।। আবু দারদা ।।
আন্দালুস বর্তমানে স্পেন নামে যাকে চেনে সেটি আমাদের নয়নের মণি। মুসলিমদের হারানো ফিরদাওস। আজকের স্পেন ও পুর্তগাল এবং ফ্রান্সের কিয়দাংশ মিলেই ছিল আমাদের সেই আন্দালুস। ১৪৯২ সালে, ৫২৯ বছর আগে, আমরা এটাকে হারিয়েছিলাম। দিনটি ছিল ২রা জানুয়ারী। আন্দালুস আমাদের ছিল আটশ (৭১১-১৪৯২) বছরেরও বেশি।বিজ্ঞাপন
আন্দালুসে মুসলিমদের স্মৃতিচিহ্নগুলোর অন্যতম কর্ডোভা জামে মসজিদ। এখন এটাকে পরিণত করা হয়েছে গীর্জায় যেখানে মঞ্চে রাখা হয়েছে যিশুখ্রিস্ট ও সাধুদের ভাস্কর্য। বর্তমানে কর্ডোভা মসজিদে জুতা পরিহিত অবস্থায় প্রবেশাধিকার রয়েছে এবং সেখানে নামাজ আদায় করা এখন নিষিদ্ধ।
স্পেন থেকে মুসলমানরা বিতাড়িত হওয়ার পর দীর্ঘ ৭০০ বছর কর্ডোভা মসজিদে কোনো আজান ও নামাজ হয়নি। আল্লামা ইকবালের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল এই মসজিদে দু’রাকাত নামাজ পড়া। ১৯৩৩ সালে স্পেন সফরকালে আল্লামা ইকবাল এই মসজিদ পরিদর্শন করেন।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
মসজিদে নামাজ পড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও আল্লামা ইকবালকে মসজিদে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে, প্রবেশের পর ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিতে বলা হয়। মসজিদে প্রবেশ করেই উচ্চস্বরে আজান দেন আল্লামা ইকবাল। দীর্ঘ সাতশ’ বছর পর ওই মসজিদে এটিই ছিল প্রথম আজান। মসজিদের দেয়াল ও স্তম্ভগুলো দীর্ঘকাল পর আজানের ধ্বনি শুনতে পায়। আজানের পর জায়নামাজ বিছিয়ে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন ইকবাল।
জানা যায়, নামাজে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হয় যে, তিনি বেহুঁশ হয়ে যান। জ্ঞান ফেরার পর তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে মোনাজাত করেন। মোনাজাতের প্রতিটি বাক্যই কবিতার মতো করে আবৃত্তি করেছিলেন তিনি। তার এই মোনাজাতটিই ‘বালে জিবরিল’ নামে পরিচিত। কর্ডোভার মসজিদে আল্লামা ইকবালের নামাজ আদায়ের ঘটনা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
অসাধারণ নৈপুণ্যে তৈরি এই মসজিদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মহাকবি আল্লামা ইকবাল রচনা করেছিলেন ৭টি কবিতা। ২০০০ সালের প্রথম দিকে স্প্যানিশ মুসলমানরা এই মসজিদের নামাজ আদায় করার দাবি জানালে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। মুসলিম সভ্যতার অনন্য নিদর্শন এই কর্ডোভা মসজিদটি এখনো গির্জা হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।
‘বালে জিবরিল’ কাব্যে আল্লামা ইকবাল লিখেছেন-
‘জালাল-জামালে তব খোদাপ্রেমী প্রাণের প্রমাণ,
শোভন সুন্দর তিনি, তোমাতেও সুষমার শান!
দৃঢ় তব বুনিয়াদ, বক্ষে তব স্তম্ভ অগণন,
শামের খেজুর বাগে বেশুমার বিটপী যেমন!
প্রাচীর-ছাদেতে তব রাজে যেন সীনায়ী চমক,
সুউচ্চ মিনারে তব জিব্রাইলি নূরের ঝলক!
