কবর দেওয়ার মত জঘন্য পাপে লিপ্ত থাকত। মোটকথা তারা বর্বরতার শেষপ্রান্তে গিয়ে উপনীত হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাদের মধ্যে দ্বীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন। কিন্তু কখনো পিছপা হননি। তাঁর সে নির্যাতন ভোগ তথা ত্যাগের কথা জগতবাসী কোনদিন ভুলতে পারবে না। তাঁর সে মহান আদর্শের সামান্যতমও যদি আজকের দুনিয়ার মানুষ অনুসরণ করে তবে পৃথিবীতে আর কোন অশান্তি থাকবে না।
দাওয়াতের প্রথম পর্যায়ে আল্লাহর নির্দেশে তিনি নিজ পরিবার পরিজন ও নিকট আত্মীয়দের ইসলামের দাওয়াত দিলেন। গুটি কয়েক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলেন। কিন্তু নির্যাতন বাড়তেই থাকল। মনে বড় আশা নিয়ে যায়েদ বিন হারেসাসহ তায়েফ গমন করলেন এবং ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তারা ইসলাম গ্রহণ তো দূরের কথা বরং তাঁকে জঘন্য ভাষায় তিরস্কার করল। ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেই শুধু ক্ষান্ত হয়নি, বরং বখাটে ছেলেদের তাঁর পিছনে লেলিয়ে দিয়ে নির্দেশ দিল তাঁকে পাথর মারতে ও ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে উক্ত্যক্ত করতে।
এ বর্বরের দলেরা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)কে এত অধিক পাথর বর্ষণ করল যে, তিনি রক্তাক্ত হয়ে গেলেন। আঘাতের জ্বালায় যখন তিনি অস্থির হয়ে বসে পড়তেন তখন তারা তাঁর বাহুদ্বয় ধরে আবার দাঁড় করিয়ে দিত, যাতে তারা আবার পাথর বর্ষণ করতে পারে। এই অকথ্য নির্যাতন ভোগ করার পরও রাহ্মাতুল্ লিল আলামীন দয়ার সাগর উম্মতের কাণ্ডারী নবী মুহাম্মদ (সা.) তাদেরকে বদ দোয়া করেন নি বরং এ বলে দোয়া করতে লাগলেন, হে আল্লাহ্! স্বীয় দুর্বলতা হেতু দ্বীনের দিকে মানুষকে আহ্বান করার উপযুক্ত কৌশল গ্রহণ করতে অপারগতা ও মানুষকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করতে অক্ষমতার স্বীয় দোষ স্বীকার করছি। হে পরম দয়ালু! আপনি তো দুর্বলের অভিভাবক ও সাহায্যকারী। আমাকে আপনি কার কাছে অর্পণ করেছেন।
এমন নির্দয় ও নির্মম প্রাণসংহারক শত্রুর কাছে, না নিকটতম কোন বন্ধুর কাছে, যাকে আপনি আমার ব্যাপারে দায়িত্ব দিয়েছেন। যদি আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট না থাকেন তাহলে আমি কাউকে পরোয়া করিনা। তবে আপনার নিরাপত্তা আমার চলার পথ সহজ ও প্রশস্ত করবে। আমি আপনার সত্তার নরের আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যা সকল অন্ধকার আলোকিত করছে আর যার দ্বারা ইহকাল ও পরকালের সমস্ত কার্য সম্পাদিত হচ্ছে এবং এমন কিছু থেকেও রেহাই চাচ্ছি যার কারণে আমি আপনার ক্রোধ ও অসন্তুষ্টিতে নিপতিত হই। মুখ্য উদ্দেশ্য হল, আপনাকে খুশী করে আপনার সন্তুষ্টি অর্জন করা, আপনার সাহায্য ব্যতীত কোন গুনাহ্ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আবার কোন ইবাদতে লিপ্ত হওয়াও সম্ভব নয়।
চরিত্র ও আকৃতিঃ হযরত মুহাম্মদ (সা.) অধিক লম্বাও ছিলেন না, আবার খুব বেঁটেও ছিলেন না। বরং তিনি উচ্চতায় ছিলেন মধ্যমাকৃতি বিশিষ্ট। তাঁর চুল অত্যধিক কুঞ্চিত ছিলনা আবার একেবারে অকুঞ্চিতও ছিল না। বরং তা ছিল কিঞ্চিৎ কোঁকড়ানো। তিনি খুব বেশী স্থূল বা মোটা দেহের অধিকারী ছিলেন না। তাঁর মুখমণ্ডল একেবারে গোলাকার ও ক্ষুদ্র ছিল না।
চোখ দুটো ছিল কালো, লম্বা ভ্রুযুগল, গ্রন্থির হাঁড়গুলো ও দুই স্কন্ধের মধ্যবর্তী হাঁড়টি ছিল বেশ উঁচু ও সুস্পষ্ট। বক্ষ থেকে নাভি পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল ছিল হালকা লোমে আবৃত। হাত ও পায়ের পাতা ছিল পুষ্ট, চলার সময় পা দাবিয়ে দিতেন না। মনে হতো যেন কোন নিু ভূমিতে নামছেন। কোন দিকে ফিরে তাকালে গোটা শরীর নিয়ে ফিরতেন। তাঁর দুই স্কন্ধের মাঝখানে নবুওয়্যাতের সীল বা মোহর ছিল লক্ষণীয়।
