চীনা এবং মুসলিম, এই দুই জনজাতির মধ্যে কারা মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করবে, মূলত সেই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয় তালাস নদীর পাড়ে এই যুদ্ধের মাধ্যমে। এই ঐতিহাসিক স্থানটি ঠিক কোথায় অবস্থিত তা আজও চিহ্নিত করা যায়নি। তবে মনে করা হয়, খুব সম্ভবত জায়গাটি কিরগিজস্তান এবং কাজাখস্তান সীমান্তের নিকটবর্তী এলাকাতেই অবস্থিত। এই তালাস নদীর যুদ্ধ-এর ফলে এই অঞ্চলে ইসলামের বিস্তার হয় এবং কাগজ তৈরির যে কৌশল চীনারা গোটা পৃথিবীর কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল, সেই গোপন রহস্য মুসলিম দুনিয়ায় ফাঁস হয়ে যায়।
তালাস নদীর যুদ্ধ: ঐতিহাসিক পটভূমি
চীনা এবং আরবী, এই দুই ভাষার ঐতিহাসিক নথিতেই এই যুদ্ধের উল্লেখ আছে। বিখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবন-আল-আথির (১১৬০-১২৩৩ সাল) এবং হাদিসের জ্ঞানী ব্যক্তি ইমাম-আল-ধাহাবি (১২৭৪-১৩৪৮ সাল) তাঁদের লেখনিতে এই যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছেন।
আশর্যজনকভাবে, সেই আমলের সব থেকে অসামান্য মুসলিম ইতিহাসবিদ আল তাবারি (৮৩৯-৯২৩ সাল) তালাসের যুদ্ধের ব্যাপারে কিছুই বলেননি। সম্ভবত, মধ্যযুগীয় মুসলিম দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর কাছ এই যুদ্ধ তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে মনে হয়নি। পরবর্তী কালে যখন মুসলিমরা এর গুরুত্ব অনুভব করেছেন, তখন তা নথিবদ্ধ করা হয়েছে।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
অথচ এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল খুবই সমান্য একটি ঘটনা থেকে। সেই যুদ্ধেরই পটভূমি, কারণ এবং তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল এখানে।
যুদ্ধের সূত্রপাত
চীনের ট্যাং রাজবংপূর্ব এশিয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য ভোগ করত, তবে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দুই দশকের মধ্যে সমরখন্দ, বুখারাসহ মধ্য এশিয়া; বিশেষ করে আফগানিস্তান ও উজবেকিস্তানের বিরাট অংশ মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে প্রাচ্য এবং মধ্য প্রাচ্যের দুই পরাশক্তির মধ্যে মোকাবিলা তখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। উল্লেখ্য, ৭০৫-৭১৫ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদের খিলাফতকালে সেনাপতি কুতাইবা ইবনে মুসলিমের নেতৃত্বে মুসলিমরা সেন্ট্রাল এশিয়ার বিস্তৃত অংশ জয় করেছিলেন।
৭৪৭ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ট্যাং সেনাবাহিনীর কোরীয় সেনাপতি গাও শিয়ানশি তৎকালীন তিব্বত রাজ্যের অন্তর্গত গিলগিট (বর্তমানে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন) জয় করেন ও মধ্য এশিয়ার বেশ কিছু ছোট ছোট রাজ্যকে ট্যাং সাম্রাজ্যের করদ রাজ্যে পরিণত করে। তখন বিদ্রোহের কারণে উমাইয়া সাম্রাজ্যের অবস্থা তখন টালমাটাল। এই বিদ্রোহ সফল হওয়ার ফলে ৭৫১ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়াদের খিলাফতের অবসান ঘটলো আব্বাসীয়দের হাতে। প্রায় নব্বই বছর মুসলিম বিশ্বকে শাসন করার পরে পতন হয় উমাইয়া খিলাফতের।
প্রথম আব্বাসীয় খলিফা হলেন আস সাফফা। শুরুর দিকে আব্বাসীয় খিলাফতের সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশা উমাইয়াদের চেয়েও তীক্ষ্ণ ছিল। এই কারণেই খলিফা আস সাফফা মধ্য এশিয়ার দিকে মনোনিবেশ করেন।
এই পটভূমিতে দুটি স্থানীয় রাজ্য ফারগানা ও চাচের মধ্যে অশান্তি শুরু হয়। ফারগানা চীনাদের থেকে সাহায্য চায় এবং তারা এক সময় চাচকে ঘেরাও করে অবরোধ করতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে চাচের শাসককে বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যা করা হয়। এই পরিস্থিতিতে তাঁর পুত্র পালিয়ে গিয়ে খোরাসানের আব্বাসীয়দের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন।
সেই সময় খোরাসানের গভর্নর আবু মুসলিম দ্রুত পড়শি অঞ্চল থেকে লোক জোগাড় করে সেনাবাহিনী তৈরি করেন। এই সেনাবাহিনী সাথে নিয়ে তিনি নামজাদা সেনাধিনায়ক জিয়াদ ইবনে সালিয়াহার নেতৃত্বাধীন ট্রান্সোকিয়ানার সেনার সাথে যুক্ত হন। জিয়াদ ছিলেন উমাইয়াদের দখলে থাকা ইরাকের কুফা অঞ্চলের প্রাক্তন গভর্নর।
তালাস নদীর যুদ্ধ জয়
মুসলিম সূত্র অনুসারে চীনারা প্রায় এক লাখ সেনার বাহিনী নিয়ে তালাস নদীর তীরে উপস্থিত হয় (চীনা সূত্র অনুসারে সেনার সংখ্যা ছিল ৩০,০০০) । চীনা সূত্র অনুসারে এই যুদ্ধ পাঁচ দিন ধরে চলেছিল, তবে আরবী সূত্রে যুদ্ধের মেয়াদ সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। কিন্তু এই যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে সর্বত্র একই বর্ণনা পাওয়া যায় – মুসলিমরা চীনা বাহিনীকে একেবারে নির্মূল করে দেয়। ইমাম আল ধাহাবির কথায় – “চীনাদের হৃদয়ে আল্লাহ আতঙ্ক সৃষ্টি করে। জয় নেমে আসে আর অবিশ্বাসীরা পৃষ্ট প্রদর্শন করে পলায়ন করে।“
ইমাম আল ধাহাবি এই জয়ের কৃতিত্ব প্রদান করেছেন জিয়াদ ইবন সালিয়াহকে। অপর দিকে, চীনারা যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য দায়ী করে কার্লুক তুর্কীদের। কারণ হিসেবে বলা হয়, তারা যুদ্ধের সময় বিদ্রোহ করেছিল এবং শত্রুপক্ষে যোগদান করেছিল।
এই জয়ের ফলে এই অঞ্চলে চীনাদের প্রভাব চিরতরে শেষ হয়ে যায়। আব্বাসীয়রা পরবর্তী ৪০০ বছর এখানে শাসন করে এবং মধ্য এশিয়া মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
এই যুদ্ধের সাথে চীনাদের কাগজ তৈরির রহস্য ফাঁস হওয়ার সম্পর্ক একটু অদ্ভুত। এই যুদ্ধের ফলে বহু চীনা সেনাকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যাঁদের মধ্যে অনেকেই কাগজ তৈরীর শিল্পে পারদর্শী ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকেই এই কৌশল মুসলিমরা আয়ত্ত করেন। পরবর্তী কালে আরবী বণিকদের মাধ্যমে সেই কৌশল পৌঁছে যায় ইউরোপে।
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