।। প্রিন্সিপাল মাওলানা শুয়াইব আহমদ ।।
ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ থেকে শুরু করে রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার শিখর পর্যন্ত আদর্শের গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তির মৃত্যু হয়, কালের পরিবর্তন হয়, একটি জাতির উত্থান-পতন ঘটে; কিন্তু আদর্শের কোন দিন মৃত্যু হয় না। আদর্শ কাকে বলে এবং আদর্শের পরিধিভুক্ত গুণাবলী কী কী- এ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারলে একটি আদর্শ পরিবারের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ সহজতর হয়।
যেমন ধরা যাক একটি সমাজের কথা। সোসাইটি বা সমাজকে তখনই আদর্শ সমাজ হিসেবে অভিহিত করা যাবে, যখন এর মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি-নৈতিকতা, মানবতা, মননশীলতা, পরোপকারিতা, ব্যক্তির মূল্যবোধ এবং উন্নত মানব সম্পদ উন্নয়নের ইতিবাচক সকল গুণাবলী বিদ্যমান থাকবে। আর যদি কোন সমাজে উপরোল্লিখিত গুণাবলী প্রচলিত না থাকে, তাহলে সেই সমাজকে আদর্শ সমাজ শিরোনামে অভিহিত করার কোন যৌক্তিকতা নেই, বরং সেই সমাজ ভূপৃষ্ঠে সবচে নিকৃষ্ট ও বর্বর সমাজ রূপেই কুখ্যাতি লাভ করতে বাধ্য।
এমন সমাজে বসবাসরত মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি, মায়া-মমতা, স্নেহশীলতা, শ্রদ্বাবোধ ও প্রীতি-ভালবাসা বহাল বিদ্যমান থাকার কোন সুযোগ নেই। হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতারণা-প্রতিশোধ, আর পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদই উল্লিখিত সমাজের নিত্য দিনের সংবাদ শিরোনামে প্রকাশ করা হয়। অনুরূপ একটি পরিবারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। পরিবারটি যদি সামগ্রিকভাবে সুখময় এবং সুশৃঙ্খল পরিবেশে পরিচালিত হয়, তাহলে জান্নাতী সুখের ফল্গুধারা ইহজগতেই অনুভব করা যায়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে পরিবার প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনা পদ্ধতি যদি এর বিপরিতমুখী হয়, তাহলে কুরআন-হাদীসের ভাষ্যমতে দুনিয়াতেই জাহান্নামের অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।
বলাই বাহুল্য যে, পরিবারে যদি শান্তি না থাকে, তাহলে সমাজে শান্তির আশা করা যায় না, সমাজ পরিবারের সদস্যদের দ্বারাই পরিচালিত হয়ে থাকে। অতএব, সুন্দর, সুশৃংখল ও ভারসাম্যপূর্ণ একটি সমাজ পেতে হলে আদর্শ একটি পরিবার প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। আদর্শ ও মানসম্মত একটি তাক্বওয়া ভিত্তিক পরিবার প্রতিষ্ঠায় কুরআন-হাদীসের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক-নির্দেশনার উপর সামান্য আলোকপাত করবো।
নির্দেশনা- ১
একটি আদর্শ পরিবার গঠন করতে হলে সর্বাগ্রে একটি পরিবেশ সম্মত বাড়ি নির্বাচন করতে হবে। কারণ, পরিবার গঠনে বাড়ি হচ্ছে একটি অপরিহার্য অংশ। বাড়ি নির্মাণের পূর্বে তার আশপাশ পর্যবেক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিবেশী যদি মন্দ স্বভাবের হয়, তাহলে তাদের অনাকাঙ্খিত আচার-আচরণে প্রভাবান্বিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।
এর সমর্থনে হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি মূল্যবান বাণীও পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, বাড়ি করার পূর্বে প্রতিবেশীর নৈতিকতা দেখা দরকার। এক প্রতিবেশির কাজ-কর্ম অপর প্রতিবেশিকে প্রভাবান্বিত করে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিবেশীর অনিষ্টতা থেকে এরূপ পানাহ চেয়ে দোয়াও করেছেন, হে আল্লাহ! আপনার নিকট পানাহ চাই মন্দ প্রতিবেশী থেকে স্থায়ী বসত বাড়িতে। (বুখারী)।