বস্তুতঃ তিনি ছিলেন শেষ নবী। শ্রেষ্ঠ দানশীল, শ্রেষ্ঠতম সাহসী, অতুলনীয় সত্যবাদী, সবচেয়ে দায়িত্ব জ্ঞান সম্পন্ন, সবচেয়ে অমায়িক ও মিশুক। প্রথম নযরে তাঁকে দেখে সবাই ঘাবড়ে যেত। তাঁর প্রশংসাকারী আলী (রাযি.) বলেন, তাঁর মত মানুষ তাঁর আগেও দেখিনি পরেও দেখিনি। (সীরাতে ইব্নে হিশাম- ৫৩ পৃষ্ঠা)।
মি’রাজঃ বিশ্বনবী (সা.)এর নবুওয়্যাতের দ্বাদশ বছর ২৭ রজব রাতে তাঁর জীবনে সর্বাধিক বিস্ময়কর এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে। এ জাতীয় ঘটনা অন্য কোন নবীর জীবনে ঘটেনি, সেটি হল মি’রাজ। মি’রাজ অর্থ ঊর্ধ্বে আরোহন। রাসূল (সা.) তাঁর মহাকাশ ভ্রমণ সম্পর্কে এ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এজন্য এ ভ্রমণকে মি’রাজ বলা হয়। মি’রাজের অপর নাম ইস্রা বা রাতের কিছু অংশে ভ্রমণ। সূরা বনি ইসরাঈলে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
বিশ্বনবী (সা.)এর মু’জিযাঃ দুনিয়াতে যত নবীর আগমন ঘটেছে তাঁদের জীবনের শুরু থেকেই অসাধারণ কিছু নিদর্শনাবলী লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বনবী (সা.)এর জীবনেও অসংখ্য এমন ঘটনা ঘটেছিল যাকে মু’জিযা নামে অভিহিত করা হয়। ইসলামের পরিভাষায় মু’জিযা হচ্ছে চূড়ান্ত প্রমাণ। আঙ্গুলের ইশারায় চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়া, শীর্ণ বকরিতে দুধ পাওয়া, ঘোড়ার গতি রহিত হওয়া, মি’রাজ ইত্যাদি তাঁর অসংখ্য মু’জিযার কয়েকটি উদাহরণ। তাঁর সবচেয়ে বড় মু’জিযা হচ্ছে কুরআনুল কারীম।
হিজরতঃ সংখ্যালঘু মুসলমানদেরকে আরবের কাফির গোষ্ঠী অসহনীয় নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষতে আরম্ভ করলে আল্লাহর নবী বললেন, আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের জন্য একটি নিরাপদ আবাস ভূমি ও কিছু সংখ্যক ভাই সংগ্রহ করে দিয়েছেন। এই ঘোষণার পর মুসলমানগণ দলে দলে হিজরত করতে শুরু করেন বিভিন্ন দিকে। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) নিজে মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় হিজরতের জন্য আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় মক্কায় অবস্থান করতে লাগলেন।
কিছু দিন পর তিনি হিজরতের অনুমতি পেয়ে কাফিরদের সকল ষড়যš ছিন্ন করে আবু বকর (রাযি.)কে সংগে নিয়ে মদীনার উপকণ্ঠে পৌঁছলে মদীনার সর্বস্তরের জনতা তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য রাস্তার দু’ধারে সারি বদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন। মদীনার ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো পর্যন্ত রাসূল (সা.)এর শুভাগমনে আনন্দে বিভোর হয়ে গেল এবং তারা সমবেত কণ্ঠে গাইতে আরম্ভ করল-
“তালাআল বাদরু আলাইনা
মিন সানিয়াতিল বিদায়ী
ওয়াজাবাশ্ শুকরু আলাইনা
মানদাআ লিল্লাহি দায়ী।”
তারপর তিনি কোথায় অবস্থান করবেন, সবার আগ্রহ নিজের ঘরে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে মেহমান হিসেবে গ্রহণ করবেন। কিন্তু আল্লাহর নবী উটের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিলেন। উট আল্লাহর হুকুমে আবু আইউব আনসারী (রাযি.)এর ঘরের সামনে বসে গেলে আল্লাহর নবী সেখানেই অবস্থান করলেন এবং প্রথমেই তিনি মসজিদ নির্মাণের কাজে হাত দিলেন।
