উজবেকিস্তান ট্রান্সসোয়ানার অন্যতম দেশ। রাজধানী বোখারা ও সমরকন্দ। পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের নগর হিসেবে পরিচিত উজবেকিস্তানের বোখারা নগর। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতাব্দীতে নির্মিত মধ্যএশিয়ার সমৃদ্ধ এই নগর অর্থনীতি ও বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত।
ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি ও শিক্ষা-গবেষণার প্রাণকেন্দ্র হিসেবেও পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত বোখারা নগরী। হাদিসশাস্ত্রের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও পরিচিত গ্রন্থ ‘সহিহুল বুখারি’র রচয়িতা ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসমাইল (রহ.), আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনা, বিখ্যাত সুফি বাহাউদ্দিন নকশবন্দি (রহ.)-সহ অগণিত আলেম, বিজ্ঞানী ও গবেষকের পদচারণে মুখরিত ছিল বোখারা।
প্রতিবছর বোখারায় প্রায় এক কোটি পর্যটকের আগমন ঘটে। বোখারার কালয়ান মসজিদের মিনার মধ্য এশিয়ার সর্বোচ্চ মিনার হিসেবে স্বীকৃত। কানাখানিক সম্রাট মুহাম্মাদ আরসালান খানের নির্মিত এই মসজিদের পাশে আছে বিখ্যাত ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র মিরে আরব মাদরাসা।
খলিফা মুয়াবিয়া বিন আবি সুফিয়ান (রা.)-এর নিযুক্ত খোরাসানের গভর্নর ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের মাধ্যমে বোখারায় প্রথম মুসলিম সেনা অভিযান প্রেরিত হয়। ৫৪ হিজরিতে ২৫ বছর বয়সে তিনি ২৪ হাজার সৈন্য নিয়ে বোখারার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হন। সে সময় বোখারার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন খাতুন নামের এক বিধবা নারী। তুর্কিদের সহযোগিতায় খাতুন মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে তীব্র লড়াই শুরু করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক লাখ দিরহামের বিনিময়ে সন্ধি স্থাপন করেন।
খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিকের শাসনকালে খোরাসান-বোখারায় ইসলামী শাসনব্যবস্থা সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯০ হিজরিতে কুতায়বা বিন মুসলিম আল বাহিলির নেতৃত্বে তৎকালীন শাসক ওয়ারদান খাদাহর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধের পর বিজয়ী হয় মুসলিম বাহিনী এবং সেখানে তাগশাদাহকে গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ৯৪ হিজরিতে শহরের প্রাচীরের ভেতর সেনাপতি কুতাইবা একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
নানা সময় বোখারা নগরী ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। ৬১৬ হিজরি ১২২০ সালে চেঙ্গিস খান বোখারা নগরীতে ব্যাপক হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি ছিল একটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। এ সময় বোখারার অনেক পুরনো প্রাসাদ ও প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস হয়। ষষ্ঠদশ শতাব্দী থেকে উজবেক ও রুশ সম্রাটদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। ওই সময় বোখারা নগরী রাশিয়া ও ইউরোপে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। তখনকার সময় রুশদের কাছে মধ্য এশিয়ার সব ব্যবসায়ী বোখারা নগরীর অধিবাসী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
খান আবদুল আজিজের শাসনকাল উজবেক সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৭৪০ সালে বোখারার শাসনভার গ্রহণ করেন নাদির শাহ সাফাবি। এরপর বোখারার খান (সম্রাট) হিসেবে মুহাম্মাদ রহিম দাবি করেন। তাঁর সময়ে বোখারা পুনরায় ইসলাম ও মুসলিমদের প্রধান অঞ্চলে পরিণত হয়।
১৮৬০ সাল থেকে তুর্কিস্তানে মুজাফফর উদ্দিন শাহের শাসনকালে রুশ শক্তির প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে বোখারার অনেক নগর রুশদের হাতে পতন ঘটে। তখনো বোখারা দখল না হলে মুজাফফর উদ্দিন রুশ শাসনাধীন রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। ১৮৮৫ সালে আমির আবদুল আহাদ খানের শাসনকালে রুশ সেনারা নতুন করে বোখারা গঠন করে। বোখারা অঞ্চলে রাশিয়া নিজের সদর দপ্তর স্থাপন করে। এরপর রুশদের বোখারা শাসন শুরু হয়।
১৯১৮ সালে মোঙ্গলদের মতো রুশ সেনারা বোখারা নগরীতে তাণ্ডবলীলা চালায়। ২৪ মার্চ ১৯১৯ কমিউনিস্টের হাতে বোখারার পতন চূড়ান্ত হয়ে যায় এবং ১৯ আগস্ট ১৯২০ তারা সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। বোখারার ইলম চর্চা আবারও বন্ধ হয় ১৯২০ সালে। আলিম খান বিন আবদুল আহাদের শাসনকালে রুশরা বোখারা ইমারাহ রহিত করে বোখারা প্রজাতন্ত্র চালু করে। ১৯২৪ সালে বোখারা প্রজাতন্ত্র তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান নামে কয়েকটি দেশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর বোখারা নগরী উজবেকিস্তানের রাজধানী হিসেবে বহাল থাকে। রাশিয়ার কমিউনিস্টদের আগ্রাসনের শিকার হয়ে ৭০ বছর পর্যন্ত থাকে। অবশেষে ১৯৯১ সালে উজবেকিস্তানের রাজধানী হিসেবে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে।
পারস্য, মোগল ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আক্রমণের সম্মুখীন হলেও প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনে এখনো বোখারা অনন্য হয়ে আছে। ১৯৯৭ সালে বোখারা নগরী প্রতিষ্ঠার দুই হাজার ৫০০ বছর পূর্তিতে এখানে ৭০০-এরও বেশি ঐতিহাসিক নিদর্শন বিদ্যমান। তাই ইউনেসকো ১৯৯৩ সালে একে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যের নগরী বলে স্বীকৃতি প্রদান করে।
উম্মাহ২৪ডটকম: আইএএ