ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তার প্রচার হয়েছিল এবং ক্রমশ বিভিন্ন দেশে তা বিস্তার লাভ করেছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সুদূর কানাডার মতো দেশে এই ধর্ম সেভাবে পৌঁছতে পারেনি।
কিন্তু এই ছবিটা বদলাতে শুরু করে ১৯৪০ সালের পর থেকে। এবং কানাডার সুদূর উত্তরে, আলবার্টা প্রদেশের একটি ছোট্ট উত্তরের শহরে থেকে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আলবার্টাতে ইসলামের ইতিহাস এখন প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো।
আলবার্টাতে ইসলামের পদার্পণ
বর্তমান লাক লা বিশ, আলবার্টা হল একটি ছোট্ট, শান্ত শহর, যা এই প্রদেশের রাজধানী এডমন্টন থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে অবস্থিত। এখন এখানে মাত্র ২,৩০০ জনের বসবাস। ১৯৪০-এর দশকে লেবানন থেকে তিনটি পরিবার এখানে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল এবং ১৯৪৬ সালের মধ্যে সেখানে পাকাপাকি ভাবে বসতি স্থাপন করেছিল। সেই সময় এই স্থান ছিল আরো দুর্গম। তাঁরা লেবাননের একজন মুসলিম পথিকৃৎ ও উদ্যোক্তা আলী আহমেদ আবুচাদিকে অনুসরণ করেছিলেন সেখানে এসেছিলে।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
আবুচাদি ১৯০৬ সালে লাক লা বিশ-এ এসেছিলেন এবং সেই অঞ্চলের বাসিন্দাদের সাথে পশমের ব্যবসা শুরু করেছিলেন – এই প্রক্রিয়ার ফলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এমন প্রথম মুসলিম যিনি ক্রি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। লাক লা বিশ-র প্রথম দিকে আর এক জন মুসলমান ছিলেন মহাম্মদ আবুলি গোটমি, যিনি ১৯১১ সালে এখানে এসেছিলেন। তিনি প্রাথমিকভাবে আবুচাদির একজন কর্মচারী ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের পশমের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। গোটমিও কাজের সূত্রে দ্রুত ক্রি এবং তার পাশাপাশি আরও পাঁচটি ইউরোপীয় ভাষা শিখে ফেলেছিলেন। এভাবেই আলবার্টাতে ইসলামের চলা শুরু।
আলবার্টাতে ইসলামের প্রসার
১৯৫০-এর দশকে লেবাননের আরও কয়েকটি পরিবার এখানে এসেছিল। তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম এবং এদের প্রায় সকলেই লেবাননের ঐতিহাসিক বাইকিয়া উপত্যকার দুটি প্রতিবেশী গ্রাম, লালা এবং খরবিত রাহাহ থেকে এসেছিলেন। ১৯৬৯ সালের মধ্যে এই লেবানন বংশোদ্ভূত পরিবারের সংখ্যা বেড়ে ৪০ হয়েছে, যার মধ্যে ৩৬টি পরিবারই মুসলিম।
এই প্রাথমিক মুসলমানরা লাক লা বিশ-এ উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছিলেন, সেখানে তাঁরা ইউক্রেনীয়, ফরাসী, ব্রিটিশ এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে মাতিস বংশোদ্ভূত কানাডিয়ানদের সাথে মেলামেশা করতে শুরু করেছিলেন এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপিত হয়েছিল।
১৯৬৯ সালের মধ্যে লাক লা বিশ-এর মুসলিম সম্প্রদায় শহরের জনসংখ্যার প্রায় ১০% -এ পরিণত হয়েছিল, যা ছিল উত্তর আমেরিকার যে কোনও শহরে বা নগরের মুসলমানদের মধ্যে বৃহত্তম অনুপাত। ১৮৫৭ সালে লাক লা বিশ-এ আরব মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন গঠন করার জন্য বারো জন মুসলিম সদস্য একত্রিত হয়েছিলেন।
পরের বছর, এই শহরে আলকারিম মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল, এটি হল কানাডার দ্বিতীয় মসজিদ এবং সমগ্র উত্তর আমেরিকায় এটি তৃতীয়। এই মসজিদে কুরআনের শিক্ষা দেওয়া হত এবং এটি মূলত লাক লা বিশ-এর মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্তদের একসাথে জড়ো হওয়ার একটি সাধারণ জায়গা হিসাবে কাজ করেছিল।
ধর্মীয় শিক্ষায় গুরুত্ব প্রদান
১৯৬২ সালে এমন বন্দোবস্ত করা হয়েছিল যাতে লেবাননের একজন ইলিম, তিন বছর মেয়াদের জন্য লাক লা বিশ-এ এসে এই সম্প্রদায়ের ইমাম হিসাবে কাজ করতে পারবেন, কুরআন সম্পর্কে শিক্ষাদান করতে এবং বিবাহ ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে পারবেন। এই ইমামের ইংরাজি ভাষায় সীমিত জ্ঞান থাকার কারণে, তিনি লাক লা বিশ-এর অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারতেন না। তবে তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অত্যন্ত সক্রিয় থাকতেন।
আলবার্টার লাক লা বিশ-এর প্রাথমিক মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে এটি একটি বিস্তৃত বিবরণ এবং কোনও নির্দিষ্ট মুসলমান ব্যক্তি এবং সম্প্রদায় হিসেবে তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাস বজায় রাখার ক্ষেত্রে যে সমস্ত ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, সেই বিষয়ে এখানে কোনও আলোচনা করা হয়নি। সেই সময় তাদের কাছে প্রযুক্তির অভাব ছিল থাকার কারণে তাঁরা বিশ্বের অন্য প্রান্তের মুসলমানদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেননি।
ঐতিহ্য আজও অটুট
তবুও, এই সম্প্রদায়ের মুসলমানরা তাঁদের বিশ্বাস এবং ঐতিহ্যকে দৃঢ় ভাবে বজায় রেখেছেন। মুসলমানদের জনসংখ্যার নিরিখে এই শহর অন্যান্য শহরের চেয়ে ছোট হলেও, বর্তমানে লাক লা বিশ-এ প্রতি ৬ জন বাসিন্দার মধ্যে অন্তত একজন লেবাননের বংশোদ্ভূত। আলকারিম মসজিদটি ১৯৮৬ সালে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল এবং এটি আজও চালু রয়েছে এবং এই মসজিদকে লাক লা বিশ-এর বাসিন্দারা তাঁদের ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলেই মনে করেন।
অবশ্যই, লাক লা বিশ-এর যাত্রা এখনও থামেনি। মুসলমানরা এখনও সুদূর উত্তরে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং নুনাভুট, ইউকন এবং উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলগুলির পাশাপাশি কুইবেকের উত্তর প্রান্তে ইতিমধ্যে তাঁরা বসতি স্থাপন করেছেন। এখনও উত্তরের যে সমস্ত প্রান্তে ইসলাম পৌঁছয়নি, আগামী কয়েক বছরে সেখানেও মুসলমানরা পৌঁছে যাবেন।