।। আল্লামা মাহমুদুল হাসান ।।
[রাজধানীর অন্যতম দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারায় শনিবার (২৬ ডিসেম্বর) রাহবারে মিল্লাত আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.)এর জীবন ও চিন্তাধারা শীর্ষক দিনব্যাপী এক আলোচনা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশবরেণ্য বিশিষ্ট উলামায়ে কেরাম হযরতকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য রাখেন।
আলোচনা সভার শেষ অধিবেশন বাদ মাগরীব বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সভাপতি ও যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার মুহতামিম, মুহিউসসুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসান (হাফি.) আল্লামা কাসেমী (রাহ.)এর উপর স্মৃতিচারণমূলক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। বিষয়বস্তুর গুরুত্ব ও সময়োপযোগীতা বিবেচনা করে তাঁর বক্তব্যটির হুবহু অনুলিপি নিম্নে পত্রস্থ করা হল। – সম্পাদক]
“আজ আমরা যাঁর সম্পর্কে আলোচনা করছি, আল্লাহ জাল্লাশানুহু তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন। আমাদের আশা, আরো মাকাম বাড়িয়ে দিন। আমীন।
হাদীসের মধ্যে এসেছে, “উজকুরু মাহাসিনা মাউতাকুম”। যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের ভাল গুণাবলী আলোচনা করো। এটা করলে দুইটা লাভ, একটা হলো আমরা যখন তাঁর ভালো গুণের আলোচনা করি, আল্লাজাল্লা শানুহু খুশি হন, ফেরেশতারা সাক্ষী হয়। আল্লাহর কাছে যখন যায়, তখন তার দারাজাত বুলন্দ হয়। “আনতুম শুহাদাউল্লাহি ফিল আরজ”-আল্লাহ ওয়ালারা, আলেম উলামারা, বিশেষ করে মাদরাসার ছাত্ররা; তারা তো এমনিতেই নিষ্পাপ হয়।
এই মজলিশগুলো, এই ধরণের মজলিশগুলো জান্নাতি মজলিশ হয়। এই সমস্ত মজলিশের মধ্যে আসাতিজায়ে কেরাম থাকেন। ছাত্ররা থাকে। তারা ভবিষ্যতের জন্য তৈরী হচ্ছেন। মাদরাসার মধ্যে আর কোন কাজ নাই, চব্বিশ ঘণ্টা আল্লাহ, আল্লাহর রাসুলের আলোচনা, কুরআন-সুন্নাহর আলোচনা জারি থাকে। দুনিয়াতে এইটাই হলো জান্নাতি মজলিশ। জান্নাতি মজলিশ, যে মজলিশে দ্বীনি আলোচনা করলে আল্লাহ খুশি হন এবং ফেরেশতাদের কাছে বলেন, ইয়ুবাহি বিহিমুল মালায়িকা। এটা ঐ ধরণেরই একটা মজলিশ। এখানে তাঁর (কাসেমী রাহ.) মাহাসিনার তাজকিরা হচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাপাক খুশি হচ্ছেন, আর উনার (আল্লামা কাসেমী) মাকাম বাড়তেছে।
মাওলানা কাসেমী সাহেব অনেক বড়মাপের মানুষ ছিলেন। আমার ধারণা হলো, তাঁর জীবনে কোন ব্যর্থতা নাই। তবে এই অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে অনেক বাধা বিপত্তিকে পার করতে হয়েছে। তিনি তাঁর লক্ষ্যবস্তু অর্জন করার জন্য বিভিন্নভাবে মেহনত করেছেন। বাধাগ্রস্ত হয়েছেন।
