আমাদের কাছে আধুনিক নার্সিং বা রোগীসেবার জনক ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল। ১৮৫০ সালে ক্রাইমিয়ারযুদ্ধে ফ্লোরেন্স আহত সৈন্যদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। মানবসেবার ইতিহাসে তিনি অমর। কিন্তু, অনেকেই জানেনা যে ফ্লোরেন্সের প্রায় ১২০০ বছর আগে মদিনার আনসার রমণীদের মধ্যে একজন মানব সেবায় আত্মনিয়োগ করে ইসলামী ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তাঁর নাম, বিখ্যাত রমণী সাহাবি রুফাইদা আল আসলামিয়া (রাঃ)। তিনি আমাদের প্রিয় নবী রাসুল(সাঃ)-এর যুদ্ধে আর্ত ও আহতদের সেবিকা হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের তাঁবুতে তিনি তৈরি করেন ‘খিমাতু রুফাইদা’ বা রুফাইদায় সেবাক্ষেত্র নামক অস্থায়ী চিকিৎসাকেন্দ্র।
রুফাইদা আল আসলামিয়া-র শৈশব ও শিক্ষা
বনু খাজরায আসলাম গোষ্ঠীতে ৬২০ অব্দে রুফাইদার জন্ম হয়। তাঁর পিতা সাদ আল আসলামি ছিলেন মদিনার একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক। ছোট থেকেই রুফাইদা তাঁর আব্বাকে সাহায্য করতেন নানা বিষয়ে। বলা যায়, নিজের আব্বার হাতেই তাঁর রোগ নিরাময় ও চিকিৎসাবিজ্ঞান শেখা। তিনি যেন আজন্ম জানতেন তাঁকে মানুষের সেবা করতে হবে। সেই হিসেবেই নিজেকে তৈরি করেছিলেন রুফাইদা। শুধু তাই নয়, তিনিই মদিনায় প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। আমাদের প্রিয় নবী যখন মদিনাতে পা রাখেন, রুফাইদাই অন্যতম একজন যিনি তাঁকে স্বাগত জানান।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
তাঁর কৃতিত্ব ও সেবাপরায়ণতা
রুফাইদা আল আসলামিয়া শৈশব থেকেই ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের ও ধৈয্যশীলা। তিনি অসুস্থ আর্ত ও শিশুদের কল্যাণেই নিজের দিনের বেশিরভাগ ব্যয় করতেন। ইমাম বুখারি(রঃ)-এর কিতাব ‘আদাবুল মুফুরাদ” থেকে জানা যায়, মসজিদ এ নববীর পাশে রুফাইদার চিকিৎসা কেন্দ্র তাঁবু ছিল। তিনি মদিনার অন্যান্য আনসার নারী সাহাবিকেও নার্সিং ও রোগ নিরাময়ের প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত সাহাবিরা বদর, খন্দক, খাইবার সহ নানা যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলে।
ইবনে সাদ বলেন, তিনি হিজরতের পরে বাইআত হয়েছেন। মসজিদ এ নববীর পাশেই তার তাঁবু ছিল। সেখানে তিনি অসুস্থ এবং আহতদের সেবা করতেন।(তাহযীবুত তাহযীব ২৭৯১; তবাকাতে ইবনে সা‘দ)
খাইবারের যুদ্ধের ঘটনা
খাইবারের যুদ্ধের দিন রাসুল(সাঃ) যখন যুদ্ধযাত্রার জন্য তৈরি হচ্ছেন, তখন রুফাইদা ও তাঁর নারী সাহাবিরা এসে আহত ও মুসলমানদের সাহায্য করার জন্য যুদ্ধে যেতে চান। আমাদের প্রিয় নবী অনুমতি দিলে যুদ্ধক্ষেত্রে স্থাপিত হয় খিমাতু রুফাইদা।
মাহমুদ ইবন লাবিদ থেকে জানা যায়, খন্দকের যুদ্ধে সাদ বিন মুয়াজ(রাঃ)-এর গুরুতর আঘাত লাগলে প্রিয় নবীর নির্দেশে তাঁকে খিমাতু রুফাইদাতে পাঠানো হয়। রুফাইদা ও তাঁর সাহাবিরা অত্যন্ত যত্ন সহকারে তাঁর চিকিৎসা করেন।নবী (সাঃ) রোজ সাদ (রাঃ)-এর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, তোমার দিন কেমন কাটল, তোমার রাত কেমন কাটল? তিনি তাঁকে (নিজ অবস্থা) অবহিত করতেন। (আদবুল মুফরাদ, হাদিস : ১১৩৯)
খাইবারের যুদ্ধে রুফাইদার অবদানে প্রিয় নবী অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন। তাঁর এই অবিস্মরণীয় সেবার পুরস্কার হিসেবে প্রিয় নবী পুরুষ মুজাহিদদের মতো রুফাইদা ও তাঁর সাহাবিদেরও গণিমতের অংশ প্রদান করেন।
রুফাইদা আল আসলামিয়া-র অবদান
রুফাইদা দিন রাত এক করে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছন মানবসেবায়। যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তে মৃত্যুভয়ও তাঁকে আহতর সেবা থেকে টলাতে পারেনি। পরবর্তীতে শান্তিপূর্ণ অবস্থাতেও মানুষ ছুটে আসত তাঁর কাছে। তিনি শুধু রোগ নিরাময় করতেন তা নয়, নানাবিধ সামাজিক উন্নতির কাজও করতেন। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ভাবে ইসলামের প্রতি আত্মনিমগ্ন। নিজের সম্পদ ও অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসা ও সেবা প্রদান করতেন সকল আর্ত ও অসুস্থকে। কথিত আছে, তিনি আয়িষা(রাযীঃ)-কেও রোগ নিরাময় ও সেবা করার কৌশল শিখিয়েছিলেন।
রুফাইদা(রাঃ) ইসলামী ইতিহাসে এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। তাঁর সম্মানে আগা খান বিশ্ববিদ্যালয় একটি নার্সিং কলেজ স্থাপন করেছে। শুধু তাই নয়, বাহরাইনের রয়্যাল কলেজ অফ সার্জন ইন আয়ারল্যান্ডের ছাত্র ছাত্রীদের রুফাইদা আল আসলামিইয়া পুরস্কার দেওয়া হয়। রুফাইদা জানতেন, সেবার মাধ্যমে আল্লাহ তায়লার সংস্পর্শ পাওয়া যায়। সেই পথেই তিনি হেঁটে গিয়েছেন আজীবন।
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