মিটিতে পারে না কভু বীর-প্রাণ মুসলিমের নাম,
আজানে তাঁহার রাজে ইব্রাহিম-মূসার পয়গাম।
সীমাহীন তাঁর দেশ, সীমাহীন নীহারিকা তাঁর,
দজলা-দানুব-নীল তাঁরি প্রাণ-সায়রের ধার!
আজীম জামানা তাঁর, অপরূপ কাহিনী তাঁহার,
পুরানো কালেরে সে যে দিয়েছিল বাণী আজিকার।
আর্জুমন্দ তবে সাকী, শৌখিনের প্রমোদ-বিতান
পবিত্র পেয়ালা তাঁর, হস্তে খাঁটি ইস্পাতী কৃপাণ!
সে যে বীর মুজাহিদ, লা-ইলাহার বর্মেতে রক্ষিত!
সমরে অসির তলে লা-ইলাহা মন্ত্রেতে দীক্ষিত।
[অনুবাদ : সংগৃহীত]
‘কর্ডোভা মসজিদ’ শিরোনামে আর একটি কবিতায় তিনি লিখেন-
‘শিল্পীর মহান কাবা! সমুজ্জ্বল ধরমের মণি!
তোমা তরে আন্দালুস মক্কাসম মণিময় খনি!
থাকিলে আকাশতলে সুষমার নজির তোমার,
মুসলিম অন্তরে শুধু, নাহি নাহি, নাহি কোথা আর!
খোদার সেনানি অই অশ্বারোহী আরব-বাহিনী,
‘মহাপ্রাণ অধিকারী’, প্রত্যয়ের প্রতীক-কাহিনী!
যাঁদের শাসনে ব্যক্ত শাসনের নিগূঢ় নিদান;
‘ভোগের বিলাসে নহে, বিতৃষ্ণায় বাদশাহী শান’-
পুরব-পশ্চিমে যারা দিয়েছিল দৃষ্টি দীপ্তিমান,
আঁধার ইয়রোপে যারা দিয়েছিল পথের সন্ধান!
তাঁদের শোণিত-ধারে আন্দালুস আজো খোশ্দিল
অতিথি বৎসল আর সকলের সঙ্গে রাখে মিল।
আজও হেথা বিরাজিত হরিণীর চঞ্চল নয়ন,
দিঠির বাণেতে যার বিদ্ধ বটে প্রেমিক পরাণ!
আজিও বাতাসে তার ইয়েমেনের সুরভি বাতাস!
আজিও সঙ্গীতে তার হেজাজের সুরের বিলাস!
[অনুবাদ : সংগৃহীত]
আরেক কবিতায় তিনি লিখেন-
“হে স্পেন! তুমি তো মুসলিম রক্তের উত্তরাধিকারী
তুমি তো আমার কাছে হারামের ন্যায় নির্মলচারী।
তোমার প্রতিটি ধুলায় তো লুকানো সিজদার ছাপ
প্রত্যুষের বায়ুতে আছে শব্দহীন আযানের ডাক।
তোমার প্রতিটি পাহাড় ও ভ্যালিতে ছিল তাদের শিবির
অখিলস্থ নক্ষত্রের ন্যায় ক্ষুরধার যাদের বর্শার প্রাচীর।
তোমার শোভা রাঙাতে কি আরো হেনা প্রয়োজন?
আমার তপ্ত খুন হতে পারে সে রঙের আয়োজন।
ঘাস-খড় দিয়ে কি মুসলমানকে নিভানো যাবে?
যদিও সে হারিয়েছে উত্তাপ ও অনল শিখা কবে!
আমি তো গ্রানাডাও পরিদর্শন করলাম
কিন্তু, রাহীর তৃপ্তি তো নয় যাত্রা বা বিরাম।
আমি দেখলাম ও আমাকে দেখানো হলো
আমি বললাম ও আমাকে শুনানো হলো।
কিন্তু ভাই জেনে রেখো, এ দর্শন বা শ্রবণ
কিছুতেই হয়নি মোর হৃদয়ের প্রশান্তায়ন। [অনুবাদ: সংগৃহীত]
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