আমি তাঁকে জানি, যখন তিনি ফরিদাবাদে ছিলেন তখন থেকেই। তিনি যাত্রাবাড়িতেও গেছেন। আমি তখন ফরিদাবাদের কমিটিতে নাজিমে আ’লা ছিলাম। তিনি যখন ফরিদাবাদে ছিলেন, তখন খুব পরিচয় ছিলো, চলাফেরা ছিলো। কিন্তু তিনি তাঁর মনের চাহিদা পূরণ করতে পারেননি। বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। ব্যর্থতা তাকেই বলে, যে বাধাগ্রস্থ হলেই থেমে যায়, কাজ করে না। যারা বাধা আসলে থেমে যায়, তারা ব্যর্থ, তাদের জীবন ব্যর্থ। আর যে বাধাগ্রস্থ হওয়ার পরেও বসে থাকে না, থেমে যায় না, চেষ্টা অব্যাহত রাখে, মেহনত করে লক্ষ্যবস্তু অর্জনের জন্য। তিনি অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারলেও সফল মানুষ
অন্যদিকে এমনও আছে যে, একজন তার লক্ষ্যবস্তু অর্জনের জন্য কাজ করে, আর তার কোন বাধা নাই, সে তার লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। যেমন- নকশবন্দি তরিকায় যারা তাসাউফ সাধনা করেন, তাদের বাধা নাই। তাসাউফের মধ্যে বুজুর্গ হয়ে যায়। হাজী সাহেব (রাহ.)এর কাছে একজন গিয়ে বলল যে, হুজুর আপনার কাছে বাইয়াত হতে মনে চায়, আবার অমুকের কাছেও বাইয়াত হতে মনে চায়। আপনি সিদ্ধান্ত দিন, কার কাছে ইসলাহের জন্য বাইয়াত হবো। তো তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, বলো তাসাউফের মাধ্যমে হতে চাও, নাকি সুলুকের মাধ্যমে মেহনত করে হতে চাও। শায়খের তাসাউফের মাধ্যমে হতে চাও, নাকি ৭০ বছর মেহনত করে কামিয়াব হতেও পারো নাও হতে পারো; এটা চাও। তাসাউফের মাধ্যমে মিনিটের মধ্যেই লিফটের মতো একশত তলায় উঠে যেতে পারবে। কোনটা চাও? সহজ তো এটাই, শায়খ তাসাউফ করে আল্লাহর ওলী বানায়া দিবে। তো তিনি বললেন, হুজুর এটাই তো সহজ, বাধা নাই, বিপত্তি নাই। অল্প সময়ের মধ্যে আল্লাহর ওলী হয়ে যাবো।
তখন হাজী সাহেব (রাহ.) প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন যে, ঠিকাছে তাহলে তুমি নকশাবন্দিয়া তরিকায় চলো। আমার রাস্তা হলো সুলুকের রাস্তা। আমার এখানে তুমি পারবে না। রাস্তায় চলতে গেলে পড়ে যাবে, উঠে দাঁড়াবে। আবার পড়ে যাবে, আবার উঠে দাঁড়াবে; এভাবে মনজিলে মাকসাদে পৌঁছাতে হবে। তো সহজ রাস্তায় চলে সফল হওয়া যায়। কিন্তু যদি নামার সময় লিফট না থাকে তো মুশকিল হয়ে যাবে। আবার একশ তালায় উঠতে হয়, লিফট নাই মুশকিল হয়ে যাবে। নশিব ও ফরজ বুঝে না, তাই সফল হলেও এক নাম্বার ব্যক্তি না। এক নাম্বারের সফলতা না। আর যিনি বাধাগ্রস্ত হয়, তার ফিকরের মধ্যে বিকাশ ঘটে। এই পথে আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলাম না। বসবো না, আরেক পথে যাবো। সেখানেও বাধা আরেক পথে যাবো। সেখানেও বাধা আরেক পথে যাবো। বসবো না। উদ্যোগের পর উদ্যোগ, উদ্যোগের পর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
কোন রাস্তায় চলতে গিয়ে যদি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থেমে গেল, এটার নাম সফলতা নয়। হেকমত কৌশলের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। একদিন না একদিন তিনি সফল হবেনই। সাহেব তাকওয়া, সাহেবে তাহারাত, রাব্বানী আলেম যিনি হন, তিনি বাধাগ্রস্ত হবেনই। এটা সুন্নাতে আম্বিয়া। নবী (সা.)সহ সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু তারা উদ্যোগ ছাড়েননি। শেষে কামিয়াবি তাদের হাতে এসেছে।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