তাক্বওয়া ভিত্তিক আদর্শ পরিবার গঠনে মসজিদের ভূমিকাও অপরিসীম। সুতরাং বাড়ির সন্নিকটে একটি মসজিদ হওয়া উত্তম। কারণ, মসজিদ কাছে হলে বহু আমল ও পুণ্য অর্জন করা সহজ হয়। যেমন- জামাতে নামায পড়া, বাচ্চাদেরকে কুরআন শিক্ষা দেয়া, আযান শুনে মহিলাদের সময়মত নামায পড়ার সুবিধাসহ আরো অনেক কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
নির্দেশনা- ২
জান্নাতী আনন্দ উপভোগ করার কেন্দ্রস্থল সুগঠিত একটি পরিবার গঠনে যেমন বাড়ি অপরিহার্য, ঠিক তেমনি বাড়ি পরিচালনায় একজন সৎসাহসী আদর্শবান কর্তাও আবশ্যক। কর্তাকে পরিবার পরিচালনায় আদর্শ অভিভাবকের ভূমিকায় থাকতে হবে। অতন্দ্র পাহারাদারের ন্যায় পরিবার সম্পর্কে সম্যক অবগত থাকতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন মতো আসমানী জ্ঞানার্জনের বিকল্প কোন তরিকা গ্রহণের সুযোগ নেই। কারণ, যার মধ্যে ওহী ভিত্তিক আসমানী চিরন্তন বিধানের কোন ইলম নেই, তার দ্বারা এরকম একটি গুরুদায়িত্ব যথাযথ আদায় হওয়া আশংকামুক্ত নয়। সুতরাং পরিবারের কর্তা বা স্বামীকে শিক্ষায় গুণীজন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
পরিবারের শৃংখলা রক্ষা ও ভারসাম্যতা বজায় রাখার মূল চালিকা শক্তিই হলেন কর্তা বা স্বামী! স্বামী যদি তার বুদ্ধি-বিবেক, চিন্তা-চেতনা ও নীতি-নৈতিকতাকে যথা নিয়মে প্রয়োগ করতে সক্ষম হন, তাহলে অল্প দিনেই পরিবারটি সর্ব দিক থেকে প্রশংসিত হবে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও বিদ্যা-বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বে মানুষের কাছে মর্যাদা পাবে।
পক্ষান্তরে পরিবারের কর্তা যদি নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করেন, ব্যক্তিত্ব বা জোরালো স্বকীয় ইমেজ তৈরী না করতে পারেন, তাহলে তাঁর উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে পরিবারের কোন সদস্য বিপদগামী হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। তখন এর দায়-দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা কর্তার স্কন্ধেই বর্তাবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তুমি তোমার অধীনস্থদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। কেননা, তোমার অধীনস্থদের সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। (মিশকাত)।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- কাশ্মীরীরা নিজেদের ভারতীয় মনে করে না, তারা ভারতীয় হতে চায় না
- আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রাহ.): কিছু কথা, কিছু ব্যথা
- ইসলামে সামাজিক সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখার গুরুত্ব
- ‘গ্যাং’ কালচারের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা সময়ের দাবী
উপরোক্ত হাদীস শরীফে কর্তা বা স্বামীকে তার অধীনস্থ সদস্যদের সার্বিকভাবে কল্যাণমুখী করার ইঙ্গিত প্রধান করা হয়েছে। তাদের শিক্ষা-দিক্ষা, আচার-ব্যবহার, লেন-দেন ও উত্তম চরিত্রের প্রশিক্ষণ দেয়া পরিবারের কর্তার প্রধান কর্ম হিসেবেই উক্ত হাদীসে আখ্যা দেয়া হয়েছে।
নির্দেশনা- ৩
