আজ আপনাদের সামনে দুজন মহিয়সী নারীর ইসলামের জন্য অসামান্য অবদান তুলে ধরবে।
আয়েশা বিনতে আবু বকর (৬১৪-৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দ)
এই উম্মতের নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানের অধিকারী হলেন উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রাযিঃ)। তাঁর অসামান্য গুণাবলীর বর্ণনা দিতে গিয়ে ইমাম ইবনুল জাওযি (রহঃ) এরকম কথাই বলেছেন। অনুরূপ বক্তব্য আছে ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’তে। ইমাম যাহাবি (রহঃ) তো বলেছেন, “মানবজাতির ইতিহাসেই সবচেয়ে বেশি জ্ঞানের অধিকারীনী নারী হলেন আয়েশা (রাযিঃ)”
প্রথম দুই খলিফার আমলেই আয়েশা (রাযিঃ) নিজস্ব ফতওয়া প্রদানে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। উমর (রাযিঃ) এবং উসমান (রাযিঃ) ছাড়াও বড় বড় সাহাবায়ে কেরাম সমস্যাপূর্ণ কোনো বিষয়ে উপনীত হলে আয়েশা (রাযিঃ)-এর মতামত জানতে তাঁর নিকট লোক পাঠাতেন।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
দীর্ঘ সময়জুড়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নৈকট্যের কারণে আয়েশা (রাযিঃ)-এর জ্ঞান অনেক সমৃদ্ধ ছিল। রাসূল থেকে তার বর্ণিত হাদিসগুলোর অধিকাংশই ইসলামী আইন সম্পর্কিত।
শাইখ সাইদ ফাইয়্যায (রহঃ) ‘মাওসুআতু ফিকহি আয়েশা’ নামক কয়েক খণ্ডের বিশাল কলেবরের এক গ্রন্থে আয়েশা(রাযিঃ) থেকে বর্ণিত হাদিস এবং ফিকহী মতামত সংকলন করেছেন। আয়েশা (রাযিঃ) কে খেলাফতের প্রারম্ভিক যুগের বিশিষ্ট সাতজন ফকীহের অন্যতম বলে মনে করা হয়।
ফতওয়া প্রদানে ভূমিকা
আয়েশা (রাযিঃ) নিজে ফতওয়া প্রদানের পাশাপাশি কোনো বিষয়ে অপরাপর সাহাবাদের প্রদত্ত ফতোয়ার ব্যাপারেও নিজের মতামত প্রকাশ করতেন। এক্ষেত্রে নিজ পিতা ও প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক(রাযিঃ) এবং পরবর্তী খলিফা উমর (রাযিঃ)-এর বিভিন্ন ফতওয়ার ব্যাপারেও তিনি তাঁর মত প্রকাশ করেন। সাহাবীদের মাঝে কোনো মাস’আলায় ইখতিলাফ হলেও তাঁরা আয়েশা (রাযিঃ) এর কাছে উপস্থিত হতেন।
নিজে গভীর ইলম অর্জনের পাশাপাশি তিনি ইলমের দরসও দিতেন। সাইদ ইবনুল মুসাইয়্যিব (রহঃ), উরওয়া ইবন যুবাইর (রহঃ) সহ মদীনার বিখ্যাত কয়েকজন ফকীহ আয়েশা (রাযিঃ) থেকে ইলম অর্জন করেছেন।
আয়েশা (রাযিঃ) তাঁর ৬৫ বছর জীবদ্দশায় প্রায় ২২১০টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি একাধারে ছিলেন সমসাময়িক যুগের অন্যতম ফকীহ, আলেমা ও বিশেষ মর্যদার অধিকারিনী। অসংখ্য হাদিস বর্ণনাসহ যুদ্ধের বিবরণ দানেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। কবিতা আবৃতি ও রচনায়ও তাঁর দক্ষতা ছিল ঈর্ষনীয়। অসংখ্য সাহাবী ও তাবেয়ী তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। হাদিস, ফিকহ এবং ইলমে তাফসীরের ক্ষেত্রে আয়েশা (রাযিঃ)-এর অবদান সর্বযুগের আলেম সমাজ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
ফাতিমা আল-ফিহরী (৮০০-৮৮০ খ্রিষ্টাব্দ)
আজ থেকে প্রায় এগারো শতক আগে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন একটি বিশ্ববিদ্যালয় ‘আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন ফাতিমা আল-ফিহরি নাম্নী এক মহীয়সী নারী।
ফাতিমা আল-ফিহরি ছিলেন মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-ফিহরির মেয়ে। আব্দুল্লাহ ছিলেন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। তিনি পরিশ্রম করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন এবং তাঁর মৃত্যুর পরে উত্তরাধিকার সূত্রে সেসব সম্পদ রেখে যান তাঁর দুই কন্যার জন্য। তার দুই কন্যাই বেশ সুশিক্ষিত, চিন্তাভাবনায় প্রগতিশীল এবং যথেষ্ট ধর্মপ্রাণ ছিলেন।
ফাতিমা যখন বাবার রেখে যাওয়া সম্পদের ভাগ পেলেন, তখন তিনি ভাবলেন অর্থগুলো কোনো ভাল কাজে ব্যয় করবেন। যেহেতু তিনি একই সাথে ধার্মিক এবং শিক্ষানুরাগী ছিলেন। তাই তিনি একটি মসজিদ নির্মার্ণের চিন্তা করলেন, যা একাধারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবেও কার্যকর হবে। মানুষেরও উপকার হবে, মানুষ নতুন কিছু শিখবে, নতুন কিছু জানবে এই ভাবনায় তিনি বেশ শিহরিত হলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন
দুই বছর নিজের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধায়নে তিনি এই নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করলেন। তিনি শপথ করেছিলেন যতদিন নির্মাণকাজ শেষ হবে না ততদিন তিনি সিয়াম পালন করবেন। তিনি ওয়াদা রক্ষা করলেন। টানা দুইবছর তিনি রোজা রেখেছিলেন এবং স্বপ্ন পূরণের পথে এগুচ্ছিলেন। মসজিদের পাশে জমি কিনে তিনি জায়গাটুকু আরও বিস্তৃত করতে থাকেন যেন শিক্ষার কাজ ভালোভাবে সম্পাদন করা যায়। সেই মসজিদটি উত্তর আফ্রিকার অন্যতম বৃহৎ মসজিদ ছিল। এখানে একসাথে ২২ হাজার মানুষ নামাজ পড়তে পারত। আর এই মসজিদের পাশে যে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল সেটি মধ্যযুগে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার একটি প্রধান প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
এই বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে মানুষের সমাগম বাড়তে থাকে। শিক্ষানুরাগী মানুষের যাতায়াত বাড়তে থাকে। ফলে অল্পকিছুদিনের মধ্যে ফেজ একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে পরিণত হয়। ফাতিমা আল-ফিহরী মারা যান ৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে।
তিনি হয়ত জানেনও না, তাঁর তৈরি করে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি এতদিন পর্যন্ত পৃথিবীর প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে টিকে থাকবে। কালের স্বাক্ষী, ইসলামের সোনালী অতীতের স্বাক্ষী হয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফাতিমা আল-ফিহরির প্রচেষ্টা এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, নারীরা সুযোগ পেলে কত অসাধারণ কাজ করে যেতে পারেন!
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