আমি মনে করি হযরত মাওলানা কাসেমী; যিনি কিছুদিন আগেও আমাদের দামাত বারাকাতুহম ছিলেন, আজকে নাওয়ারাল্লাহু মারকাদাহু হয়ে গেছেন।তিনি বহুত বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। তিনি বিভিন্ন মাদরাসায় কাজ করেছেন, কিন্তু মন মতো কাজ করতে পারেননি বিধায় এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখানেও যে তিনি বাধাপ্রাপ্ত হন নাই, এমন নয়। যারা পরবর্তীতে এসেছেন তারা হয়তো জানেন না। এখানেও তিনি অনেক কঠিন বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। এখলাস ওয়ালা মানুষ ছিলেন। এই যুগে এটা খুবই বিরল। যত বাধাগ্রস্ত হয়েছেন ততো তাঁর ফিকিরের বিকাশ হয়েছে। চিন্তা গবেষণার ফলে তিনি আমাদের মাঝে জাতীয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। ইলমী ময়দানেও, আমলী ময়দানেও, সিয়াসী ময়দানেও; সব ময়দানে তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। আল্লাহ জাল্লাশানুহু তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুক। আমীন।
প্রথমত: তাঁকে আল্লাহ তায়ালা নিষ্পাপ, এতিম, মা’সুম বাচ্চাদের তেলাওয়াতের ছওয়াব ও বরকত দান করবেন। আর দুই নাম্বার যেটা সবচেয়ে বেশি জরুরি তা হলো, তিনি তো তাঁর জায়গায় চলে গেছেন। কিন্তু তার রেখে যাওয়া আদর্শ ইলমী, আমলী, সিয়াসি, সুন্নাত প্রতিষ্ঠা, দ্বীন প্রতিষ্ঠা, ইলম প্রতিষ্ঠা, আমল প্রতিষ্ঠা, ছাত্র গড়া, বিভিন্ন সাইটে কাজ করার জন্য আমনতদার ছাত্র গড়া, যোগ্য ছাত্র গড়া, এই যে উনার মিশন ছিলো ব্যাপক, এটা যদি আমরা ধরে রাখতে পারি, তাহলে আমরা তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী। আর যদি না পারি, তাহলে আমরা বসে ওয়াজ-নসিহত করব, তাঁর প্রশংসা করব। কিন্তু এই মজলিসের মাকসাদ তাঁর লাভ হওয়া এবং তাঁর মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সুন্নাত তরীক্বা অনুযায়ী। এটার দায়িত্ব তাদের বেশি, যারা তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
দুই নাম্বার, মাদ্রাসার ফারেগীন যারা তাঁর ছাত্র ছিলেন। ছাত্র হল উস্তাদের আসল পুঁজি, দুনিয়ার ক্ষেত্রেও, আখিরাতের ক্ষেত্রেও। সুতরাং তাঁর মিশন ও ভিশনকে এগিয়ে নেওয়ার মূল দায়িত্ব হয় তাঁর ছাত্রদের উপরে। আমি আশা করবো, তাঁরা এই দায়িত্ব এগিয়ে নিবেন।
আমি বেফাকের সভাপতি বটে। অল্প সময় আমরা সাথে ছিলাম। আমি তাঁর সাথে মাত্র কয়েকটা মিটিং করেছি। যে যাই বুঝুক, আমার জন্য তিনি বড় খুটা ছিলেন। এখন আমি সেটাকে অনুভব করি। কাসেমী সাহেব নাই, আমি আছি। বয়সও কাছাকাছি। মানুষরা বলে- যে হয় ছদর, পরে হয় কবর। আল্লাহপাক তাঁর ইলামি, আমলি, সিয়াসি মিশনকে এবং ইসলামবিদ্বেষী, ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে তিনি যেরকম সচল সচেতন ছিলেন, আমাদেরকে ও তাঁর সাথে সংশ্লিষ্টদেরকে ইখলাসের সাথে, মুহাব্বতের সাথে, দয়ার সাথে, দরদের সাথে; এসব গুণাবলী তাঁর সীফাত ছিল, আপনার আমার মধ্যে আনতে হবে। এভাবে তাঁর মিশনকে সুন্নাত তরীক্বায় ও দরদের সাথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন।”
অনুলিখনে- মুহাম্মদ আল আমীন, শিক্ষার্থী- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