বই: ডাবল স্ট্যান্ডার্ড
লেখক: ডা. শামসুল আরেফীন
প্রকাশনী: মাকতাবাতুল আযহার
প্রকাশকাল: আগস্ট`১৭
মুদ্রিত মূল্য: ২২০
পৃষ্ঠা: ১৯২
পর্যালোচনা: পৃথিবী এগুচ্ছে। দুর্ধর্ষ গতিতে। পিছনের পৃথিবীর দিকে ফিরলে, বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকালে এবং আগামীর পৃথিবী কল্পনা করলে যে জিনিসটা স্পষ্টতঃ তা হচ্ছে পৃথিবীর পরিবর্তন। এক সময় মানুষ যা ভাবত না, আজ তা বাস্তবায়িত! অতীতের পৃথিবী যা চিন্তা করতেও পারত না, আজ তা প্রতিফলিত! এই যে পৃথিবীর এই উত্থান-পতন, সমৃদ্ধি-পরিবর্তন তার মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানের বিবর্তন।
বিজ্ঞানের এই কল্যাণ অনস্বীকার্য এবং অপরিহার্যও বটে। কিন্তু বিজ্ঞানের এই উত্কর্ষতা ও উত্কৃষ্টতায় মুজ্জমান হয়ে একটি ক্ষুদ্র মহল নিজের অস্তিত্বকে আজ অস্বীকার করতে বসেছে। ওরা বিজ্ঞানকে সর্বসের্বা বানিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রককে অস্বীকার করছে। বিজ্ঞান বিজ্ঞান কপচিয়ে স্রষ্টাকে সৃষ্টির মাঝে গুলিয়ে ফেলছে। বিজ্ঞানের বুলি আওড়িয়ে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে বিগ্রহ করছে।
বিজ্ঞানের ভিত্তিতে তারা দাবি করছে অদৃশ্য বস্তুর কোনো অস্তিত্ব নেই। যার অস্তিত্ব নেই তাকে বিশ্বাস করা অযৌক্তিক! কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে মুখে মুখে এসব বললেও অসংখ্য অদৃশ্য বিষয়ে ওরা পুরাদস্তুর বিশ্বাসী। অথচ ধর্মের ব্যাপারে ওরা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পেন্ডুলামে দোলে! গতকাল বিজ্ঞান যা বলেছে আজ কি তা পরিবর্তন করেনি? অবশ্যই করেছে! এমনকি অনেক বিষয়ের ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থও হয়েছে। এটাই হচ্ছে বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। সৃষ্টিকর্তার ব্যাখ্যা না দিতে পারাটাও বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতার স্বরূপ। তাহলে আজ বিজ্ঞান যা বলছে কাল কি তার বিবর্তন হতে পারে না? অবশ্যই পারে!
দেড় হাজার বছর পূর্বে ইসলাম যা বলেছে বিজ্ঞান আজ তার সঙ্গে করমর্দন করছে। তবুও যারা বিজ্ঞানকে ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে, ধর্মের রীতি-নীতির নিমিত্ত খুঁজে এমন কিছু মানুষের কিছু যুক্তি খণ্ডন করেই রচিত হয় `ডাবল স্টান্ডার্ড`। ইসলামবিদ্বেষীদের উত্থাপিত কিছু আপত্তিকর রহস্যের তত্ত্বোদ্ঘাটন করেই `ডাবল স্ট্যান্ডার্ড` রচিত হয়েছে। যারা ইসলাম ধর্মের খুঁত খুঁজে খুঁজে যুক্তি দাঁড় করে, তাদের যুক্তির পিটে যুক্তি এবং আঘাতের বদলে চপেটাঘাত করেই `ডাবল স্টান্ডার্ড` সংকলিত।
ইসলামের ইতিহাস নিয়ে যারা সন্দিগ্ধ, ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে সন্দিহান এবং ইসলামি বিধি-বাগড়া নিয়ে সংশয়ে ভোগে তাদের সন্দেহ দূরীকরণে, তাদের সংশয় নিরসনে একটি তথ্যবহুল বইয়ের নাম `ডাবল স্টান্ডার্ড`।
বইটি গল্পচ্ছলে লেখা। গল্পের বাঁকে বাঁকে লেখক নানান বিষয় তুলে ধরেছেন। অবসান ঘটিয়েছেন বহুবিধ একচোখা যুক্তির। যার দরুন পাঠক তৃপ্তিভরেই পাঠ করতে পারবে। বইটি যেমন তথ্যবহুল, তেমনি দলিলনির্ভুল । যুক্তিতে অকাট্য। তথ্য ও তত্ত্বে নিঁখুত। ভাষায় প্রাঞ্জল। মর্মোদ্ঘাটনে সাবলীল। গল্পের প্লটগুলো তেমন আকর্ষণীয় না হলেও সংলাপগুলো সুবিন্যস্ত।
