।। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রাহ.) ।।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি ও তোমাদের ওপর আমার দান-অনুকম্পা পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছি এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে ধর্ম হিসেবে সন্তুষ্ট হয়েছি।’ (সূরা মায়েদা- ৩)।
কোনো ধর্মকে যখন সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে ফেলা হয়, তখন সে ধর্ম সভ্যতা-সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন ও সামাজিক যোগসূত্রবিহীন ধর্মে রূপান্তরিত হয়। বরং বলা যায়, এমন ধর্মে পরিণত হয়, যে ধর্মে জীবনের প্রাণোচ্ছলতা ও সজীবতার উচ্ছ্বাস নেই।
চিরন্তন ও শাশ্বত ধর্ম হলো, যে ধর্ম প্রভূত তাৎপর্য-মাহাত্ম্য, চারিত্রিক সুষমা ও ব্যবহারিক মাধূর্যতা, নান্দনিক আচার-আচরণ এবং অনুপম সভ্যতা-সংস্কৃতি ও সুস্থ রাজনীতির সুবিস্তীর্ণ দিগন্তে সদা উচ্চকিত। সত্য ও চিরস্থায়ী এবং শাশ্বত ধর্ম মানুষকে সঠিক আকিদা ও বিশ্বাসের ছাঁচে ঢেলে সাজিয়ে-গুছিয়ে অপূর্ব-সুন্দর একটি রূপ বা অবয়ব দেয়।
সত্যের আলো নিয়ে আত্মপ্রকাশের পর ইসলাম মানবতাকে পূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, আলোধারায় প্লাবিত ও অপার্থিব জ্যোতিস্নাত ও প্রজ্ঞাসমৃদ্ধ, ন্যায়নিষ্ঠাপূর্ণ সতত একটি সভ্যতা উপহার দিয়েছে। যে সভ্যতা মহাপরাক্রমশালী একক আল্লাহর ওপর আকিদা-বিশ্বাস স্থাপন, তাঁর স্মরণ-আলোচনা, তাঁর অলৌকিক শক্তির প্রতি অগাধ বিশ্বাস এবং আখেরাতই চির সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির আধার- এ বিশ্বাস লালন করার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
অনুরূপভাবে ইসলাম সামাজিক ন্যায়নিষ্ঠা, সাম্য, মানুষের প্রতি অকুণ্ঠ দয়ার্দ্রতা ও সহমর্মিতা, সেই সাথে যৌথভাবে একই সময়ে অধিকার ও আবশ্যকীয় কর্তব্য পালন এবং দান-দক্ষিণা ও বদান্যতায় সচেষ্ট, পারস্পরিক উপহারের আদান-প্রদান, কারো থেকে উপকার গ্রহণ ও অপরকে উপকৃতকরণ এবং যেকোনো সময় ও যেকোনো অবস্থায় মানুষকে সৃষ্টির সেরা এবং অত্যন্ত মর্যাদাশীল হিসেবে মান্যকরণের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি মানবিক শোভামণ্ডিত সভ্যতা উপহার দিয়েছে।
সত্যের আকিদা-বিশ্বাস ও আল্লাহ-প্রদত্ত শিক্ষাদীক্ষা, কুরআনের বিধি-নিষেধ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উজ্জ্বল জীবনালেখ্য এবং সাহাবাদের দ্যুতিময় জীবন-অধ্যায়ের ওপর ভিত্তি করেই ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে মানবেতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর-বাঙময় এবং সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোত্তম সভ্যতা-সংস্কৃতিতে।
হেজাজের ভূমিতে ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতির সর্বপ্রথম বিকাশ ঘটে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শহর ও হিজরতের স্থান মদিনা মুনাওয়ারায়। তারপর ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি বিকাশের অভিযাত্রা ক্রমান্বয়ে মদিনার সীমানা পেরিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য নগর-প্রান্তরে ও দিক-দিগন্তে চলতে থাকে। পৃথিবীর যে দেশেই ইসলামি সভ্যতা ও কৃষ্টির আগমন ঘটেছে, সে দেশের জনগণ ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতিকে গ্রহণ ও আপন করে নিয়েছে। দিগি¦জয়ী মুসলিম বীর-শার্দুলেরা যে অঞ্চল ও সমাজ জয় করেছেন, সে অঞ্চল ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতির পবিত্র ও নির্মল বায়ু সঞ্চারিত হয়েছে।
