গেল বছর থেকে ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েব তার বৈশ্বিক চরিত্র হারাতে থাকে। পশ্চিমা দুনিয়ার প্রাণকেন্দ্র ইউরোপ হেঁটেছে কঠোর নীতিমালা প্রণয়নের পথে। আইনভঙ্গকারী মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর উপর যেকারণে নেমে আসতে পারে নিষেধাজ্ঞার খড়গহস্ত।
আবার যুক্তরাষ্ট্র যে ধোঁয়া তুলসীপাতা ছিল- তাও বলা যাবে না। চীনের সঙ্গে প্রযুক্তি প্রতিদ্বন্দ্বীতার লড়াইয়ে জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে চীনা অ্যাপ টিকটক ও ওইচ্যাট’কে ব্যান করার কাছাকাছি চলে গিয়েছিল ট্রাম্প প্রশাসন। অবশ্য, বাইডেন প্রশাসন এই উদ্যোগটি পুনর্বিবেচনায় রেখেছে। ভারত আবার এই দুটি অ্যাপসহ আরও কয়েক ডজন চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে। এখন কৃষক আন্দোলনের সুবাদে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার চটেছে টুইটারের উপর।
সংবাদ প্রকাশ করলেই গণমাধ্যমকে রয়্যালটি দিতে হবে, অস্ট্রেলীয় সরকারের এমন একটি নীতিতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষুদ্ধ হয় ফেসবুক। এমনকি দেশটিতে সকল সংবাদ কন্টেন্ট তারা নিজেদের প্লাটফর্ম থেকে শেয়ার নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয়। যে দেশে সংবাদ পাঠের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ফেসবুক, সেখানে কোম্পানিটির পাল্টা পদক্ষেপে বিপাকে পড়ে আমজনতা।
এরপর গত সপ্তাহের মঙ্গলবার অস্ট্রেলীয় সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতা হয় ফেসবুকের, যার ভিত্তিতে তারা ব্যবহারকারী সংবাদ মাধ্যমগুলোকে আগের মতোই তাদের পেজ থেকে প্রচারকাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। সমঝোতার আলোকে মূল্য পরিশোধের বিরোধটিও কিছুটা শিথিল করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ।
এরপর দেওয়া এক বিবৃতিতে অবশ্য ফেসবুক আগামীতে ফের এমন বিরোধ সৃষ্টির ইঙ্গিত দেয়। সেখানে ফেসবুকের গ্লোবাল নিউজ পার্টনারশিপ বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যাম্পবেল ব্রাউন বলেন, “বৈশ্বিক পর্যায়ে আমরা সংবাদে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখব এবং একইসঙ্গে গণমাধ্যম জোটগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে তৈরি করা নীতিমালা প্রণয়নের বিরোধিতা চালিয়ে যাব। বিশেষ করে, যেসব নীতিতে সংবাদের মূল প্রকাশক এবং প্রচার মাধ্যম ফেসবুকের মধ্যে বিনিময় সম্পর্কের মূল্যায়ন যথাযথ হবে না, আমরা তার বিপক্ষেই থাকব।”
তবে সবচেয়ে বড় বিপদের আশঙ্কা হলো; এভাবে আঞ্চলিক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হলে- তা আমাদের অতি-পরিচিত পৃথিবী বিস্তৃত ইন্টারনেট দুনিয়াকে খণ্ড খণ্ড অংশে রুপ দেবে। অনেকেই যাকে বলছেন ‘স্প্লিন্টার নেট’ বা একেক অঞ্চলের নীতিমালায় নির্ধারিত ইন্টারনেট ব্যবহার সীমারেখার নতুন এক জগত। যার সংজ্ঞা হবে নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমানা বা জাতীয় আইন।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
দেশে দেশে কট্টর জাতীয়তাবাদের উত্থান, বাণিজ্য বিরোধ আর প্রযুক্তিখাতের কিছু কোম্পানির বাজার নিয়ন্ত্রণ ঘিরে সৃষ্ট উদ্বেগের সম্মিলিত প্রভাবে; বিশ্বজুড়ে অনেক দেশ নীতিমালার মাধ্যমে সীমিত করার উদ্যোগ নিচ্ছে ইন্টারনেট বিচরণের পরিসীমা। এই প্রক্রিয়ায় জড়িত পক্ষগুলো শুধু বিশ্বব্যাপী নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগের সুবিধা নিয়ে গড়ে ওঠা প্রযুক্তি কোম্পানির ব্যবসা বাধাগ্রস্ত করছে তাই নয়, বরং তারা এমন ধরনের স্বতন্ত্র প্লাটফর্ম তৈরি করতে চাইছে- যেগুলোকে তাদের পূর্বসূরীর মতোই যেকোনো দেশ বা অঞ্চল থেকে অবাধে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