আদর্শ পরিবার গঠনে একজন আদর্শ নারীর বিকল্প নেই। আদর্শ নারী বলতে চরিত্রবতী একজন মা-কেই বুঝায়। কুরআন-হাদীসে আদর্শ নারীকে বিবাহ করার জোর তাকিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সমাজে এর বিপরীত দিক লক্ষ্য করা যায়। এ যুগের টগবগে যুবকগণ অদুরদর্শিতা এবং আবেগ প্রবণতার কারণে চরিত্র ও গুণের সৌন্দর্যের চেয়ে রূপলাবণ্যকে গুরুত্ব দেয় বেশি। এমন সব তরুণী বিয়ে করতে চায়, যে শুধুমাত্র সুশ্রী মন মাতানো চেহারা ও সুন্দর সুঠাম দেহ-বল্লরী এবং রূপের অধিকারিণী। অথচ রূপের বাহার নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। সময়-সন্ধিক্ষণে এসব কিছুই হারিয়ে যায়। যদি রূপ লাবণ্য কিছু কাল দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবুও এর উপকারীতা ও উপভোগ্যতা খুবই নগণ্য, সীমিত ও স্বল্পস্থায়ী। অথচ গুণবতী একজন নারীকে পৃথিবীর সর্বোত্তম সম্পদ বলে শরীয়তে ঘোষণা করা হয়েছে।
হাদীস শরীফে নবীয়ে কারীম (সাহ.) ইরশাদ করেছেন, সমগ্র পৃথিবীটাই মানুষের পার্থিব প্রয়োজন মিটাবার উপযোগী সম্পদ। আর এ বিশ্বের সম্পদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ও মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে, সতী-সাধ্বী নারী। (ইবনে মাজাহ্)।
অপর এক হাদীসে গুণী নারীর বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির বিশদ বিবরণ প্রদান করে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীকে দুনিয়ার সবচেয়ে উপকারী নিয়ামত বলে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, একজন মু’মিন পুরুষের জন্য তাক্বওয়ার পরে সত্বী স্ত্রীর চেয়ে আর কোন উত্তম নিয়ামত নেই।
আর সত্বী নারীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, স্বামী যদি তাকে (শরীয়ত সম্মত বৈধ) হুকুম করে, তবে সে তার আনুগত্য করে। স্বামী যদি তার প্রতি দৃষ্টিপাত করে, তখন তাকে আনন্দ ও তৃপ্তি দান করে। স্বামী যখন তার উপর পূর্ণ আস্থা রেখে কোন প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করে, তখন সে প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে। আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে তার ধন-সম্পদের অপচয় করে না এবং তাকে নিয়েও যেন স্বামীর মনে বেদনা না হয়, সে দিকে খেয়াল করে চলে। (ইবনে মাজাহ)।
একটি আদর্শ পরিবার গড়তে রুচি-সম্পন্না আদর্শ নারীর গুরুত্ব উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাস্তবধর্মী হৃদয়গ্রাহী মূল্যবান ও উত্তম পরামর্শ প্রদান করেছেন। বুখারী শরীফের হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মানুষ সাধারণতঃ যে কোন নারীকে বিয়ের ক্ষেত্রে চারটি বিষয়ের প্রতি বিবেচনা করে- (এক) তার আর্থিক আবস্থা বা বিত্ত-বৈভব। (দুই) তার বংশ ও আভিজাত্য। (তিন) তার রূপ ও সৌন্দর্য। (চার) তার গুণাবলী ও ধর্মভীরুতা। তুমি ধর্মভীরুতা তথা দ্বীনদারীকে প্রধান্য দিয়ে এ বিষয়ে সফলতা অর্জন করো ।
নির্দেশনা- ৪
পরিবারের গ্রহণযোগ্যতা সমাজে ফুটিয়ে তুলতে হলে, সন্তানদেরকে আদর্শবান করে গড়ে তুলতে হবে। আর সন্তানদের আদব-আখলাক ও উত্তম শিষ্টাচারিতা শিক্ষা দিতে বিদ্যালয়ে প্রেরণ করা আপরিহার্য। বলাই বাহুল্য যে, সন্তানের প্রথম বিদ্যালয় হলো মা। অতএব, মাকে সু-শিক্ষায় বিদ্বান হতে হবে। মা যেমন- নিজে ভাল আমল করবে, তেমনি সন্তানকেও আদর্শ শিক্ষা দিবে।
সন্তানের শিক্ষার্জনের উপরই তার ভবিষ্যৎ জীবনে সফলতা বা ব্যর্থতার মানদন্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং তাকে এমন জ্ঞানের শিক্ষাদান করতে হবে, যা তার জীবনের প্রতিটি শাখায় সফলতা এনে দেয়। আর এ কথা সুস্পষ্ট যে, কুরআনের শিক্ষাই হলো সর্বোৎকৃষ্ট শিক্ষা। ইতিহাসের পাতায় যাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে, তাদের মতোই ওহী ভিত্তিক আসমানী জ্ঞানের অনুসারী, ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচারিতা ও বিনয়ী স্বভাবের মানুষ হতে হলে কুরআনের শিক্ষাই অর্জন করতে হয়। আদর্শ পরিবার গঠনে আদর্শবান সন্তানের জন্য ওহীর জ্ঞানই আদর্শ জ্ঞান।
