।। আরিফুল ইসলাম শিকদার ।।
ব্যক্তিগত পরিসরে ধর্মপালন যতটা না হইলৌকিক তারচেয়ে বেশী পারলৌকিক। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় পরিসরে ধর্ম যতটা না পরকালীন তার চেয়ে বেশী ইহকালীন।
ব্যক্তি আমি নিজের মধ্যে শিরকের বিন্দুমাত্র স্থান দিতে পারি না। কিন্তু রাষ্ট্রের মধ্যে যে কোন উপায়েই হোক আপনাকে শিরকী কার্যকালাপকে স্থান দিতে হয়, যতক্ষণ না রাষ্ট্রের শতভাগ নাগরিক মুসলিম হয়।
এটা তো গেল মুসলিম অমুসলিমের বিষয়। কিন্তু খোদ মুসলিমদের মধ্যেই খেয়াল করুন। ব্যক্তিগতভাবে আপনার অর্থবিষয়ক ধর্মপালন হল আপনি হালালভাবে অর্থ উপার্জন করবেন এবং তার বণ্টনও সঠিকভাবে করবেন। অপচয় করবেন না। অপচয়কারী হল শয়তানের ভাই। তাই অপচয়ের কারণে আপনি গুনাহগার হবেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে কি এই কারণে আপনার উপর কোন দন্ড আরোপ হবে? না, হবে না। বরং রাষ্ট্র আপনার খরচের পর বাকি যে অর্থ থাকবে, তা থেকে যাকাত নেবে। অতএব, রাষ্ট্র আপনার ধর্মীয় জীবনের পুরা বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে না।
আমার উপরের দু’টো উদাহরণ বোঝা আপনার জন্য আশা করি সহজ। কিন্তু আরেকটু সামনে অগ্রসর হলে হয়তো কঠিনও হতে পারে।
ইসলামী রাষ্ট্রে যেসব অমুসলিমরা বসবাস করবে, তাদের মহিলারা কি পর্দা করবে? পর্দা না করার কারণে তাদের ধর্ষণ করা জায়েয হবে ? রাষ্ট্র কি তাদের পর্দার বিধান দিতে পারবে?
ফতেহ মক্কার আগের ঘটনা নিশ্চয়ই আপনাদের স্মরণে আছে। যেখানে একজন মহিলাকে পথের মধ্যে আটকে আলী (রাযি.) জেরা করছিলেন। কারণ, ঐ মহিলা ছিল গুপ্তচর। তখন আলী (রাযি.) কি পর্দার বিধান মেনেছেন ? নাকি মানা জরুরী ছিল ? এমনকি, তিনি মহিলাকে হুমকি দিয়েছিলেন যে, তাকে তল্লাশী করা হবে। এবং মহিলার কাছেও এটা স্পষ্ট ছিল যে, এই রকমই করা হবে।
[ ২ ]
উমর (রাযি.) দুর্ভিক্ষের সময় চোরকে শাস্তি দিতে হাত কাটেননি। আমার মনে হয় আপনি হলে কেটে দিতেন। আপনি আয়াত পাঠ করতেন- “পুরুষ কিংবা নারী চুরি করলে তাদের হাত কেটে দাও। তা তাদের কৃতকর্মের ফল এবং নির্ধারিত আদর্শদণ্ড। আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। (সূরা মায়িদা আয়াত- ৩৮)” আপনি হয়তো বলতেন ধর্মের স্বার্থে আমি একজন বরং দেশের নব্বই ভাগ জনগণের হাত কাটব। আপনি বলতেন, আয়াতে দুর্ভিক্ষকালীন সময়কে আলাদা করা হয়নি। এখন হয়তো আপনি ফিক্বহের কিতাব দেখে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন যে, দুর্ভিক্ষকালীন ক্ষুধার তাড়নায় চুরি করলে শাস্তি প্রয়োগ হবে না। এবং ঐ সময়ের ফক্বীহগণ উমর (রাযি.)এর আমল দেখে হয়তো সিদ্ধান্তটি দিয়েছেন।
কিন্তু মনে করুন, নতুন উদ্ভূত সমস্যায় আপনি উমর (রাযি.)এর যামানাতেই আছেন। তখন আপনার অবস্থান কি হত? আপনি কি মানতে পারতেন উমার (রাযি.)এর সেই সিদ্ধান্ত। সেই সিদ্ধান্তকে কি আপনি সঠিক হওয়ার বিবেচনায় সঠিক মনে করেন, নাকি উমার (রাযি.)এর শান দেখে সঠিক মনে করেন?