দিনে দিনে আরও গভীর হচ্ছে এই বিভাজন রেখা:
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইবার পলিসি সেন্টারের প্ল্যাটফর্ম রেগুলেশন পোগ্রামের পরিচালক ড্যাফনে কেলার বলেন, “অতীতে যেমন আংশিক বিভাজন দেখা গিয়েছিল, বর্তমানের বৈশ্বিক প্রবণতা তার চাইতে শক্তিশালী ও স্থায়ী ভাবে ইন্টারনেট জগতকে খণ্ডবিখণ্ড করবে বলেই আমি ধারণা করছি।
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলী ইঙ্গিত দেয়, একটি প্ল্যাটফর্মকে শুধুমাত্র নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার দিক থেকেই রাতারাতি বিভাজন ঘটবে না। যেমন; অস্ট্রেলিয়া সংবাদ প্রকাশকদের মূল্য পরিশোধের আইন করা মাত্র, ফেসবুক গণমাধ্যমের সংবাদ লিঙ্ক অস্ট্রেলীয় ব্যবহারকারীদের প্রদর্শন বন্ধ করে দেয়। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার বাইরের ব্যবহারকারীরাও দেশটির কোনো সংবাদ লিঙ্ক ফেসবুকে দেখতে পাননি। ফেসবুকের সাময়িক এ পদক্ষেপটি ছিল ইন্টারনেটের মাধ্যমে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার ধারণার সরাসরি লঙ্ঘন। অর্থাৎ, কর্তৃপক্ষ আর কোম্পানি স্বার্থের সংঘর্ষও সৃষ্টি করবে আঞ্চলিক বিভাজন।
ভারতীয় সরকার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলে, বিদেশি প্রযুক্তি কোম্পানি সেদেশে ব্যবসার জন্যে আসতে পারে, তবে তাদের স্থানীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।” এটি ছিল টুইটারের প্রতি আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রচ্ছন্ন হুমকি। বিরোধী রাজনীতিক ও অধিকার কর্মীদের একাউন্ট সরকারি দাবি অনুসারে স্থায়ীভাবে বন্ধ না করায় এভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারের দাবি, টুইটার ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’ প্রচারণার মাধ্যম হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই বৃহৎ অর্থনীতির দেশটি সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি প্রযুক্তি কোম্পানি নিয়ন্ত্রণে উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে তোলা হয়েছে বেশ কিছু প্রস্তাবনা। তবে, সীমান্ত বিরোধের জেরে ভারত চীনে তৈরি ডজন খানেক অ্যাপ একেবারেই নিষিদ্ধ করে।
মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতকে তাদের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে বিবেচনা করে। বিশাল ভোক্তা জনগোষ্ঠী থাকার পরও, তারা যেমন পরিবেশে ব্যবসা করে অভ্যস্ত, ভারত হয়ে উঠছে তার বিপরীত। যুক্তরাষ্ট্রের মতো অবাধে সম্পদ অর্জনের সুযোগও তারা আগামী দিনে ভারতে পাবে বলে মনে হয় না। অতীতে যথেষ্ট বাধা না থাকার কারণে; উত্তর কোরিয়া বা চীনের মতো কয়েকটি দেশ ছাড়া ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো বিশ্বব্যাপী তাদের পরিষেবা বিস্তারের সুযোগ পায়। এখন সেই উন্মুক্তকরণের সুযোগ এমনকি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দেশেও সীমিত হয়ে পড়ার ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে।
কেলার বলেন, “একবার ভাবুন; সুইডেনে যা বৈধ তা পাকিস্তানে নিষিদ্ধ। তাই আইনের ফাঁকফোকর আমলে নিয়ে এবার আমাদের ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এরফলে প্ল্যাটফর্ম বা সরকারগুলোর স্বেচ্ছায় বা জোরপূর্বক নির্ধারিত বিধিমালা তুলে দেবে ভৌগলিক বিভক্তির দেওয়াল। ফলে, একদেশের ব্যবহারকারী যা দেখতে পারেন- তা অন্যদেশের ভোক্তারা পারবেন না। সূত্র: সিএনএন।
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ
উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com