স্যানচাকালার মসজিদ-এ পা রাখলে অবশ্য প্রথমেই নিছক মসজিদ বলে মনে হবে না, বরং মনে হবে হবে ইসলামী স্থাপত্যের ভবিষ্যতের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। ইস্তানবুল শহর থেকে খানিক দূরে অবস্থিত এই মসজিদ কিন্তু আদতে তৈরি হয়েছিল স্যানচাকালার পরিবারের ইচ্ছেনুসারে। তাঁরা চেয়েছিলেন ইস্তানবুলের মুসলমান ভাই বেরাদরদের জন্য উপাসনা গৃহ তৈরি করতে, এই মসজিদ সেই ইচ্ছেরই ফলশ্রুতি।
একদিক দিয়ে দেখতে গেলে স্থপতি এমর আরোলাতের মানস সন্তান এই মসজিদ। নিজের হাতে সম্পুর্ণ নকশা তৈরি করে একদম আধুনিক ধাঁচের এই মসজিদ তৈরি করেন তিনি। সূচনা ২০১২ সালে হলেও, ২০১৩ সালে এটি সোম্পুর্ণ হয়। তারপর থেকেই দেশে বিদেশে এর প্রশংসা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ২০১৫ সালে আর্চডেইলি নামক বিখ্যাত স্থাপত্য সংস্থা থেকে ‘রিলিজিয়াস বিল্ডিং অফ দ্য ইয়ার’ পুরস্কার পায় এই মসজিদ।
স্যানচাকালার মসজিদ-এর স্থাপত্য সৌন্দর্য
সাধারণত তুরস্কের মসজিদ মানেই ধরে নেওয়া হয় অটোমান সাম্রাজ্যের কিছু না কিছু প্রভাব থাকবে তার মধ্যে। কিন্তু স্যানচাকালার মসজিদ ভীষণ ভাবে এই ভুল ধারণা ভেঙ্গে দেয়। বরং, এই মসজিদের স্থাপত্যের সঙ্গে ভীষণ ভাবে মিল আছে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের । ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া সিঁড়ি, ঘাসে ঢাকা জমি আর কাকচক্ষু টলটলে জলাশয় ভীষণভাবে মনে করিয়ে দেয় ভারতের তাজ মহলের কথা। কিন্তু মূল স্থাপত্যের দিকে চোখ পড়লেই বোঝা যায় তা একেবারে নতুন ধরনের।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
যেখানে অটোমান স্থাপত্য ভীষণভাবে বাইজান্টিয়াম চার্চের প্রভাবে আচ্ছন্ন, স্যানচাকালার মসজিদ যেন ধরে রাখতে চায় পবিত্র আল্লাহর প্রকৃতির আলো ছায়ার কারুকাজকে। ঠিক যেন পৃথিবীর আদি সারল্য লুকিয়ে রয়েছে মসজিদের বুকে, সমস্ত সংস্কৃতির উর্ধ্বে তা।
স্যানচাকালার মসজিদের সবচেয়ে উল্লেখ্য গঠন হল মিনারটি। সেটি একটি আয়তাকার প্রিজম যাতে নিপুণভাবে ক্যালিগ্রাফি করা রয়েছে। ক্যালিগ্রাফিতে বিভিন্ন ভাবে লেখা রয়েছে আল্লাহ’তায়লার নাম।
মসজিদের বাগানে অবস্থিত সূর্যঘড়িটি আবার ভীষণভাবে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের বার্তা রেখে যায়। বাগানের অলিভ গাছটিও যেন তাতে সঙ্গত করে।
মসজিদের আভ্যন্তরীণ গঠন
পায়ে পায়ে মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করলে চোখে পড়ে আলোছায়ার কারসাজি। মসজিদের ছাদে বিভিন্নভাবে বসানো স্কাইলাইট ও ভিতরের থামের সাহায্যে এই কারসাজি দর্শকের মন জয় করে নেবেই নেবে। সবচেয়ে চোখে পড়ে নারী ও পুরুষদের প্রার্থনা স্থলের স্বাতন্ত্র্য। সাধারণত অটোমান স্থাপত্যে নারীদের প্রার্থনার জায়গা হত মেজেনাইন ফ্লোরে। কিন্তু এখানে মূল প্রার্থনা গৃহের মধ্যে পাতলা পর্দা টাঙিয়ে নারী ও পুরুষের প্রার্থনার স্থান আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। পর্দাটি দেখলে মনে হয় যেন রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশ নেমে এসেছে মসজিদের মধ্যে।
মসজিদের সিলিংটির বৈশিষ্ট্য আবার অন্যরকম মনোগ্রাহী। বাইরের ধাপে ধাপে সিঁড়ির আদলে গঠিত এই মসজিদের সিলিং আসলে জীবনের উন্নতির দিক নির্দেশ করে। সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয় গোটা মসজিদের মধ্যে অদ্ভুত এক সেকুলারিজমের প্রভাব। এ যেন নির্দেশনা যে ইসলাম আসলে শান্তির প্রতীক, সমগ্র পৃথিবীর মানুষের প্রতি সম্মানের প্রতীক।
এমর আরোলাত কিন্তু আধুনিক নকশা গঠনের মাধ্যমে কোনও প্রতিবাদ রাখতে চাননি, বরং আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যার সঙ্গে ইসলামের ভাবধারার সমন্বয় দেখিয়েছেন নিজের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে।
বিখ্যাত ভ্রামণিক লা করবুসিয়ের তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ এ মসজিদ যেন মক্কার দিকে মুখ করে নীরব প্রার্থনার গুরুত্ব নির্দেশ করে।’
এমর আরোলাতকে এই মসজিদ বানাতে সাহায্য করেছেন আরেক স্থপতি জয়নাব ফাড়িলিওগলু, যাকে ইস্তানবুলের প্রথম নারী স্থপতিও বলা চলে। তিনি জানালেন যে এমরের সঙ্গে আরও বারো জন স্থপতি এই অপূর্ব মসজিদ বানাতে সাহায্য করেছেন। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল আধুনিক ভাবধারার সঙ্গে ইসলামের গুরুত্বে মেলবন্ধন। শুধু তাই নয়, সহিহ ঈমানদার মুসলমানদের জন্য এক পবিত্র ও শান্ত উপাসনা স্থান বানাতে চেয়েছিলেন তাঁরা। সেই কাজে সাফল্য আসলে আল্লাহরই রহমত।
স্যানচাকালার মসজিদ আসলে সহিহ মুসলমানের মনের গহিন শান্ত উপাসনা স্থান, যেখানে আমাদের প্রিয় আল্লাহর সঙ্গে আমরা মিলে যাই বারবার।
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