স্মর্তব্য, যে দেশ বা জাতিকে তরবারির জোরে আনুগত্যে আনা হয়, সে জাতি ও দেশের জনগণের চোখে বিজয়ীরা চিরকাল অপরাধী ও ঘৃণ্য হয়ে থাকে। এটি পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বজনস্বীকৃত একটি স্পষ্ট বিষয়। কিন্তু ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি যে দেশেই আগমন করেছে, সে দেশের জনগণ ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতিকে চরম আগ্রহ ও পরম ভালোবাসা দিয়ে এবং প্রসন্নচিত্তে আপন ও প্রিয় করে নিয়েছে। কারণ, ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি হলো মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ ও বাস্তবতার সাথে অনুপম সামাঞ্জস্যপূর্ণ একটি চমৎকার ঐশী ব্যবস্থাপনা।
তদ্রুপ ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি হলো, পারস্পরিক সহযোগিতা-সহমর্মিতা ও স্নেহ-ভালোবাসাপূর্ণ এবং সমগ্র মানবকুলকে সৃষ্টির কর্তৃত্ব থেকে মহান একক আল্লাহর কর্তৃত্বের ছায়াতলে নিয়ে যেতে এবং পার্থিব সঙ্কীর্ণতা থেকে সুপরিব্যাপ্তির দিকে ও বিভিন্ন ধর্মের অন্যায়-অবিচার থেকে ইসলামের ন্যায়নিষ্ঠা ও নায্যতার প্রতি পথ দেখানোর ওপর ভিত্তিশীল একটি মহিমান্বিত সভ্যতা-সংস্কৃতি।
পৃথিবীর যে ধর্মকেই সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে ফেলা হয়, সে ধর্ম অতিদ্রুত অবক্ষয় ও বিলুপ্তির কণ্টকাকীর্ণ পথে ধাবিত হয়। যে ধর্ম তার অনুসারীদের এ দুর্বল ও স্পর্শকাতর দিকটির ব্যাপারে সন্তুষ্ট করতে পারে, তাদেরকে আকিদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও তুষ্ট রাখতে পারে। ফলে তাদের সমাজ-সভ্যতার ফুলেল আঙিনায় অন্য কোনো সভ্যতা-সংস্কৃতি যেকোনো প্রকারে হোক, প্রবেশের পথ তৈরি করতে পারে না। আবার অন্য কোনো পরিবেশ-প্রকৃতিতে সৃষ্ট অথবা অন্য কোনো ধর্ম থেকে আবিষ্কৃত কিংবা কালের বিবর্তনে আবির্ভূত বা নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলের প্রচলিত ‘সভ্যতা ও সংস্কৃতি’ও তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির আঁতুড়ঘরে হানা দিতে পারে না।
যে ধর্ম থেকে সভ্যতা-সংস্কৃতিকে পৃথক করে ফেলা হয়, কালের চক্রবালে ও সময়ের আবর্তনে সে ধর্মের অনুসারীরা তাদের ধর্মীয় রথী-মহারথী ও বড় বড় ব্যক্তিত্বদের হারিয়ে ফেলার সাথে সাথে যে ধর্মবিশ্বাস তাদের মন-মস্তিষ্কে প্রভাব বিস্তার করে আছে, সে ধর্মবিশ্বাসকেও ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে। ফলে তারা তাদের পূর্বসূরিদের বাস্তব প্রতিচ্ছবি হওয়া দূরে থাক, তারা যে সভ্যতার লালনভূমিতে বেড়ে উঠেছে এবং যে সভ্যতা-সংস্কৃতির রঙ-ঢঙ ও রীতি-ধারায় তাদের জীবন সাজিয়েছে, তা থেকে যোজন যোজন দূরত্বে সরতে শুরু করে।
এখনকার সময়ে ওপরে উল্লেখিত বিষয়টিকেই আমরা সবচেয়ে ভয় করি। পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতির আগ্রাসন ও পাশ্চাত্য জীবনধারার সয়লাবের এ যুগে উপরিউক্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি আমাদের ভীষণ ভাবনা ও চিন্তায় ফেলে দেয়। আল্লাহ সবাইকে রক্ষা করুন।
অনুবাদ : মুহাম্মদ মিনহাজউদ্দিন
[ এই বিভাগে লেখা পাঠানোর জন্য editor@ummah24.com ইমেইল ব্যবহার করুন ]