নির্দেশনা- ৫
ইজ্জত-সম্ভ্রম ও শালীনতা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শালীনতা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা ও বিনয়ী স্বভাবের ব্যক্তির মতো জীবন গঠনে এ সমস্ত গুণাবলী অপরিহার্য। পরিবারের অধিনস্ত সদস্যদের এগুলো শিখিয়ে দিতে হয়। মা-বাবার কাছে যা শিখে সন্তানেরা, অন্য কোথাও সেগুলো শিখার সুযোগ নেই। অতএব, মা-বাবা; পরিবারের এ প্রধান দুই ব্যক্তির চলা-ফেরা, আচার-আচরণ, কথা-বার্তা ও ব্যবহার রীতি হবে অত্যন্ত পরিশীলতা ও সৃজনশীল।
প্রচন্ড রাগের সময়ও শালীনতা রক্ষার্থে নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। অশালীন ও অশ্লীল শ্রুতিকটূ বাক্য বা শব্দ ব্যবহার করবে না। কারণ, ঘরে ছোট শিশুরা থাকলে তা রপ্ত করে নিবে। কেননা, শিশুরা খুব আনুকরণ প্রিয় হয়ে থাকে। তাই সর্তক থাকতে হবে, যেন তাদের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া না পড়ে। পরিবারের সদস্যদের আদর্শবান করে তুলতে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মা-বাবা ও বড়দের গোপনীয়তা যাতে ছোটদের সামনে প্রকাশ না পায়। কারণ, এতে লজ্জা ভঙ্গ হয়। আর লজ্জাহীনতা দেশ ও জাতিকে ধ্বংসের কবলে নিয়ে যায়। সুতরাং সন্তানকে সুনাগরিক ও আদর্শ ব্যক্তিত্ববান রূপে সমাজে দাঁড় করাতে হলে বাবা-মার পারস্পরিক আচরণ বিধি সৎ ও রুচিসম্পন্ন হতে হবে।
নির্দেশনা- ৬
আদর্শ পরিবার গঠনের ক্ষেত্রে আদর্শ শিক্ষার জুটি নেই। আদর্শ শিক্ষা তথা ইসলামী শিক্ষার সহায়ক হিসেবে বাড়ীতে একটি ধর্মীয় পাঠাগার রাখতে হবে। পাঠাগারে থাকবে ইসলামের সহীহ আক্বীদা, তাফসীর, হাদীস, ইতিহাস, ফিক্বাহ ও আদর্শ মানবদের উচ্চমানের বিজ্ঞানী গ্রন্থ, প্রয়োজনীয় বই-পুস্তক। তাছাড়া শিক্ষণীয় পত্র-পত্রিকাও থাকবে পাঠাগারের পুস্তক পরিসংখ্যানে। এছাড়া সমাজ বিজ্ঞান, ভূগোল ও সাধারণ জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রশ্নোত্তর আকারে লিখিত কিছু গ্রন্থাদিও রাখা যায়। আর পাঠাগারের শোভাবর্ধ্বন বা সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত কিছু ওয়াল সিনারী ঝুলিয়ে দিলে পাঠাগারের পরিবেশ আরো নিবীড় হবে। বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা এ রকম করে সাজাতে হবে, যেন ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়।
নির্দেশনা- ৭
পরিবার বা সংসারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে যে কোন বিষয়ে সিদ্বান্ত দেয়া-নেয়ার পূর্বে ঘরোয়া পরামর্শ করা সুন্নাত। সূরা শূয়ারার ৩৮নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- মু’মিনদের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত নিবে। পরিবারের কর্তার উচিত, যখন কোন কাজ সামনে আসে তখন পরিবারের সচেতন সদস্যদের নিয়ে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এতে মহান আল্লাহ রহমত নাযিল করবেন।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, কোন কোন পরিবারের কর্তা ব্যক্তি এমনও আছেন যে, সমাজে তার ব্যক্তি ইমেজ বলতে কিছুই নেই! অথচ ঘরে আসলে প্রধানমন্ত্রীর হাল-সূরতের ভাব ধরেন। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কেউই সাহস পান না জনাবের সাথে কথা বলার। আর কোন কাজ করার সময় পরামর্শ তো নেই-ই, উপরন্তু কেউ ঘটমান কাজের উপর কোন মন্তব্য করলেও চটে যান। এমন সংসারে সমস্যার পরিবর্তে সমাধানের কোনই আশা করা যায় না। কর্তার এমন অহংকার ও দাম্ভিকতা সূলভ আচরণ পরিহার করা উচিত।
নির্দেশনা- ৮