গল্প এগিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতাও নিয়মতান্ত্রিক। সর্বোপরি পাঠক বইটি পড়লে ইসলামের উপর উত্থিত অনেক সন্দেহ, সংশয়ের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পারবে। সেই সঙ্গে বিশ্বাসের দেয়ালটা হবে দ্রঢিষ্ঠ।
আমি যে ফ্ল্যাটে আছি তার নিচ তলায় আগুন ধরেছে। আমি দেখিনি। অবিশ্বস্ত একজন থেকে খবর পেয়েই আমি বাঁচার উপায়ন্তর খুঁজছি। ছটফট করছি। এই যে একটা শোনা কথার উপর আমি ছটফটানি শুরু করেছি, এরপরেও আমি কীভাবে অদেখা জিনিস বিশ্বাস করি না? একজন অবিশ্বাসীকে এভাবেই কিছু যুক্তি দিয়ে বিশ্বাসের বিশ্বস্ত পথে ফিরানোর একটি অনন্য কাহিনি নিয়ে বইয়ের `না দেখে বিশ্বাস: মানবজন্মের স্বার্থকতা` গল্পটি।
দাসপ্রথা কী? কেন? দাসপ্রথা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের উত্থাপিত কিছু যৌক্তিক দাবি এবং তার পাল্টা জবাব পেতে লেখকের `দাসপ্রথা: ঐশী বিধানের সৌন্দর্য` গল্পটি পড়তে হবে। গল্পটি পড়লে দাসপ্রথা নিয়ে কিছু বিভ্রান্তির অবসান ঘটবে। কোরআনে নারীকে `শষ্যক্ষেত্র` উপমা দেওয়ায় একটি নারীবাদী মহল মায়াকান্নায় রোরুদ্যমান। অথচ ওরাই নারিদেরকে পণ্য বানিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়। তাদের যোজন যোজন যুক্তিগুলো খণ্ডন করেই লেখকের `শষ্যক্ষেত্র: সম্পত্তি না সম্পদ?` গল্পটি। ভার্সিটিপড়ুয়া একটি চাষীর ছেলে কতো সুন্দরভাবে যুক্তিগুলো খণ্ডন করে গল্পটিতে!
`সমাধান কি মানবধর্মেই?` নামের গল্পটিতে মানবধর্মের অন্তরালে ধর্মনিরপেক্ষতার কিছু সাদা সভ্যতার কালো মুখোশ খসে পড়ে। সেই সঙ্গে গল্পটিতে জানা যাবে মানবধর্মের সীমাবদ্ধতা ও ধর্মের সুশৃঙ্খলার স্বরূপ।
ভূত, ভবিষ্যত ও বর্তমানের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, প্রভিন্ন ধর্মের এবং নানান বর্ণের মানুষ কীভাবে একত্ববাদে বিশ্বাসী তা জানতে হলে লেখকের `বিজ্ঞানকল্পকাহিনী: শাশ্বত একত্ব` গল্পটি পড়তে হবে। মানুষপ্রদত্ত কিছু ধর্মের শিকলে আবদ্ধ হয়েও মানুষ একত্ববাদকে কীভাবে বিশ্বাস করে তার উত্কীর্ণ প্রতিফলিত গল্পটিতে।
`দক্ষিণহস্ত মালিকানা: একটি নারীবাদী বিধান`, `জিযিয়া: অমুসলিম নাগরিকের দায়মুক্তি`, `শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ: ওদের স্বপ্ন আমাদের অর্জন`, `আরব সংস্কৃতি মানবো কেন?`, `বনু কুবাইযার মৃত্যুদণ্ড ও বাংলাদেশের দণ্ডবিধি`, `পরিপূর্ণ দাড়ি: জঙ্গল নয়, ছায়াবীথি` শিরোনামে প্রভৃতি গল্পগুলোও শিক্ষণীয়। প্রত্যেকটি গল্পই প্রশংসার যোগ্য। বিজ্ঞানের ভিত্তিতেই ধর্মবিদ্বেষের কিছু দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হয় গল্পগুলোতে। এগুলো পড়লে অবিশ্বাসীদের বিশ্বাস জন্মাবে। বিশ্বাসীদের বিশ্বাস পাকাপোক্ত হবে। বিশ্বাসের শিকড় দৃঢ়মূল হবে।
প্রতিক্রিয়া: বইটা শুরু করতেই এক ধরনের ভালোলাগা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ধর্মবিদ্বেষীদের উত্থাপিত মোক্ষম মোক্ষম প্রশ্নগুলোর যুক্তিযুক্ত উত্তর পেয়ে বারবার বিস্ময়াভিভূত হয়েছি। উদগ্রীব ও উত্কণ্ঠায় একবসায় শেষ করেছি বইটি। ইসলামের প্রতি অনেক সন্দেহ, সংশয় দূর হয়েছে বইটি পড়ে। সেই দৃষ্টিতে বলা যায় বইটি সবার জন্য পাঠ আবশ্যকীয়। আমি আস্তিক হই কিংবা নাস্তিক, মুমিন কিংবা মুশরিক, আমারও বইটি পড়া উচিত। অন্তত সত্যকে জানার জন্য হলেও। সবমিলিয়ে বইটি অনন্যসাধারণ। লেখক জায়গায় জায়গায় বলেছেন `নতুন গল্প আসছে`। সেই নতুন গল্পগুলোর জন্য মুখিয়ে রইলাম।
লেখক- সালেহ খান বাবলু
[ এই বিভাগে লেখা পাঠানোর জন্য editor@ummah24.com ইমেইল ব্যবহার করুন ]