প্রত্যেক মহানগরের বুকে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান থাকে, যা ক্রমশ তার পরিচিতিতে পরিণত হয়। যেমন, প্যারিসে আছে আইফেল টাওয়ার, লন্ডনের বিগ বেন, বার্লিনের বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ হল ব্রান্ডেনবুর্গ আর নিউ ইয়র্ক পরিচিত স্ট্যাচু অফ লিবার্টির জন্য।
বসনিয়া আর হার্জেগোভিনার রাজধানী সরজেভোতেও একটি গর্বের জায়গা আছে, তা হল গাজি হুসরেভ বেগ মসজিদ, যা ষোড়শ শতাব্দীর সেরা উসমানীয় শিল্পকর্ম। এই মসজিদ আর তার আশপাশ না দেখলে সরজেভোতে বেড়ানো সম্পূর্ণ হবে না।
উসমানীয় সুলতানের স্থপতি দ্বারা পরিকল্পিত গাজি হুসরেভ বেগ মসজিদ
১৫৩১ সালে নির্মাণকার্য শেষ হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত, গাজি হুসরেভ বেগ মসজিদ হল বসনিয়া আর হার্জেগোভিনার সব থেকে আকর্ষণীয় স্মৃতিস্তম্ভ। বিশ্বাস করা হত যে, মহান উসমানীয় স্থপতি মিমার সিনান এটির পরিকল্পনা করেছিলেন।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
বিদ্বানরা যখন নানা ঐতিহাসিক সূত্রের গবেষণা করেও সরজেভো বা গাজি হুসরেভ বেগ মসজিদের সাথে মিমার সিনানের কোনও যোগাযোগ পেলেন না, তখনই অনেক দ্বিধা দূর হয়ে গেছিল। তাছাড়াও, সিনানের প্রথম কাজ হল আলেপ্পোর হুসরেভ পাশা মসজিদ, যার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল ১৫৩৭ সালে, অর্থাৎ সরজেভোর এই মসজিদ তৈরি হওয়ার আরও ছয় বছর পর।
এই মসজিদ সিনানের প্রথম কাজ হওয়ার ফলে, এতে বিভিন্ন ভ্রান্তি সহজেই লক্ষ্য করা যায়। অথচ সরজেভোর হুসরেভ বেগ মসজিদ যে কোনও অভিজ্ঞ স্থপতির দ্বারা বানানো, তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ষোড়শ শতাব্দীতে বসনিয়ার উসমানীয় গভর্নর, গাজি হুসরেভ বেগ। তিনি ছিলেন উসমানীয় রাজপরিবারের সদস্য, কারণ তার মা সেলচুক সুলতানা ছিলেন সুলতান বায়েজিদ দ্বিতীয়ের কন্যা। এই কারণেই তিনি একজন রাজকীয় স্থপতিকে দিয়ে এই মসজিদ নির্মাণ করাতে পেরেছিলেন। এই স্থপতি হলেন মিমার সিনানের পূর্বসূরী আচেম ইসের আলি, তিনি ছিলেন প্রধান উসমানীয় স্থপতি।
১৫১৪ সালে সুলতান সেলিম ইয়াভুজের সাফাভিদের পারস্য অভিযানের সময় তাঁকে বন্দি করা হয়েছিল। তাঁর পুরো নাম ছিল আলাদিন আলি বে বিন আবেদ আল করিম। উসমানীয় দস্তাবেজে তাঁকে মিমার আচেম ইসের আলি বা কখনও শুধু মিমার আলি নামে নথিভুক্ত করা হয়েছে। তাঁর নামে আচেম যোগ করা হয়েছে অর্থাৎ তিনি পারস্য থেকে এসেছিলেন এবং ইসের অর্থাৎ বন্দী ছিলেন।
গাজি হুসরেভ বেগ মসজিদের সৌন্দর্য