[ ৩ ]
উপরের দু’টি আলোচনার পর বলব, সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। আমাদের আদর্শ অবশ্যই কুরআন এবং সুন্নাহ। কিন্তু সেটার প্রয়োগ আপনি সামাজ রাষ্ট্রে কীভাবে করবেন সেটা অবশ্যই ভাববেন। এবং সেই ভাবনাটা অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মাকাসাদে শরীয়তকে সামনে রেখে।
আগে তো দার দুটো ছিল, দারুল ইসলাম এবং দারুল হরব। এখন কয়টা? তিনটা। দারুল ইসলাম , দারুল হরব এবং দারুল আমান। আপনি যদি দারুল আমানকে স্বীকার না করেন, তবে আলাদা আলোচনা করব। কিন্তু যারা নিজেদের দেওবন্দী বলেন তারা তো দারুল আমান স্বীকার করেই আছেন। খোদ দেওবন্দ মাদ্রাসা আছে দারুল আমানের ফতোয়ার উপর ভিত্তি করে।
আমি নিজেও এই মত স্বীকার করি। আপনি চিন্তা করে দেখুন, দেড় হাজার বছর পূর্বের রাষ্ট্রের কাঠামো আর এখনকার রাষ্ট্র কাঠামো। আগে রাষ্ট্র হত ধর্মের ভিত্তিতে। সেখানে রাষ্ট্রীয় বিধিমতেই এক ধর্মের লোক অপর ধর্মের লোকের উপর প্রাধান্য পেত। কিন্তু এখন সেক্যুলার সিস্টেমে এটা হয় না। এবং আপনি আমি সেইরকম একটা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বাস করছি। এই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সাথে কীভাবে ডিল করব, সেটা অবশ্যই আপনাকে বিবেচনা করতে হবে। দারুল ইসলাম এবং দারুল হরব দিয়ে বিষয়টা শেষ হবে না, বরং দারুল আমানে প্রবেশ করতে হবে।
এই দারুল আমানে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর্যায়গুলো কি হবে, সেটা অবশ্যই চিন্তা করতে হবে। দারুল আমান কাঠামোতে আপনি যদি দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হন, তবে সেটা হবে চুক্তি ভঙ্গ। এটার একটা পর্যায় কিন্তু আমরা রাসূল (সা.)এর যামানায় আবিসিনিয়ায় পেয়েছি। আবিসিনিয়ার বাদশাহ মুসলিম ছিলেন না। কিন্তু তিনি মুসলমানদের নিরাপত্তা দিয়েছিলেন। সেই নিরাপত্তা কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, বরং ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা সামাজিকভাবে ইসলাম পালনের জন্য।
তাহলে এখনকার রাষ্ট্র আর আবিসিনিয়ার তৎকালীন পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য কি? পার্থক্য শাসক ন্যায়পরায়ণ হওয়া আর না হওয়া। নয় তো সেক্যুলার রাষ্ট্রে মুসলমানদের অবস্থান কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে আবসিনিয়ার মুসলমানদের তুলনায় ভাল। কেননা সেখানে কেবল বাদশাহর দয়ার উপর মুসলমানরা বসবাস করেছিল। কিন্তু সেক্যুলার রাষ্ট্রে কারো দয়ার উপর নয়, বরং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর চুক্তিবলে মুসলমানরা বসবাস করে। চুক্তিতে সকল ধর্মের মানুষ রাষ্ট্রে কাছে সমান।
এই বিবেচনা সামনে রাখার পাশাপাশি আমাদের নিজ ভূখন্ডের ঐতিহাসিক চুক্তিগুলো বুঝা উচিত। কারণ, ঐতিহাসিক চুক্তিবলে বাংলাদেশ সেক্যুলার রাষ্ট্র না হওয়া সত্ত্বেও ছলে বলে কৌশলে সেক্যুলারিজম কায়েম করা হয়েছে।
এটা হল রাষ্ট্রের অবস্থা। কিন্তু এরই সাথে মানুষের জীবনাচরণ ও ইসলামী রাষ্ট্রের আচার আমরা কতটুকু মাথায় নিতে পেরেছি। যেই সমাজের উপর ফতোয়া লাগাচ্ছি তাদের মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন আমরা কখন থেকে করতে পারব?
আপনি ফতোয়া দেওয়ার পর সমাজের কাছে কি ম্যাসেজ যায়, ইসলাম এর দ্বারা উপকৃত হয় না ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ইসলামের চাওয়া এই রকমই কি না, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন যদি আপনি অনুভব করতে না পারেন, তবে আমি কীভাবে আপনাকে নবীর ওয়ারিশ হিসাবে মানবো? শুধু সার্টিফিকেট দিয়ে? দেখুন নবীর ওয়ারিশ উমার (রাযি.) কীভাবে দুর্ভিক্ষের সময় ইসলামকে ধারন করেছেন।
এই লেখায় কোন ভুল ভ্রান্তি থেকে থাকলে তা আমার পক্ষ থেকে, আর ভাল কিছু পেলে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। আল্লাহু আ’লাম।
লেখকঃ আহবায়ক মুভমেন্ট ফর ইনসাফ।