রাষ্ট্র গঠনঃ মহানবী (সা.)এর হিজরতের পর মদীনা ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রে পরিণত হয়। মহানবী (সা.) সেখানে নবী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধান সেনাপতি এবং প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন।
ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে মহানবী (সা.) যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিুরূপঃ ১। ইসলামের ভিত্তিতে মুসলমানদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও নৈতিক জীবন পরিশুদ্ধ ও পরিগঠন ২। তৎকালীন মদীনায় বসবাসকারী ইহদী-খ্রীস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য পারস্পরিক আলোচনা, সম্মতিতে চুক্তি স্বাক্ষর, ৩। দেশে-বিদেশে সর্বত্র আল্লাহর দ্বীন প্রচারের জন্য ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ, ৪। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মলভিত্তি প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সমাজ কল্যাণ, দেশ রক্ষা ও নিরাপত্তা, পররাষ্ট্র ও বৈদেশিক সম্পর্ক ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) ইসলামের আদর্শের ভিত্তিতে এক সর্বোত্তম ও সমগ্র মানব জাতির জন্য এক অনুসরণীয় আদর্শ স্থাপন করেন।
মক্কা বিজয়ঃ হুযর (সা.)এর জীবনে মক্কা বিজয় একটি অবস্মরণীয় ঘটনা। ৮ম হিজরীর ২০ রমযান মুতাবেক জানুয়ারী ৬৩০ ঈসায়ী সাল বৃহস্পতি বার সূচিত হয় ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়। রাসূল (সা.) এ বলে মুসলিম অধিনায়কগণের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়ে ছিলেন যে, হামলা না চালানো হলে কারো সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে না। কা’বার দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিলেন এবং মর্তিগুলো ভাঙ্গার নির্দেশ দিলেন। ভাঙ্গা শেষ হলে রাসূল (সা.) বিলাল (রাযি.)কে সংগে নিয়ে কা’বার ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং বিলাল (রাযি.)কে আযান দিতে নির্দেশ দিলেন।
বিদায় হজ্বঃ হিজরতের দশম বৎসর ৯ জিলহজ্ব শুক্রবার মুতাবেক ৯ মার্চ ৬৩১ ঈসায়ী তারিখে প্রিয় নবী (সা.) বিদায় হজ্ব সম্পন্ন করেন। এ হজ্বেই ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে প্রিয় নবী (সা.) লক্ষাধিক সাহাবায়ে কিরাম (রাযি.)এর উপস্থিতিতে এক সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন। ইতিহাসে যা বিদায় হজ্বের ভাষণ নামে প্রসিদ্ধ। এ ভাষণে নবী (সা.) গোটা মুসলিম সমাজের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেন। যা বাস্তবায়নের জন্য তিনি সারাটি জীবন কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন।
ইন্তিকালঃ ১১ হিজরী ১২ রবীউল আউয়াল সোমবার মুতাবেক ৬৩২ ঈসায়ী সালে রহমতে দো’আলম (সা.) উম্মতকে এতীম করে ইহজগত ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না…।
তিনি শেষ নবীঃ পবিত্র কুরআনে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে খাতামুন নাবিয়্যীন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। খাতাম শব্দের অর্থ সমাপ্তি ও সীলমোহর। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, আমি শেষ নবী, আমার পর আর কোন নবী আসবেন না। তাই খত্মে নবুওয়্যাতের আক্বীদা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যারা রাসূলুল্লাহ (সা.)কে শেষ নবী মানে না, তারা নিঃসন্দেহে কাফির। সমগ্র বিশ্বের মুসলমান এতে ঐক্যমত পোষণ করেন। আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের তাঁর নবীর মত ও পথ অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন। #