একটি বিশাল ও জটিল স্থাপত্যকার্যের অংশ হিসেবে এই মসজিদটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল দুটি সমাধি, উঠোন এবং সমাধিস্থল, আবদেস্থান, ফোয়ারা, মুভাক্কিথান, মক্তাব, মাদ্রাসা, হানিগাহ, সর্বসাধারণের জন্য রান্নাঘর এবং একটি ঘড়ির টাওয়ার।
গাজি হুসরেভ বেগ মসজিদ হল গাজি হুসরেভ বেগের সব থেকে স্মরণীয় এবং সব থেকে দামী স্থাপত্য কার্তি। এখানে চারটি গেট সহ স্মৃতিসৌধ উঠোন আর সেই উঠোনের মাঝে একটি ফোয়ারা আছে। যদিও এটি ১৫৩১ সালে তৈরি, তবু এর সুবিশাল দেওয়াল, স্থাপত্য সজ্জা আর সম্পূর্ণ চেহারার সাথে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকের উসমানীয় স্থাপত্যের মিল পাওয়া যায়।
মসজিদের প্রবেশ চত্বরে পাঁচটি সুন্দর ছোট গম্বুজ আছে। এই চত্বরের একাংশে সূক্ষ্ম নকশা করা মুকার্নাস সহ প্রবেশপথ আছে।
অন্দরমহলের কারুকার্য
এই প্রবেশপথ উনবিংশ শতাব্দীতে অস্ট্রো-হাঙ্গেরি শাসনের সময় সজ্জিত করা হয়েছিল। ছদ্ম ফুল দ্বারা সাজিয়ে তোলার পাশাপাশি, এতে হুসেন রাকিম ইস্লামোভিকের সুন্দর হস্তাক্ষরে দুটি লেখা আছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যে ইস্লামোভিক ইস্তাম্বুলের আটজন হস্তাক্ষর বিশারদের কাছ থেকে সুন্দর হস্তাক্ষর শিখেছিলেন এবং সুন্দর হস্তাক্ষরের জন্য চারটি উপাধি পেয়েছিলেন।
মসজিদে ঢুকলেই প্রথমে পড়বে নামাজ আদায় করার জায়গা, যেটি হল প্রকৃতপক্ষে ২৪.৪০ মিটার উঁচু এবং ১৩.৪০ ব্যাসযুক্ত একটি গম্বুজ। এই প্রধান গম্বুজের নীচে লম্বা বারান্দা আছে, যা আগে মসজিদের দেওয়াল পর্যন্ত পৌঁছানোর রাস্তায় আলো জ্বালানোর কাজে ব্যবহার হত। নামাজের কক্ষের অতিরিক্ত অংশ কিবলার দিকে মুখ করে আছে এবং একটা অর্ধ গম্বুজ মিহরবের উপর অবস্থিত। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে ছোট ছোট গম্বুজের সাথে দুটি অতিরিক্ত অংশে প্রসারিত হয়েছে। বসনিয়ার অন্য কোনও মসজিদের এই রকম নকশা নেই।
মসজিদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটি ৪৫ মিটার উঁচু মিনার। এতে একটি সজ্জাবিহীন ঝুলন্ত বারান্দা ছিল, যা কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে বলেই বিশ্বাস করা হয়। সরজেভোর অন্যতম সুন্দর দৃশ্য এই মিনার থেকেই দেখা যায়। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, আজান এই মিনার থেকে কোনও রকম স্পিকার ছাড়াই সরাসরি দেওয়া হয়।
মসজিদের একদম নিকটেই দুটি সমাধি আছে। এর মধ্যে বড়টি হল গাজি হুসরেভ বেগের এবং ছোটটি হল হুসরেভ বেগের সেনাপতি মুরাত বেগ তারদিকের। তাদের মধ্যে দৃশ্যত সাদৃশ্যের কারণে, দুটি সমাধিই মিনার আচেম আলির নকশা করা বলে মনে করা হয়।
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