একটি ভদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েদের দায়িত্ব হলো, মা-বাবাকে রাজি-খুশি রাখার চেষ্টা করা। মাতা-পিতার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারলে সর্বস্থানেই মর্যাদা পাওয়া যায়। পবিত্র কুরআনে সূরা নিসার ৩৬নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, “তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার করো না। আর মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো”। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি তোমার মাতা-পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে নিহিত”। সন্তানাদি বখাটে বা বে-আদব হলে পরিবারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। পারিবারিক সুনাম নষ্ট হয়। সুতরাং ছেলে-মেয়েদের উচিত, ভদ্র-মার্জিত ও নম্র মেজায সম্পন্ন হওয়া।
নির্দেশনা- ৯
মানুষের আচার ব্যবহার যেমন আভিজাত্যের পরিচায়ক, তেমনি তার পোশাক পরিচ্ছদও ব্যক্তিত্বের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত। তজ্জন্য পরিবারের সকলকেই মানানসই পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করা বাঞ্ছনীয়। প্রত্যেকটি বস্তুর পরিচয়ের জন্য ইউনিফর্ম যেমন অপরিহার্য, আদর্শ একটি পরিবারের সদস্যদের জন্য ইসলামী পোশাক-পরিধানও বিশেষ দায়িত্ব কর্ম। পোশাকের ক্ষেত্রে মহিলাদের আলাদা সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী। পবিত্র কুরআনে সূরা নূরের ৩১নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা ঘোষণা করেন, “এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ছেড়ে দেয়”।
অবাঞ্ছিত পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়ায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এমন কাপড় পরিধান করা অনুচিত, যা দ্বারা গোপন অঙ্গের আকার-আকৃতি প্রকাশ পেয়ে যায়। যারা এরূপ কাপড় পরবে, তারা বেহেস্তের গন্ধও পাবে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বলতে হয় যে, বর্তমান যুগের আধুনিকতার শ্লোগানধারী ভাই-বোনেরা যে সব কাপড় চোপড় পরিধান করে, তা দেখলে শয়তানও লজ্জা পায়। প্রগতির নামে অধোগতি যে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তার কোনই ভাবনা আমাদের নেই। হালচালে মনে হয়, অনতিকালে নগ্নতাকেও ফ্যাশনের বোতলে বাজারজাত করা হবে। আল্লাহ্ তাআলা আমাদের শুভ বুদ্ধির উদয় করুন।
নির্দেশনা- ১০
স্রষ্টা প্রদত্ত বিধানসমূহ যথাযথ পালন করাই হলো একটি পরিবারে আদর্শচারিতার মাপকাঠি। যে পরিবারে ইবাদতের গুরুত্ব নেই, নামায রোযা ও সৎকাজের প্রতি আগ্রহ নেই, সেই পরিবার মডেল হতে পারে না। আল্লাহর বিধান পালনই হলো সফলতার গ্যারান্টি। খাহেশাত বা প্রবৃত্তির প্ররোচনায় জীবন পরিচালনার মধ্যে কোনোই আদর্শ থাকতে পারে না। বরং এমন প্রক্রিয়ায় জীবন চালাতে হবে, যেন প্রতিটি কাজই ইবাদতে পরিণত হয়।
উপসংহারঃ জান্নাতী সুখের মডেল হলো একটি আদর্শ পরিবার। কার্যতঃ একটি পরিবারই একটি জাতির মূল ভিত্তি। ভিত্তি দূর্বল হলে প্রাসাদ যেমন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে, তেমনি পরিবার আদর্শবান না হলে একটি আদর্শজাতি পাওয়াও সম্ভব নয়। সুতরাং সমৃদ্ধশালী একটি পরিবার গঠন করতে হলে উপরোক্ত দিক-নির্দেশনা সমূহ বিবেচনাযোগ্য মনে করি।
লেখক: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী স্কলার, সমাজসেবক এবং সহকারী মহাসচিব- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, সভাপতি- ইউকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম।
উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